উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সাদত হাসান মান্টো প্রায় সাত দশক আগে একটি ছোটগল্প লিখেছিলেন। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত ‘ইয়াজিদ’ নামের সেই গল্পটি পাকিস্তানের পাঞ্জাবের একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে রচিত। গল্পের পটভূমিতে গুজব ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। মানুষজন বলাবলি করতে থাকেন, ভারত নাকি পাকিস্তানে প্রবাহিত নদীগুলোর পানি বন্ধ করে দেবে।

গল্পের একটি চরিত্র সেই গুজবের জবাবে বলেন, ‘নদী কি কেউ বন্ধ করতে পারে? এটা তো নর্দমা না, নদী।’ ৭৪ বছর পর গল্পের সেই গুজব আজ যেন বাস্তব এক পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে।

গত ২২ এপ্রিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ২৬ জন মানুষ নিহত হন, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন পর্যটক। এই হামলার জন্য নয়াদিল্লি সরাসরি পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করে, যা পাকিস্তান অস্বীকার করেছে। পরের দিন সিন্ধু পানি চুক্তি (আইডব্লিউটি) স্থগিতের ঘোষণা দেয় ভারত।

নদীর প্রবাহ থেমে গেলে ভাটির দেশ হিসেবে পাকিস্তানের কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা এবং কোটি মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এতে ভারত-পাকিস্তান পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

চুক্তিটি ছয় দশক ধরে সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীর পানিবণ্টন নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। ২৭ কোটির বেশি মানুষের জীবন-জীবিকা এই চুক্তির ওপর নির্ভরশীল, যাদের অধিকাংশই পাকিস্তানে নাগরিক।

ভারতের ঘোষণার পরদিনই পাকিস্তানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিষদ ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিটি (এনএসসি) এই একতরফা সিদ্ধান্তকে ‘আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘন’ বলে নাকচ করে দেয়। পরিষদ জানিয়ে দেয়, পাকিস্তানের পানির গতিপথ বদলানো হলে তা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হবে।

পেহেলগামে হামলার ১৫ দিন পর ৭ মে পাকিস্তানে হামলা চালায় ভারত। পাকিস্তান তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং পাল্টা হামলা চালায়। দুই পক্ষে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। চার দিনের সংঘাতের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় দুই দেশ অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়।

সাময়িকভাবে পাল্টাপাল্টি হামলা বন্ধ হলেও দুই দেশই কূটনৈতিকভাবে নিজেদের অবস্থানকে বৈশ্বিকভাবে শক্তিশালী করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত নিয়ে এখনো নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে ভারত। গত ২১ জুন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এটি আর কখনো পুনর্বহাল হবে না। আন্তর্জাতিক চুক্তি একতরফাভাবে বাতিল করা না গেলেও আমরা তা স্থগিত রাখার অধিকার রাখি এবং আমরা সেটাই করেছি।’

পাকিস্তানের পানির গতিপথ বদলানো হলে, তা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হবেপাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি

অমিত শাহ আরও বলেন, ‘চুক্তির প্রস্তাবনায় বলা আছে, এটি দুই দেশের শান্তি ও উন্নতির জন্য। কিন্তু যখন সে শান্তি ভঙ্গ হয়, তখন চুক্তি রক্ষা করার মতো কিছু অবশিষ্ট থাকে না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত থাকলে নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে তা পাকিস্তানের জন্য অস্তিত্বসংকটের প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিতে পারে।

নদীর প্রবাহ থেমে গেলে পাকিস্তানের কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা এবং কোটি মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এতে ভারত-পাকিস্তান পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

ভারত পুরোপুরি সিন্ধু অববাহিকার পানি বন্ধ করতে পারবে না। অন্তত বর্তমান অবকাঠামো দিয়ে ভারতের পক্ষে তা করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, শীত মৌসুমে ভারতের সামান্য পানি সরানো বা বাধা দেওয়ার ক্ষমতাও পাকিস্তানকে গুরুতর বিপদে ফেলতে পারে। কারণ, পাকিস্তানে পানি ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত জলাধার নেই। ফলে ভারত যদি নদীর গতিপথে হস্তক্ষেপ করে, সেই সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি এখনো পাকিস্তানের নেই।

একটি নদী, একটি অঞ্চল, এক বিরোধ

সিন্ধু নদের উৎপত্তির তিব্বতের কৈলাস পর্বতে, যা প্রায় ৫ হাজার ৪৯০ মিটার (১৮ হাজার ফুট) উচ্চতা থেকে নেমে এসেছে। এটি বিশ্বের দ্বাদশ দীর্ঘতম নদ। উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে এটি ভারতের কাশ্মীর অঞ্চল অতিক্রম করে পাকিস্তানে প্রবেশ করে এবং প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আরব সাগরে গিয়ে মিলিত হয়।

পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের পাহাড়ি পথে সিন্ধু নদ সোয়াট ও কাবুলের মতো পশ্চিম দিকের উপনদীগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়। এরপর তা পাঞ্জাবের উর্বর সমভূমিতে প্রবেশ করে। যেখানে পূর্ব দিকের ঝিলম, চেনাব, রবি, বিপাশা ও শতদ্রু—এই পাঁচ উপনদী সিন্ধুর সঙ্গে মেশে।

চেনাব নদীর ওপর ভারতের নির্মিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ‘বাগলিহার হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট’-এর একটি দৃশ্য। কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি একতরফা স্থগিত করেছে ভারত.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য প রব হ

এছাড়াও পড়ুন:

ট্রাম্পকে ইউক্রেনের পাশে থাকার আহ্বান রাজা চার্লসের

বিশ্বের সবচেয়ে জটিল কিছু সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতির প্রশংসা করেছেন ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস। একই সঙ্গে তিনি ‘স্বৈরাচারের (রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন) বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থন’ দেওয়ার জন্য ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানান। খবর বিবিসির।

বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফরের প্রথম দিনে উইন্ডসর ক্যাসলে আয়োজিত রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে দেওয়া বক্তৃতায় এ কথা বলেন রাজা।

আরো পড়ুন:

যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় ৩ পুলিশ নিহত

সম্পদ বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করায় সাংবাদিকের ওপর ক্ষেপলেন ট্রাম্প

জবাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সম্পর্কের প্রশংসা করে বলেন, এ সম্পর্ককে ‘বিশেষ’ শব্দ দিয়ে যথাযথভাবে বোঝানো যায় না।

উইন্ডসর ক্যাসলে ১৬০ জন অতিথির জন্য আয়োজিত জাঁকজমকপূর্ণ এই নৈশভোজে রাজার বক্তৃতায় দুই দেশের গভীর বন্ধন এবং সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়।

ট্রাম্পের রাষ্ট্রীয় এ সফর চলবে আজ বৃহস্পতিবারও। এদিন নানা অনুষ্ঠানে মার্কিন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের সঙ্গে অংশ নেবেন ব্রিটিশ রানি ক্যামিলা ও প্রিন্সেস অব ওয়েলস।

রাজকীয় অ্যাপায়ন শেষে ট্রাম্পের আজকের কর্মসূচি রাজনৈতিক আলোচনায় রূপ নেবে। আজ বৃহস্পতিবার ট্রাম্প ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে তার সরকারি বাড়ি চেকার্সে বৈঠক করবেন। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনও হবে। 

বুধবারের (১৭ সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্রীয় ভোজ ছিল আড়ম্বর ও রাজনীতির সমন্বয়ে সাজানো এক বিশেষ আয়োজন। ভোজে রাজা, রানি ও রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের উপস্থিতিতে ট্রাম্পকে স্বাগত জানানো হয় উইন্ডসরে।

উইন্ডসর ক্যাসলের মনোরম প্রাঙ্গণে পৌঁছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও মেলানিয়া রাজকীয় ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামেন। সেখানে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো সেনাদলের অভিবাদন গ্রহণ করেন তারা। 

যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তাদের মতে, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে স্বাগত জানানোর জন্য দেশটিতে আয়োজিত স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সামরিক সংবর্ধনা ছিল এটি।

যুক্তরাষ্ট্রের অতিথিকে স্বাগত জানাতে প্রিন্স ও প্রিন্সেস অব ওয়েলসও উপস্থিত ছিলেন। তারা প্রেসিডেন্ট ও মেলানিয়ার সঙ্গে উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ এক বৈঠকও করেন।

ভোজসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রিন্স উইলিয়ামের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে তিনি হবেন ‘অসাধারণ সফল নেতা’। প্রিন্সেস অব ওয়েলস ক্যাথরিনকে তিনি আখ্যা দেন ‘উজ্জ্বল, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ও সুন্দরী’ হিসেবে।

ট্রাম্পের ঐতিহাসিক এ দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় সফর প্রমাণ করেছে রাজা ও তাঁর মধ্যে সম্পর্ক বেশ ভালো। সফরে আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মুহূর্তও দেখা গেছে।

এরপর রাজপ্রাসাদে ট্রাম্প দম্পতিকে স্বাগত জানান রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানি ক্যামিলা। ট্রাম্প যখন রাজার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ছয়টি কামান থেকে একযোগে ৪১ বার তোপধ্বনি করা হয়। একই সময়ে টাওয়ার অব লন্ডন থেকে একই রকম তোপধ্বনি হয়।

ট্রাম্প দম্পতিকে স্বাগত জানানোর এ আয়োজনে অংশ নেন ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ১ হাজার ৩০০ সদস্য। ছিল শতাধিক ঘোড়া।

যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তাদের মতে, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে স্বাগত জানানোর জন্য দেশটিতে আয়োজিত স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সামরিক সংবর্ধনা ছিল এটি।

বিবিসি বলছে, রাজকীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি, বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা থাকবে।

যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয় সফর হলো একধরনের নরম শক্তির কূটনীতি, যা গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য রাজকীয় আকর্ষণ ব্যবহার করে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কেউ নেই।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্টারমার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আর্থিক সেবা, প্রযুক্তি এবং জ্বালানি খাতে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় গড়ে তুলে যুক্তরাজ্যকে আমেরিকান বিনিয়োগের প্রধান গন্তব্য হিসেবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করছেন। এর মাধ্যমে তিনি নিজ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করতে চাইছেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফর শুরু হওয়ার সাথে সাথে, মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর সঙ্গে যুক্তরাজ্যে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগের একটি বড় প্রযুক্তি চুক্তি ঘোষণা করা হয়েছে। যার মধ্যে মাইক্রোসফট থেকে ২২ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং পারমাণবিক শক্তিতে সহযোগিতা দেখা যাবে। 

ট্রাম্পের সফরের আগে গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট যুক্তরাজ্যের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় ৫ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার ট্রাম্প-স্টারমারের বৈঠক থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায়িক চুক্তির ঘোষণাও আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ