রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার কিশোরগঞ্জ ইউনিয়নের এক কিশোরের বিরুদ্ধে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে কটূক্তির অভিযোগে সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে সন্ত্রাসী হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। হামলার মুখে অনেকে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, যদিও পরে তাঁরা ফিরতে শুরু করেছেন।

যে কিশোরের বিরুদ্ধে মহানবী (সা.

)–কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ এসেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তার বিরুদ্ধে সাইবার সুরক্ষা আইনে মামলা করা হয়েছে এবং আদালতের মাধ্যমে সম্মিলিত শিশু পুনর্বাসনকেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। এই আইনি ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই বিষয়টি শেষ হতে পারত; কিন্তু সেটা হয়নি।

অতীতে একই ধরনের গুজব ছড়িয়ে রামু, নাসিরনগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পরে প্রমাণিত হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ধর্ম অবমাননার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত ছিলেন না। রংপুরের কিশোরের ক্ষেত্রে কী হয়েছে, তা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে আশা করি। কারও মুঠোফোনে কোনো ছবি বা বার্তা পেলেই ধরে নেওয়া যায় না, তিনি সেটা করেছেন।

গঙ্গাচড়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর সংঘবদ্ধ আক্রমণ ও ১৫টি বসতঘরে হামলা–ভাঙচুরের ঘটনা উদ্বেগজনক ও নিন্দনীয়। প্রথম আলোর প্রতিনিধি সরেজমিন দেখেন, হামলার শিকার পরিবারগুলোর ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড। আতঙ্কে পরিবারগুলো গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি এবং অন্য মালামাল ভ্যানে করে সরিয়ে নিচ্ছে। অনেকে গরু, ছাগল ও ধান বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। আলদাদপুর নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ও ভেতরে অবস্থান করছে সেনাবাহিনী। কাছাকাছি খিলালগঞ্জ বাজারেও পুলিশ ও সেনাসদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য অনুযায়ী, শনিবার রাত আটটার দিকে কিশোরকে থানায় নেওয়ার পর তার বিচারের দাবিতে উত্তেজিত জনতা মিছিল নিয়ে তার বাড়ির সামনে যায়। রাত ১০টার দিকে দ্বিতীয় আরেকটি মিছিল এসে তার এক স্বজনের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। রোববারও আরেক দফা হামলার ঘটনা ঘটে।

এই উত্তেজিত জনতা কারা? এর পেছনে কারা ইন্ধন জোগাচ্ছে? স্থানীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকজন বলেছেন, তাঁদের এলাকার কেউ এই হামলা চালাননি। পাশ্ব৴বর্তী নীলফামারী জেলা থেকে আসা লোকজন এ হামলা করেছেন। পাশের জেলা থেকে লোকজন এসে হামলা করলেন আর স্থানীয় লোকজন নীরব দর্শকের মতো তা দেখে গেলেন, কোনো প্রতিবাদ করলেন না, এটা কেমন কথা? হামলার বিষয়ে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের দুই নেতা প্রথম আলোর কাছে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা দায় এড়ানোর চেষ্টামাত্র। তাঁরা পুলিশের অক্ষমতার কথা বলেছেন। কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় স্থানীয় নেতা–কর্মী কিংবা নাগরিক সমাজের দায় অস্বীকার করবেন কীভাবে?

থানা–পুলিশ গ্রামের পরিবেশ শান্ত হয়ে আসছে দাবি করলেও আলদাদপুর নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ আছে এবং সেখানে সেনাসদস্যদের ক্যাম্প বসানো হয়েছে। বিদ্যালয়ের ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সনাতন ধর্মাবলম্বী। সরকারের পক্ষ থেকে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ঘরবাড়ি মেরামতের জন্য কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু তাঁদের নিরাপত্তার কী হবে? একই দেশের নাগরিক হয়ে এক সম্প্রদায়ের মানুষকে পাহারা দিয়ে রাখতে হবে কেন? এটা দেশের জন্য তো বটেই, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জন্যও লজ্জাজনক। এই লজ্জা কাটানোর উপায় হলো গঙ্গাচড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা ও লুটকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা প্রতিরোধে সরকারকে তৎপর ভূমিকা নিতে হবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য সরক র র ঘটন ল কজন

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচনে জোট গঠনে সতর্ক থাকার পরামর্শ হেফাজত আমিরের

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোট গঠনের ক্ষেত্রে সঙ্গে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী।

মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেছেন, আগামী নির্বাচনে এমন কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার চিন্তা করা যাবে না, যাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস সম্পর্কে বুজুর্গানে দ্বীন ও পূর্বপুরুষেরা আগেই সতর্ক করেছেন।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘জাতীয় উলামা মাশায়েখ সম্মেলন ২০২৫’–এ লিখিত বক্তব্যে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী এ কথা বলেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের উদ্যোগে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন হেফাজত আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও অসুস্থ থাকায় তিনি কথা বলেননি। তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা তোফাজ্জল হক আজিজ।

ইসলামের মূলধারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে দলগুলোকে অনুরোধ জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে হেফাজত আমির বলেন, সহিহ আকিদার সব ইসলামি দলকে এক হওয়ার জন্য আগেও তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো তেমন পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, একদিকে যেমন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্র চলছে, অন্যদিকে তেমনি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বহু রকম চক্রান্ত লক্ষ করা যাচ্ছে। গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তা তিনি কল্পনাও করেননি।

অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্দেশ করে বাবুনগরী বলেন, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপনের চুক্তি দেশের স্বাধীনতার অখণ্ডতার জন্য এবং ধর্মীয় কৃষ্টির জন্য এক অশনিসংকেত। এ চুক্তির তীব্র নিন্দা জানিয়ে তা বাতিল করার দাবিও জানান তিনি।

সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা খলিল আহমদ কুরাইশী। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, সামনে কালো তুফান দেখা যাচ্ছে। কালো তুফানের সঙ্গে মোলাকাত নয়, মোকাবিলা করতে হবে। জনগণকে ওলামাদের নেতৃত্ব কবুল করতে হবে। তখনই তুফানকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, যারা ফ্যাসিবাদী আমলে পাখা দিয়ে নৌকাকে বাতাস করেছে, তাদের সঙ্গে কোনো ঐক্য হবে না। জুলাই আন্দোলন ছিল ভোটের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য। সামনে নির্বাচন। সেই নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। সেই পাঁয়তারা রুখে দিতে হবে।

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ইসলামের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আলেমদের মতামত উপেক্ষা করলে হাসিনার মতো পরিণতি হবে।

সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক। এ সময় আরও বক্তব্য দেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আলেম এবং ওলামারা।

১৫ দফা প্রস্তাবনা

সম্মেলনে জমিয়তে উলামায়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১৫ দফা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়। প্রস্তাবনা পাঠ করেন সংগঠনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া।

১৫ দফার মধ্যে আছে—ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় স্থাপনের চুক্তি বাতিল করা, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল করা, ঘোষিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা; নির্বাচনে কালোটাকা ও পেশিশক্তির মহড়া বন্ধ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা; বিতর্কিত নারী কমিশনের সুপারিশ বাতিল ও শরিয়ার সীমারেখার আলোকে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ