গ্রামের এক প্রান্তে পাশাপাশি কয়েকটি টিনের ঘর। মাঝখানে একটি ছোট ও নিচু ঘরের বারান্দায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে পুরোনো কয়েকটি চেয়ার। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, ভেতরে কতটা নিস্তব্ধতা আর শূন্যতা নেমে এসেছে। সেই ঘর থেকেই কান্নার শব্দ ভেসে আসছে।

ওই ঘরেরই ভরসা ছিলেন মোস্তফা সরদার (৪৫)। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে মারা যান তিনি। রাতে বাড়িতে পৌঁছায় তাঁর মরদেহ। জানাজা ও দাফন শেষে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছে পরিবারটি। মৃত মোস্তফা সরদারের বাড়ি খুলনার কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা গ্রামে।

আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মোস্তফার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের ভেতর বসে ডুকরে কাঁদছেন বড় মেয়ে রিমা সুলতানা। সামনে সড়কের পাশে মাটিতে বসে আছেন স্ত্রী রেশমা বেগম। কখনো হেসে উঠছেন, আবার হঠাৎ কেঁদে উঠছেন। পাশেই কিছু প্রতিবেশী সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রতিবেশী মরিয়ম বেগম বললেন, ‘রেশমা ভাবি শোকে পাগল হইয়ে গেছে। তাঁর শুধু দুইডা মাইয়ে আছে, কোনো ছাবাল (ছেলে) নেই। সংসারের দায়দায়িত্ব নেবার মতোন আর কেউ থাকলুনা। কেমনি যে চলবে ওরা, আমরা কেউই তা জানিনে।’

এক পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মোস্তফার ছোট মেয়ে রুবিনা আক্তার। সে কয়রা সিদ্দিকীয়া ফাজিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। এই বয়সেই তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কথা ছিল, বাবা জঙ্গল থেকে ফিরে এসে আনুষ্ঠানিকতা সারবেন। কিন্তু বাবা ফিরেছেন লাশ হয়ে।

রুবিনার চোখ কান্নায় ছলছল করছিল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশী ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘যে বাড়িতে ছোট মাইয়া রুবিনার বিয়ে ঠিক হইছিল, তারাও গত রাতে জানাজায় আইছিল। মোস্তফাই ছিল এই সংসারের একমাত্র আয় করার মানুষ। হঠাৎ করে মানুষটা মরে যাওয়ায় এই পরিবারডা দিশাহারা হইয়ে গেছে।’

প্রতিবেশীরা জানান, মোস্তফা সরদার বছরের বেশির ভাগ সময় সুন্দরবনে মাছ ধরতেন। তাঁর নিজের কোনো নৌকা বা জাল ছিল না। অন্যের নৌকায় মজুরি খাটতেন। এখন সুন্দরবনে মাছ ধরায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা চলছে। তারপরও সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ এলাকার এক মাছ ব্যবসায়ীর নৌকায় দৈনিক এক হাজার টাকা মজুরিতে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন মোস্তফা। আগের বছর এই সময়ে বনে না গিয়ে এলাকায় দিনমজুরি করতেন তিনি। কিন্তু এবার আর ফেরা হলো না।

মোস্তফার সহকর্মী ইউসুফ আলী জানান, তাঁরা কয়েকজন মিলে সুন্দরবনের ইলিশিমারি খালে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ বন বিভাগের টহল দল ধাওয়া দেয়। তখন প্রাণ বাঁচাতে সবাই আরও গভীরে ঢুকে পড়েন। বনকর্মীরা তাঁদের নৌকা জব্দ করে নিয়ে যায়। নৌকা হারিয়ে সবাই বিপদে পড়েন। ওই অবস্থায় মোস্তফা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। মোস্তফাকে বসিয়ে রেখে তিনি আরেকটা নৌকার খোঁজে বের হন। ফিরে এসে দেখেন, মোস্তফা আর বেঁচে নেই। রাতভর নদীপথে মরদেহ নিয়ে সাতক্ষীরার লোকালয়ে পৌঁছান সহকর্মীরা। সেখান থেকে পরদিন সন্ধ্যায় লাশ এসে পৌঁছায় মোস্তফার বাড়িতে। স্ত্রী ও মেয়েরা অপেক্ষা করছিল।

মোস্তফার ফুফাতো ভাই আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ওদের নিজেগের কোনো জাগাজমি নেই। শ্বশুরের দেওয়া একটুখানি জায়গায় ঘর বান্দি বসবাস করত। মৃত্যুর পরও মোস্তফাকে শ্বশুরবাড়ির কবরস্থানে শুইয়ে দিতি হলো।’

কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান বলেন, ‘সুন্দরবনে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাছ ধরা নিষিদ্ধ। কিন্তু অভাবে থাকা সংসার চালাতে মোস্তফা সেই নিয়ম ভেঙেছিলেন। এর খেসারত দিতে হলো নিজের জীবন দিয়ে। মোস্তফা খুবই সহজ-সরল মানুষ ছিলেন। এলাকায় সবার সঙ্গে মিশে থাকতেন। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারটা ডুবে গেছে। আমাদের সবার উচিত ওদের পাশে দাঁড়ানো।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ন দরবন ম ছ ধরত পর ব র

এছাড়াও পড়ুন:

সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের বিএসএফের হাতে আটক ১৯ বাংলাদেশি মৎস্যজীবী

অবৈধভাবে ভারতীয় জলসীমায় প্রবেশের অভিযোগে ১৯ জন বাংলাদেশি মৎস্যজীবীকে গ্রেপ্তার করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ।

বিএসএফ সূত্রে জানানো হয়েছে, সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের উত্তাল নদীতে দীর্ঘক্ষণ ধাওয়া করে তাদের আটক করা হয়।  ধৃত মৎসজীবীরা বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের ভোলা জেলার পুরালিয়া গ্রামের বাসিন্দা। মাছ ধরার ট্রলার ও জালসহ তাদেরকে আটক করা হয়। 

আরো পড়ুন:

কলকাতায় সম্মিলিত সেনা সম্মেলন উদ্বোধন নরেন্দ্র মোদির

অবৈধ অভিবাসীদের প্রতি নরম হওয়ার দিন শেষ: ট্রাম্প

বিএসএফ জানায়, রবিবার সীমান্তের সুন্দরবন অংশে রুটিন টহল দেয়ার সময় গোসাবা রেঞ্জের বাঘমারি জঙ্গল এলাকায় বাংলাদেশি অবৈধ ট্রলারের উপস্থিতি নজরে আসে বিএসএফ জওয়ানদের। বিএসএফ জওয়ানদের পেট্রোল বোট ট্রলারটির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ট্রলারটি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। দ্রুততার সঙ্গে ট্রলারের পিছু ধাওয়া করা হয়। দীর্ঘক্ষণ ধাওয়া করে পরবর্তীতে পাকড়াও করা হয় বাংলাদেশি ট্রলারটিকে। অবৈধ অনুপ্রবেশ এর অভিযোগে আটক করা হয় এতে থাকা ১৯ জন বাংলাদেশি মৎস্যজীবীকে। বাজেয়াপ্ত করা হয় ট্রলারটি।

বিএসএফ আরো জানায়, আটকের পর দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্তরা অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগের বিপরীতে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে পারেনি। ফলে জিজ্ঞাসাবাদের পরে তাদের স্থানীয় সুন্দরবন কোস্টাল থানার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আজ সোমবার তাদের আলিপুর আদালতে তোলা হবে।

ঢাকা/সুচরিতা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘ছুটে গিয়ে দেখি, একটি হরিণ ঝুলছে শিকারির ফাঁদে’
  • সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের বিএসএফের হাতে আটক ১৯ বাংলাদেশি মৎস্যজীবী