সিনেমার জগতে গুণী নির্মাতাদের মায়েস্ত্রো হিসেবে দেখার একটা চল আছে। যাঁরা সিনেমা নিয়ে ভাবেন, এন্থুসিয়াস্ট, অনুরাগী অথবা কোনো একদিন কাজ করবেন বলে স্বপ্ন দেখে রেখেছেন, তাঁরাও এই মায়েস্ত্রোদের সম্মানজড়ানো দৃষ্টিতে দেখেন। এই চলচ্চিত্র নির্দেশকেরা কালের ধারাবাহিকতায় তাঁদের জন্য পথনির্দেশনার কাজটিও করতে থাকেন।

আর যাঁরা সরাসরি চলচ্চিত্র বানাতে শুরু করে দিয়েছেন, তাঁদের জন্য বোধ হয় সম্পর্কটা একটু মিশ্র অভিজ্ঞতার মতো। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, প্রতিযোগ ইত্যাদি নানান অনুভব। মূলত বলতে চাচ্ছি, এই যে মায়েস্ত্রো বা গুরু-ওস্তাদ ব্যক্তিরা, তাঁদের বৈশিষ্ট্য কী? কেন লোকে তাঁদের এইভাবে দেখতে পছন্দ করে? অনেকের ক্ষেত্রে অনেক কথা আসবে। তবে এই রচনায় উদ্দিষ্ট ব্যক্তি স্ট্যানলি কুবরিক, আমেরিকান গ্রেট ফিল্মমেকার।

কুবরিক ছিলেন জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নির্মাতা। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুলাই নিউইয়র্কে তাঁর জন্ম। পরিচালক হিসেবে তিনি ১৩টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তাঁর চলচ্চিত্র শুধু দর্শককে বিনোদিত করার মাধ্যম ছিল না; ছিল একটি শক্তিশালী ভাষা ও শিল্পমাধ্যম, যা মানুষের অন্তর্নিহিত অনুভূতি ও কল্পনা এবং অস্তিত্বের মৌলিক প্রশ্নগুলো তুলে ধরতে পারে। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোয় স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায় যে তিনি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে কাজগুলো করতেন। সিনেমায় ট্র্যাকিং শট, রিভার্স জুম ইত্যাদি কারিগরি বিষয় তো আছেই, মূল ব্যাপারটা আসলে তাঁর গল্পের বর্ণনা।

ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজে কে কোন গল্প কীভাবে বলছে, তা গুরুতর বিষয়। এ ক্ষেত্রে কুবরিক এমন নির্মাতা যিনি এই ভাষায় সিনট্যাক্স ধরে ধরে নির্মাণ করে গেছেন। তাঁর চলচ্চিত্র দৃশ্যের খেলা নয় কেবল। যাঁরা তাঁর ‘কিলারস কিস’(১৯৫৫) দেখেছেন, নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন, নিউইয়র্কের একটি পুতুল বানানোর গুদামঘরের সেই অংশ, দুজনের কী ভীষণ হিংসাত্মক লড়াই! শটগুলো যেভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে, শুধু দৃশ্যের ব্যাপার নয়, ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজে গল্পকে বর্ণনা করার অসাধারণ ক্ষমতাও টের পাওয়া যায় কুবরিকের নির্মিত দ্বিতীয় এই ফিচার ফিল্মে। আর তাঁর চলচ্চিত্রে যাঁরা অভিনয় করতেন, তাঁরা তো থাকতেন মহা মুশকিলে! 

কুবরিক একটা দৃশ্যের টেক অসংখ্যবার নিতে থাকতেন, এটা নিয়ে বলাবলি হতো। একবার এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে একই দৃশ্যের টেক বারবার নেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়।  উত্তরে কুবরিক বলছিলেন, ‘অভিনেতারা অনেক সময় অনিয়মে অভ্যস্ত থাকেন; শৃঙ্খলা মেনে চলেন না। এমনকি সংলাপও শিখে আসেন না। সংলাপ না শিখে তাঁরা তো অভিনয় করতে পারবেন না! আপনি সব সময় আবেগ দিয়ে অভিনয় করে ফেলতে পারেন না। এ ঘটনা প্রতিটি ছবিতেই ঘটে। তখন দেখা যায় যে একই দৃশ্যের জন্য হয়তো আমার ৩০ বার টেক নিতে হলো। তখন সেই ভদ্রলোক আমেরিকায় গিয়ে বলেন যে স্ট্যানলি খুবই পারফেকশনিস্ট, সে তো একই দৃশ্যের জন্য ১০০টা টেক নেয়। তো, এই যে দেখেন, ৩০ হয়ে গেল ১০০!’ এই রকম নিখুঁত কাজ করতেন কুবরিক। সহজে তাঁকে সন্তুষ্ট করা যেত না। 

আরও তিনটি দৃশ্যের কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিই। যাঁরা চলচ্চিত্রগুলো দেখেছেন, খুব সহজেই মিলিয়ে নিতে পারবেন। ‘আ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’(১৯৭১)-এ অ্যালেক্স ও তার গ্যাংয়ের সদস্যরা কোরোভা মিল্ক বারে বসে আছে, অ্যালেক্স দুধ খাচ্ছে। তারা প্রস্তুত হচ্ছে সেই ‘আল্ট্রাভায়োলেন্স’ ঘটানোর জন্য। এরপর ‘ব্যারি লিনডন’(১৯৭৫)-এ রেডমন্ড পিস্তল ডুয়েলে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। তার আগেই সে দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছে, ‘আমি দুঃখিত নই। আমি ক্ষমা প্রার্থনা করব না।’ অসীম সেই সাহসিকতা। অপর আরেকটি দৃশ্য ‘দ্য শাইনিং’(১৯৮০) থেকে। জ্যাক বিভীষিকাময় এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। অতঃপর বাথরুমের দরজা কুড়াল দিয়ে ভাঙছে আর তার স্ত্রী আতঙ্কে চিৎকার করছে। তখন ভাঙা দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে জ্যাক নিকোলসন বলে ওঠে, ‘এখানেই তো জনি!’ এসব দৃশ্য যুগের পর যুগ ধরে মানুষের মননে গেঁথে আছে। এ কি শুধুই দৃশ্যের শক্তি?

ফ্রেডরিখ নিৎশে, মার্টিন হাইডেগার, আলব্যের কামু, জঁ পল সার্ত্রে, সিমোন দ্য বোভোয়া—এদের মাধ্যমে যে একটি বিশ্বচিন্তা তৈরি হয়েছে, যা পরবর্তীকালে পপুলার কালচারেও বড় অর্থে প্রভাব বিস্তার করেছে, সেই তরঙ্গ, বলাই বাহুল্য স্ট্যানলি কুবরিকের সিনেফ্রেমকেও প্রভাবিত করে গেছে।

কুবরিক যে অর্থে গল্পগুলো চিত্রায়ণ করতেন, তাতে মানবপ্রকৃতির স্বরূপ ফুটে উঠত এবং তা হতে পারে মাঝেমধ্যে খুবই উদ্ভট। এসব বিখ্যাত চলচ্চিত্রের দিকে লক্ষ করলেই বোঝা যায় যে কুবরিকের বর্ণনার এই শৈলী ও কাঠামোর মধ্যে কিছু দার্শনিক ধারণাও কাজ করে। অনেকে পপকালচারে প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত সিনেমায় দার্শনিকতার ব্যাপারটা হয়তো সহজে নিতে পারেন না। তাঁরা বিকল্প ধারার কিছু কাজের ভেতর দার্শনিক অভীক্ষাগুলোর দেখা পেয়ে থাকেন। তবে কুবরিকের যে স্বজ্ঞা ও প্রজ্ঞা, তাঁদের জন্য বিষয়টা আবার খুব একটা সুবিধারও হবে না। বলছিলাম যে, সেই সব তো কেবলই দৃশ্যের শক্তি নয়। কুবরিকের ফ্রেমে যে মানবপ্রকৃতির অসংখ্য দিক খোলামেলাভাবে উঠে এসেছে, সেটা তাঁর বিস্তৃত দৃষ্টি ও দর্শনের কারণেই এমনভাবে দৃশ্যে উপস্থাপিত হয় এবং ভাষা পায়। 

কুবরিক প্রচণ্ড উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও খুঁতখুঁতে ধরনের মানুষ ছিলেন। উঁচু ও নিচুস্তরের সংস্কৃতি থেকে শুরু করে ভালোবাসা ও যৌনতা, ভয় ও আত্মজিজ্ঞাসা, ইতিহাস, যুদ্ধ, অপরাধ, পাগলামি, স্পেস, প্রযুক্তি ইত্যকার বৈচিত্র্যময় অঞ্চলে তিনি কাজ করে গেছেন। তাঁর কাজের ধারাবাহিকতা এই দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ করলে বোঝা যায়, কোনো একটা জটিল ও সমৃদ্ধ দার্শনিক প্রবণতা কুবরিকের মধ্যে কাজ করে, যেটাকে অস্তিত্ববাদও বলা যেতে পারে। 

ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে মানবপ্রকৃতি নিয়ে দার্শনিক প্রস্তাব এসেছে যে মানুষ একা এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্তা, তার ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পূর্ণরূপে কর্তা এই ব্যক্তি নিজেই—এই সব প্রস্তাব এই নির্মাতার ফ্রেমেও দেখতে পাওয়া যায়। ফ্রেডরিখ নিৎশে, মার্টিন হাইডেগার, আলব্যের কামু, জঁ পল সার্ত্রে, সিমোন দ্য বোভোয়া—এদের মাধ্যমে যে একটি বিশ্বচিন্তা তৈরি হয়েছে, যা পরবর্তীকালে পপুলার কালচারেও বড় অর্থে প্রভাব বিস্তার করেছে, সেই তরঙ্গ, বলাই বাহুল্য স্ট্যানলি কুবরিকের সিনেফ্রেমকেও প্রভাবিত করে গেছে। আর তিনি নিজ হাতে নতুনভাবে তাঁর অস্তিত্ববাদী অনুমান ও বিশ্বচিন্তার গড়ন দিয়েছেন তাঁর চলচ্চিত্রগুলোয়। 

‘প্যাথস অব গ্লোরি’ (১৯৫৭) তাঁর অন্য চলচ্চিত্রগুলোর মতো অতটা বিখ্যাত নয়। যুদ্ধের সিনেমা হিসেবে ‘ফুল মেটাল জ্যাকেট’ (১৯৮৭ খ্রি.

) যতটা দর্শকনন্দিত, এই চলচ্চিত্র সেই অনুপাতে কম মনোযোগ পেয়েছে। তবে এটা তাঁর খুবই গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ, নান্দনিকভাবেও। যুদ্ধবিরোধী সিনেমার ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে অনেকেই এ চলচ্চিত্রকে বিবেচনা করে থাকেন। তবে ‘পাথস অব গ্লোরি’ যতটা যুদ্ধবিরোধী সিনেমা, তার চেয়ে বেশি এটা আসলে যুদ্ধের ভয়াবহতায় মানবচরিত্রের বিদ্‌ঘুটেপনাকে প্রকাশ করে। কুবরিক চলচ্চিত্রে এই স্বাধীন মানবচরিত্রের সত্তাকে অন্বেষণ করে গেছেন গল্পের বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে। সেই সব চরিত্র যেসব অবস্থায় ও পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং আচরণ করে, তা খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দর্শককে অস্তিত্বগত জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করায়।

‘প্যাথস অব গ্লোরি’ (১৯৫৭) চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র চলচ চ ত র ক বর ক র র জন য ক জ কর করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

টিভিতে আজকের খেলা

ক্রিকেট
এশিয়া কাপ
আফগানিস্তান-শ্রীলঙ্কা
সরাসরি, রাত ৮টা ৩০ মিনিট;
টি-স্পোর্টস।

ফুটবল
উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ

কোপেনহেগেন-লেভারকুসেন
সরাসরি, রাত ১০টা ৪৫ মিনিট;
টেন ২।

আরো পড়ুন:

টিভিতে আজকের খেলা

টিভিতে আজকের খেলা

ক্লাব ব্রুজ-মোনাকো
সরাসরি, রাত ১০টা ৪৫ মিনিট;
সনি লিভ।

নিউক্যাসল-বার্সেলোনা
সরাসরি, রাত ১টা;
টেন ২।

ম্যানচেস্টার সিটি-নাপোলি;
সরাসরি, রাত ১টা;
টেন ১।

ফ্রাংকফুর্ট-গালাতাসারেই
সরাসরি, রাত ১টা;
টেন ৫।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ