সুন্দরবনের কয়রা নদীর পাশে গহিন বনে শিকারির ফাঁদে আটকা পড়ে উল্টো হয়ে ঝুলছিল একটি হরিণ। পরে হরিণটিকে উদ্ধার করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার সকাল নয়টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।

সুন্দরবনের হায়াতখালী টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পিন্টু বাড়ৈ হরিণটিকে উদ্ধারের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘সুন্দরবনের কয়রা নদীর পাশ ঘেঁষে সরু একটি খাল ঢুকে গেছে বনের গভীরে। নাম তার হেলাল খাল। ডিঙিনৌকায় খাল ধরে যত দূর সম্ভব এগোনো গেল, তারপর শুরু হলো হেঁটে টহল। চারদিকে শূলের মতো উঁচিয়ে থাকা শ্বাসমূল আর নানা গাছের কাঁটায় ভরা পথে হাঁটা এক যুদ্ধ। হঠাৎ নিস্তব্ধ বনে শোনা গেল হরিণের চিৎকার। ছুটে গিয়ে দেখি, একটি হরিণ ঝুলছে শিকারির ফাঁদে।’ ফাঁদ কেটে হরিণটিকে মুক্ত করতেই দৌড়ে চলে গেল বনের গভীরে।

বন কর্মকর্তারা জানান, সুন্দরবনে হরিণ শিকারের কৌশল নিষ্ঠুর। এক টুকরা শক্ত দড়ি, মাঝারি আকারের একটি গাছ বা গাছের ডাল দিয়ে তৈরি হয় ভয়ংকর ছিটকে ফাঁদ। শিকারিরা হরিণের চলাফেরার পথ চিহ্নিত করে সেখানে মাঝারি আকারের একটি গাছ কেটে সেই গাছের কাটা অংশের সঙ্গে দড়ির ফাঁদ টেনে বেঁধে রাখে। উপরিভাগে শুকনা পাতা ছড়িয়ে দেয়, যাতে ফাঁদ একেবারেই চোখে না পড়ে। নির্দিষ্ট জায়গায় হরিণ পা ফেললেই তীব্র বেগে দড়ির ফাঁস ছিটকে উঠে যায়, সঙ্গে গাছের কাটা অংশও টেনে নিয়ে শিকারকে ঝুলিয়ে ফেলে।

হরিণের ক্ষেত্রে বনের ভেতরে অপরাধ উদ্‌ঘাটনের তথ্য দেওয়ায় ২০ হাজার এবং বনের বাইরে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।ইমরান আহমেদ, খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক

হায়াতখালী টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পিন্টু বাড়ৈ বলেন, সুন্দরবনের হেলাল খাল আর পাশের বাইসার খালের আশপাশে হেঁটে তাঁরা গতকাল আরও প্রায় ৫০টি ছিটকা ফাঁদ উদ্ধার করেছেন।

আরও পড়ুনজেলের ছদ্মবেশে সুন্দরবনে প্রবেশ, চলছে বিষ দিয়ে মাছ ধরা ও হরিণ শিকার১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

হায়াতখালী টহল ফাঁড়িটি কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর, খোড়লকাঠি, হায়াতখালী ও তেঁতুলতলা গ্রামের পাশেই অবস্থিত। সুন্দরবনসংলগ্ন এসব গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, লোকালয়ের পাশে ছোট নদী পেরোলেই গহিন জঙ্গল। হরিণশিকারিরা জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার জালের সঙ্গে ফাঁদ তৈরির দড়ি বনে নিয়ে যায়। তারপর বনে বসে হরিণ ধরার ফাঁদ তৈরি করে।

আরও পড়ুনসুন্দরবনের দৃষ্টিনন্দন চিত্রা হরিণ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

হরিণ শিকারের অভিযোগে কারাগারে থাকার পর সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পান কয়রার মহেশ্বরীপুর এলাকার এক শিকারি। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বনের যেখানে কেওড়াগাছ বেশি, সেখানে হরিণ বেশি থাকে। ওই এলাকায় শিকারিরা ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) ইমরান আহমেদ বলেন, বন্য প্রাণী হত্যা ও পাচার রোধে শিকারিদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। হরিণের ক্ষেত্রে বনের ভেতরে অপরাধ উদ্‌ঘাটনের তথ্য দেওয়ায় ২০ হাজার এবং বনের বাইরে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।

আরও পড়ুনসুন্দরবনের যে ফলটি হরিণ-বানরের প্রিয়, কাজে লাগে মানুষেরও১২ জুলাই ২০২৪.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ন দরবন র আরও প

এছাড়াও পড়ুন:

সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’

পূর্ব সুন্দরবনের নিসর্গঘেরা অভয়ারণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র ‘আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার’। সবুজ ম্যানগ্রোভ বনের বুক চিরে, নদীর নোনাজলে ভেসে, প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্যে ঘেরা এই কেন্দ্রটি চলতি নভেম্বর মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা।

পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন আলী বান্দা এরইমধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কেড়েছে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে ট্রলারযোগে মাত্র ৪০ মিনিটের নৌপথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে। 

যাত্রাপথে চোখে পড়ে বনের গভীর সবুজ গাছগাছালি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া পাখি, কচুরিপানায় ঢাকা জলাশয় এবং সুন্দরী-গেওয়া গাছের সারি যা পর্যটকদের মোহিত করে।

বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের সমান উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে সুন্দরবনের বিস্তৃত সবুজাভ দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে। 

রয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ফুট ট্রেইল (ওয়াকওয়ে)। পথের দুই পাশে ঘন বনের মাঝে হাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতির আসল রূপ। এছাড়া রয়েছে মিষ্টি পানির পুকুর, হরিণ রাখার সেড, জেটি, বিশ্রামাগার, সুভেনিয়ার শপ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় বনরক্ষী ও স্থানীয় গাইডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আলীবান্দা বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজগম্য স্পট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কম সময় ও কম ঝুঁকিতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে এখানে। স্থানীয় পর্যটকরা এরইমধ্যে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন বলেন, “আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে স্থানীয় গাইড, নৌযানচালক, হোটেল ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়বে।”

তবে পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ ফি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আলীবান্দায় প্রবেশের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৫ টাকা।

শরণখোলা ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল বয়াতী বলেন, ‘‘আলীবান্দায় প্রবেশ ফি ৩৪৫ টাকা, অথচ একই বনের করমজল পর্যটন পয়েন্টে ফি মাত্র ৪৬ টাকা। অনেকেই আলীবান্দায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু ফি বেশি হওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’’

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “আলীবান্দা এখন প্রায় প্রস্তুত। চলতি মাসেই এখানে হরিণ আনা হবে। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্পটটি। যেহেতু এটি ২০১৭ সালে ঘোষণা করা অভয়ারণ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত, তাই সাধারণ বনাঞ্চলের তুলনায় কিছু বিধিনিষেধ ও প্রবেশ ফি বেশি রাখা হয়েছে। তবে পর্যটকদের দাবির বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে জানাব।’’

ঢাকা/শহিদুল/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’
  • সুন্দরবনের বড় গেছো প্যাঁচা