এভাবে অসম্মানিত হয়ে ভারতের কোনো উপরাষ্ট্রপতিকে বিদায় নিতে হয়নি। জগদীপ ধনখড়ের আগে দুজন উপরাষ্ট্রপতিপদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। ভি ভি গিরি, ১৯৬৯ সালে এবং ১৯৮৭ সালে রামস্বামী ভেঙ্কটরামন। দুজনেই পদত্যাগ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হবেন বলে। দুজনেই জিতেছিলেন। জগদীপ ধনখড় পদত্যাগ করলেন, কারণ, তাঁকে সেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সম্পর্ক এতটাই বিষিয়ে গিয়েছিল যে, এই প্রথম কোনো উপরাষ্ট্রপতির আনুষ্ঠানিক বিদায় সংবর্ধনার আয়োজনটুকুও হলো না! নীরবে চলে যেতে হলো তাঁকে।

এই অপসারণ আরো একবার প্রমান করল, নরেন্দ্র মোদির শাসনকালে ভারতের সাংবিধানিক পদ ও প্রতিষ্ঠান কীভাবে স্বকীয়তা হারিয়ে আজ্ঞাবহ ও অনুগত হয়েছে। ভয়ে অথবা ভক্তিতে। উপরাষ্ট্রপতি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। সেই পদাসীনের এভাবে অসম্মানিত অপসারণ আরো ভয়ংকরভাবে এই বার্তা ছড়িয়ে দিল যে, ‘কর্তার’ রোষানলে পড়লে কারো রেহাই নেই।

জগদীপ ধনখড় পদত্যাগপত্রে ভগ্নস্বাস্থ্যের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্য ও প্রশ্নাতীত নয়। ২১ জুলাই, রাত নটায়, আগে থেকে না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে তিনি দ্রৌপদী মুর্মুর হাতে পদত্যাগপত্র তুলে দেন। অথচ সেদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তাঁর জয়পুর সফর সূচি জানানো হয়। সেদিন সকালেই সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরু হয়।

আরও পড়ুনভারত বলছে মোদিই ভারত নয়০৯ জুন ২০২৫

বেলা এগারোটায় তিনি রাজ্যসভা পরিচালনা শুরু করেন। সাড়ে বারোটায় সভার আলোচ্যসূচি স্থির করার কমিটির (বিএসি) বৈঠকে উপস্থিত হন। একটার সময় সেই বৈঠক স্থগিত হয়, ঠিক হয় বিকেল সাড়ে চারটেয় আবার বিএসির বৈঠক বসবে। সাড়ে চারটের বৈঠকে ‘কিছু না জানিয়ে’ অনুপস্থিত থাকেন রাজ্যসভার নেতা জেপি নাড্ডা ও সংসদীয়মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। তার আধ ঘন্টা পর বিচারপতি যশবন্ত ভার্মার অপসারণের (ইমপিচমেন্ট) জন্য বিরোধীদের আনা প্রস্তাব ধনখড় গ্রহণ করেন ও তা কার্যকর করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।

সারাটা দিন শরীর খারাপের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তা হলে? সোমবার বেলা একটা থেকে সন্ধ্যার মধ্যে এমন কিছু ঘটে যা বাধ্য করে উপরাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে। সেই সময়েই তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ইস্তফা না দিলে শাসকেরাই তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনবে।

সেটাই ছিল উপরাষ্ট্রপতির কফিনের শেষ পেরেক। মাত্র ছয় মাস আগে, গত ডিসেম্বরে, তিতিবিরক্ত বিরোধীরা ধনখড়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। পদ্ধতিগত ত্রুটি দেখিয়ে রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান হরিবংশ নারায়ণ সিং তা খারিজ করেন। ধনখড় বুঝেছিলেন, সরকারপক্ষ অনাস্থা প্রস্তাব আনলে তা খারিজ হবে না। কাজেই সরে যাওয়া মঙ্গল। অজুহাত ভগ্নস্বাস্থ্য।

নরেন্দ্র মোদি ও জগদীপ ধনখড়.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: উপর ষ ট রপত র ষ ট রপত প রস ত ব পদত য গ

এছাড়াও পড়ুন:

নীতি সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ, কী প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে

অবশেষে সুদের হার কমিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের পর এই প্রথম সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে দুর্বলতার লক্ষণ, আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব, কর্মঘণ্টা কমে যাওয়া ও নতুন চাকরি সৃষ্টির গতি কমে যাওয়ায় ফেড এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে ৪ থেকে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়ার পর ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেন, অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে সুদহার আরও কমতে পারে। তিনি বলেন, শ্রমবাজারের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা এখন তাঁর ও সহকর্মী নীতিনির্ধারকদের প্রধান উদ্বেগ। খবর রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই ব্যাপক হারে সুদ কমানোর দাবি তুলছিলেন। তাঁর বক্তব্য, এতে অর্থনীতি চাঙা হবে। তবে ফেডের এ সিদ্ধান্ত তাঁর প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ফেডের পর্ষদে নতুন গভর্নর স্টিফেন মিরান ছিলেন একমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী। তিনি ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট হারে সুদহার কমানোর পক্ষে ছিলেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও বড় কাটছাঁটের ইঙ্গিত দিয়েছেন।

সুদের হার নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্ন সব সময়ই তোলা হয়। ট্রাম্প সম্প্রতি ফেডের এক গভর্নর লিসা কুককে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও কুক আদালতের লড়াইয়ে আপাতত নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন এবং বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান মিরানকে ফেডের পর্ষদে বসান।

শ্রমবাজারে দুর্বলতা

পাওয়েল বলেন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে, তরুণেরা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছেন। সামগ্রিকভাবে চাকরি সৃষ্টির গতি খুবই কম। শ্রমবাজারকে আর দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।

পাওয়েল আরও সতর্ক করেন, নতুন চাকরির সংখ্যা এখন বেকারত্বের হার স্থিতিশীল রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে সামান্য ছাঁটাইও বেকারত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে।

মূল্যস্ফীতি বনাম কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি এখনো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতির হার ৩ শতাংশে উঠবে, যেখানে ফেডের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ শতাংশ। কিন্তু ফেড মনে করছে, কর্মসংস্থানের ঝুঁকি এখন বেশি গুরুত্ব পাওয়ার মতো বিষয়।

ফেডের নতুন পূর্বাভাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়িয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ করা হতে পারে বলা হয়েছে। বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশেই স্থির থাকবে বলে তারা অনুমান করছে।

রাজনৈতিক টানাপোড়েন

এ সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক নাটকও কম ছিল না। ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা থাকলেও ফেডের পর্ষদের অন্য দুই ট্রাম্প-মনোনীত গভর্নর মিশেল বোম্যান ও ক্রিস্টোফার ওয়ালার শেষ পর্যন্ত মূল সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়েছেন। ওয়ালার বরাবরই শ্রমবাজারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে আসছেন।

পাওয়েল অবশ্য পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির মূল বিষয় হলো তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত। আজকের বৈঠকে সুদহার ব্যাপক হারে কমানোর বিষয়ে বিপুল সমর্থন ছিল না।’

বাজারের প্রতিক্রিয়া

সুদহার কমানোর ঘোষণার পর ওয়াল স্ট্রিটে প্রথমে শেয়ারের দাম বাড়লেও পরে ওঠানামা করে। শেষমেশ মিশ্র পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন শেষ হয়। ডলার কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে ঠিক, কিন্তু ট্রেজারি বন্ডের সুদ প্রায় অপরিবর্তিত। বাজার এখন প্রায় নিশ্চিত, অক্টোবরের বৈঠকেও সুদ কমানো হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, ফেডের সাম্প্রতিক নীতি পরিবর্তনের মানে হলো তারা এখন ধীরে ধীরে ‘নিরপক্ষে’ অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সাময়িকভাবে কিছুটা বাড়লেও ২০২৬ সালের মধ্যে স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নীতিসুদ কী

কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহারে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দেয়, সেটাই নীতি সুদহার। ইংরেজিতে একে বলে রেপো রেট। রেপোর বাংলা হচ্ছে পুনঃক্রয় চুক্তি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এটি পরিচিত। অর্থনীতিতে নগদ তারল্যের জোগান দিতে বা অন্যভাবে বলতে গেলে ব্যাংকগুলোর জরুরি প্রয়োজনে অর্থ সরবরাহ করতে মুদ্রানীতির এ হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ হাতিয়ার ব্যবহার করে।

কোভিডের পর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তখন ফেডারেল রিজার্ভ বাজারে মুদ্রার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে দফায় দফায় নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। ফলে নীতি সুদহার গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২৫ থেকে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহারের প্রভাব

বিশ্ব অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিসুদের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। ফেডের নীতিসুদের হার বাড়লে ট্রেজারি বন্ডের দাম কমে এবং সুদহার কমলে ট্রেজারি বন্ডের দাম বাড়ে। এর কারণ হলো বাজারে নতুন ও অধিক সুদের বন্ড আসার পর পুরোনো বন্ডের কুপন (সুদ) কম মনে হয়, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম কমে যায়। আবার যখন সুদের হার কমে, তখন নতুন বন্ডের কুপন কম হওয়ায় পুরোনো বন্ডের উচ্চ কুপনযুক্ত সুদ বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম বেড়ে যায়।

নীতিসুদ কমলেও একই প্রক্রিয়া ঘটে, তবে বিপরীতভাবে। সুদের হার কমলে নতুন বন্ডের কুপনও কমে যায়। এতে আগের উচ্চ সুদের কুপনযুক্ত বন্ডগুলো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিনিয়োগকারীরা এই পুরোনো বন্ডগুলো কিনতে আগ্রহী হন, ফলে সেগুলোর দাম বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা তখন তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ বাজারেও বিনিয়োগ আগ্রহী হন। এতে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়ে এবং ডলারের চাপ কিছুটা কমে।

সে কারণে বাজার নীতি সুদহারের দিকে তাকিয়ে থাকে, সুদ কমলে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ