নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর দলটির নেতা-কর্মীদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ আরও প্রকট হয়েছে। ঘোষিত কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করে এরই মধ্যে বিএনপির দুটি পক্ষ দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। তবে কমিটিকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দমিছিল করেছে দলের একটি পক্ষ।
কমিটি প্রত্যাখ্যান করে কর্মসূচি পালন করা নেতা-কর্মীদের দাবি, ১৬ বছর ধরে রাজপথে থেকে যাঁরা হামলা-মামলার স্বীকার হয়েছেন তাঁদের গুরুত্ব না দিয়ে হঠাৎ স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া এক নেতার অনুসারীদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এদিকে কমিটি প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভ মিছিল করার অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়েছে উপজেলা কমিটিতে সদ্য পদ পাওয়া দুই নেতাকে।
৮ সেপ্টেম্বর রাতে সেনবাগ উপজেলা ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে জেলা বিএনপি। দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেনবাগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মফিজুর রহমান এবং সৌদি আরব বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল মান্নানের অনুসারী তিনটি পক্ষ সক্রিয় রয়েছে। সদ্য ঘোষিত কমিটিতে আবদুল মান্নানের অনুসারীরা বেশি পদ পেয়েছেন। তাই কমিটি নিয়ে সন্তুষ্ট তাঁরা। তবে তুলনামূলক কম পদ পাওয়ায় কাজী মফিজুর রহমানের অনুসারী পক্ষটি কমিটি প্রত্যাখ্যান করে কর্মসূচি পালন করে আসছে। জয়নুল আবদিন ফারুকের অনুসারীদের মধ্যে পদ পাওয়াদের একটি অংশ কমিটির পক্ষে থাকলেও পদবঞ্চিতরা কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
উপজেলা বিএনপির ঘোষিত কমিটির আহ্বায়ক করা হয় মোক্তার হোসেন পাটোয়ারীকে। তিনি জয়নুল আবদিন ফারুকের অনুসারী। ৫৮ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব করা হয় আবদুল মান্নানের অনুসারী আনোয়ার হোসেনকে। ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় জাহাঙ্গীর হাসান চৌধুরীকে। তিনি কাজী মফিজুর রহমানের অনুসারী।
অনেক যাচাই-বাছাই করে কমিটি দিয়েছি। কে কার অনুসারী—সেটা বিচার না করে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং যোগ্য ব্যক্তিদের নামই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেইমাহবুব আলমগীর, আহ্বায়ক, জেলা বিএনপিপৌর বিএনপির আহ্বায়ক করা হয়েছে ভিপি মফিজুল ইসলামকে। তিনি সৌদি আরব বিএনপির নেতা মান্নানের অনুসারী। ৩৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সদস্যসচিব করা হয়েছে শহীদ উল্যাকে। আর ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে ফারুক বাবুলকে। তাঁরা দুজনই বিএনপি নেতা জয়নুল আবদিন ফারুকের অনুসারী।
কমিটি নিয়ে বিরোধের মধ্যেই উপজেলা শাখায় সদ্য পদ পাওয়া দুজনকে সম্প্রতি বহিষ্কার করা হয়। তাঁরা হলেন—যুগ্ম আহ্বায়ক গোলাম হোসেন খোন্দকার ও সদস্য দলিলুর রহমান। তবে দলিলুর রহমানকে কোনো ধরনের কর্মসূচিতে অংশ না নেওয়ার পরও বহিষ্কারের অভিযোগ উঠেছে। দুজনই কাজী মফিজুর রহমানের অনুসারী।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দুই কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা ৯৭। এর মধ্যে কাজী মফিজের অনুসারীরা স্থানীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকলেও পদ পেয়েছেন মাত্র ২১টি। পদ পাওয়া ৭৬ জনই জয়নুল আবদিন ফারুক ও আবদুল মান্নানের অনুসারী।
জানতে চাইলে কমিটি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন কাজী মফিজুর রহমান। তিনি বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতি করছেন। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও। বিগত ১৬ বছরে বিএনপিতে তাঁর অনুসারীরা জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। তিনি নিজেও মামলার আসামি হয়েছেন মাঠে রাজনীতি করতে গিয়ে। কিন্তু আহ্বায়ক কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে তাঁর অনুসারীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। তিনি জেলা কমিটির কাছে বিষয়টি জানিয়েছেন।
কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করে কর্মসূচি পালন করেছেন জয়নুল আবদিন ফারুকের অনুসারীদের একাংশ।
যার কারণে তাঁর অনুসারী দুজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন—উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল হান্নান ও পৌর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক বাবুল।
কমিটির বিপক্ষে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে অংশ নেওয়া নেতা-কর্মীরা, জেলার বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে পদ–পদবি দেওয়ার অভিযোগ তোলেন। কর্মসূচিতে জেলা বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন স্লোগান দেন তাঁরা।
পৌর বিএনপিতে আহ্বায়ক পদ পাওয়া মফিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কাজী মফিজুর রহমানের অনুসারী ছিলেন। এখন আবদুল মান্নানের অনুসারী। কমিটি নিয়ে তাঁর কোনো আপত্তি নেই, তিনি কাঙ্ক্ষিত মূল্যায়ন পেয়েছেন। তাঁর বর্তমান লক্ষ্য হলো সব পক্ষকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ বিএনপি গড়ে তোলা।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মাহবুব আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, অনেক যাচাই-বাছাই করে কমিটি দিয়েছি। কে কার অনুসারী—সেটা বিচার না করে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং যোগ্য ব্যক্তিদের নামই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। এরপরও যাঁরা দলীয় শৃঙ্খলাপরিপন্থী কাজ করবে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র অন স র দ র ব এনপ র ন ত র ব এনপ র প র ব এনপ কর ম দ র র জন ত ই কম ট কম ট ত কম ট র ক কম ট সদস য উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
রিয়াজ-শিবলীকে পুঁজিবাজারে আজীবন নিষিদ্ধসহ কঠোর সুপারিশ
পুঁজিবাজারে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটে তালিকাভুক্ত কোয়েস্ট বিডিসির (সাবেক পদ্মা প্রিন্টার্স অ্যান্ড কালার) কার্যক্রম পরিচালনায় অনিয়ম, দুর্নীতি ও আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গঠিত অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি।
এ কারণে কোয়েস্ট বিডিসির পরিচালক, এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলাম এবং সাবেক বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে পুঁজিবাজার সংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে কমিটি। পাশাপাশি এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ লিমিটেডের নিবন্ধন বাতিলসহ বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) প্রেরণের সুপারিশ করা হয়েছে।
অভিযুক্তদের বড় অঙ্কের অর্থদণ্ড (ন্যূনতম ১ কোটি টাকা জারিমানা), ফৌজদারি মামলা দায়ের এবং এলআর গ্লোবালের অধীনে থাকা মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর ট্রাস্টি বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডকে ফরেনসিক অডিট সম্পন্ন করে ফান্ডের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ারও সুপারিশ করেছে অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর ১২টি কোম্পানির অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতি অনুসন্ধানে বিএসইসির গঠিত ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’র প্রতিবেদনে এ সব সুপারিশ উল্লেখ করা হয়েছে। অনুসন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে রাইজিংবিডি ডটকমের হাতে এমন তথ্য এসেছে।
অভিযোগ রয়েছে বিগত সরকারের আমলে আইন বা বিধি-বিধান লঙ্ঘন করা মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী কোয়েস্ট বিডিসির পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বেশি দামে মালিকানার শেয়ার কেনা, ছয় ফান্ড থেকে নিজেসহ এলআর গ্লোবালের কর্মকর্তাদের পরিচালক পদে বসানো, যোগসাজোশ করে সম্পদের ভ্যালুয়েশন তৈরি, অবৈধভাবে তহবিলের ব্যবহার, পরিশোধিত মূলধন বাড়ানো, অনুমোদনবিহীন ব্যবসা পরিচালনা করা, সিকিউরিটিজ অইন লঙ্ঘন, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করার মতো গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। একইসঙ্গে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ তুলেছে তদন্ত কমিটি।
উল্লেখ্য বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক বন্ড আল ইসতানিয়া ও আইএফআইসি গ্যারান্টেড শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রীন জিরো ক্যুপন বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে অনিয়ম, প্রভাব খাটানো, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দায়িত্বশীল আচরণ না করার অভিযোগে শিবলী রুবাইয়াতকে আগেই পুঁজিবাজারে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বিএসইসি।
‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ মনে করে, রিয়াজ ইসলামের নেতৃত্বে ফান্ডের অপব্যবহার ও বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয়েছে। ফান্ডগুলোর নিবন্ধন বাতিল করে বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরতের জন্য লিকুইডেশন করতে হবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অর্থদণ্ড আরোপ করা জরুরি। বিএসইসি যথাযথ কঠোর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়মের পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলেও তদন্ত কমিটি মনে করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বিএসইসির গঠিত অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি ১২টি বিষয়ের উপর তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে উল্লিখিত সুপারিশের আলোকে সার্বিক দিক বিবেচনা করে কিছু বিষয়ে অভিযুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আরো অনেক বিষয় কমিশন পর্যবেক্ষণ করছে। শিগগিরই সেসব বিষয়ের উপর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
রিয়াজ ও শিবলীর যোগসাজোশ
তদন্ত কমিটির ভাষ্য অনুযায়ী ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান ও রিয়াজ ইসলামের যোগসাজোশে এলআর গ্লোবালের ছয় মিউচুয়াল ফান্ডের টাকায় পদ্মা প্রিন্টার্সের ৫১ শতাংশ শেয়ার কিনে নেওয়া হয়। উদ্যোক্তা-পরিচালকের প্রায় সব শেয়ার উচ্চ দরে প্রতিটি ২৮৯.৪৮ টাকা করে কেনা হয়। এরপর ছয় মিউচুয়াল ফান্ড থেকে নিজেসহ এলআর গ্লোবালের ছয় কর্মকর্তাকে পরিচালক পদে বসানো হয়। অধ্যাপক শিবলী রুবায়েত-উল-ইসলাম পাদ্মা প্রিন্টার্সের মূল স্পন্সর শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার বিক্রির জন্য প্ররোচিত করেছেন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সে সময় পাদ্মা প্রিন্টার্সের শেয়ার ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে হস্তান্তরের অনুমোদন প্রদানের পুরো প্রক্রিয়াটি অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি মনে করে।
অন্যদিকে এলআর গ্লোবালের ব্যবস্থাপনায় থাকা মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোকে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানি ও সিকিউরিটিজে সন্দেহজনক বিনিয়োগের মাধ্যমে অপব্যবহার করেছে, যা ফান্ডগুলোর মূলধনের ক্ষতি আরও বৃদ্ধি করেছে। রিয়াজ ইসলামের নেতৃত্বে এলআর গ্লোবাল মিউচুয়াল ফান্ডের তহবিলের সঙ্গে দুর্নীতি ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। এ কারণে শিবলী ও রিয়াজকে পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত বিষয়ে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
দুদকের অভিযোগ প্রেরণ
এই অসাধু কার্যকলাপ থেকে অবৈধ অর্থ লেনদেন, দুর্নীতি এবং মানি লন্ডারিংয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়। যে কারণে কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং এলআর গ্লোবালের সিআইওর বিরুদ্ধে প্রমাণিত অভিযোগ দুদকে পাঠিয়ে বিস্তারিত তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
অনুমোদনহীন পরিচালক নিযুক্ত ও অযোগ্য ঘোষণা
যেসব ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতিনিধি পরিচালক দাবি করে কোয়েস্ট বিডিসির বোর্ডে ছিলেন বা পদত্যাগ করেছেন বলে দাবি করেছেন, তাদের প্রত্যেককে ন্যূনতম ২০ লাখ টাকা করে জরিমানা করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। কোম্পানিটির পরিচালনায় সকল পরিচালক, যারা পদ্মা প্রিন্টার্স থেকে রূপান্তরের পর দায়িত্বে ছিলেন (মনোনীত হোক বা স্বাধীন বা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে হোক) তাদের স্থায়ীভাবে কোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানির পর্ষদে পরিচালক বা স্বাধীন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণে অযোগ্য ঘোষণার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
অবৈধ মূলধন বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ প্রত্যাহার
কোয়েস্ট বিডিসি ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই বোর্ড রেজ্যুলেশন দিয়ে মূলধন ১.৬০ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকায় বৃদ্ধি করেছে, যা ইজিএম ছাড়া সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি। ওই বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থিত কোয়েস্ট বিডিসির পর্ষদ সদস্যদের (রিয়াজ ইসলাম, রেজাউর রহমান সোহাগ, শরীফ আহসান, মিসেস মদিনা আলী ও সৈয়দ কামরুল হুদা) বিরুদ্ধে পুঁজিবাজার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ফৌজদারি মামলা দায়ের করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া এলআর গ্লোবাল মিউচুয়াল ফান্ডের তহবিল ব্যবহার করে মূলধন বৃদ্ধি করেছে, যা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী। এ কারণে এলআর গ্লোবালের নিবন্ধন বাতিল করার মাধ্যমে শাস্তি প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ছাড়াও কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেডকে থাইরোকেয়ার বাংলাদেশ লিমিটেডে তাদের বিনিয়োগ অবিলম্বে বিক্রি করার নির্দেশ দেবে বিএসইসি। একইসঙ্গে মিউচুয়াল ফান্ড ব্যতীত থাইরোকেয়ারের পূর্ববর্তী স্পনসর এবং পরিচালকদের পূর্ববর্তী লেনদেন/স্থানান্তরের ক্রয়/বিক্রয় মূল্যে কোয়েস্ট বিডিসি থেকে শেয়ার কিনে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
বিধিবহির্ভূত বিনিয়োগ ও অবৈধ কার্যক্রম
এলআর গ্লোবাল তাদের ব্যবস্থাপনার অধীনে থাকা মিউচুয়াল ফান্ড সন্দেহজনকভাবে অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে অপব্যবহার করতে পারে। ফলে ফান্ডগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত মূলধনের অবনতি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তদন্ত কমিটি। এই গুরুতর অনিয়মের জন্য এলআর গ্লোবালের সম্পদ ব্যবস্থাপকের নিবন্ধন বাতিলসহ কোয়েস্ট বিডিসির সব পরিচালক ও কর্মকর্তা এবং পরামর্শদাতা প্রত্যেককে আইনের একই ধারা অনুযায়ী ন্যূনতম ১ কোটি টাকার অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত কোম্পানি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও ডিজিটাল মার্কেটিং সেবা প্রদান করেছে। উচ্চ আদালতের অনুমোদন ছাড়া এ কার্যক্রম সম্পূর্ণ অবৈধ।
বোর্ড মিটিং মিনিটস জালিয়াতি
রেজাউর রহমান সোহাগ ২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর সভার কার্যবিবরণী জাল করে নিজের পদত্যাগ অনুমোদিত হয়েছে বলে মিথ্যা কাগজ তৈরি ও দাখিল করেছেন বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা গেছে। সিকিউরিটিজ অর্ডিন্যান্সের ধারা ১৮ অনুযায়ী এটি দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুসন্ধান কমিটি সুপারিশ করেছে তাকে অন্তত ২৫ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
বিএসইসির কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতা
বিএসইসির এসআরএমআইসি এবং ক্যাপিটাল ইস্যু বিভাগের কর্মকর্তারা কোয়েস্ট বিডিসির প্রয়োজনীয় শর্ত না মানার পরও অনুমোদন দিয়েছেন। ওই কর্মকর্তাদের ন্যূনতম কঠোর শাস্তি আরোপের জন্য কমিটি সুপারিশ করেছে।
ইউনিট হোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষার্থে ব্যর্থতা
মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর ইউনিটহোল্ডারদের দীর্ঘমেয়াদি এবং চূড়ান্ত স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে এলআর গ্লোবাল। ফান্ডের আর্থিক অবস্থার এরূপ অবনতি ঘটেছে, তা বিনিয়োগকারীগণের স্বার্থের অনুকূলে নয়। তাই ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের নিবন্ধন সনদ বাতিল করে তা লিকুইডেট করে ইউনিট হোল্ডারদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
নিরীক্ষক ও ভ্যালুয়ার উদাসীনতা
শফিক বসাক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস কোয়েস্ট বিডিসির ২০২৩ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক বিবরণী নিরীক্ষায় যথাযথ সতর্কতা ও পেশাদারিত্ব দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। কোম্পানিটি মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন পরিবর্তনে হাইকোর্টের অনুমোদন পাওয়ার আগেই সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও ডিজিটাল মার্কেটিং সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, যা বেআইনি ছিল। তাই শফিক বাসাক অ্যান্ড কোং-কে তিন বছরের জন্য লিস্টেড কোম্পানি অডিট থেকে নিষিদ্ধ করাসহ ন্যূনতম ১০ লাখ টাকা জরিমানা আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে।
কোম্পানিটির ভ্যালুয়ার হিসেবে দায়িত্বরত মার্চেন্ট ব্যাংক সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্সেস লিমিটেড ভ্যালুয়েশনে সুস্থ বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করেনি। আর মূল্যায়নের উদ্দেশ্য এবং এর সম্ভাব্য অপব্যবহার সম্পর্কে উদাসীন ছিল, যা একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত। তাই সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্সেস লিমিটেডকে কমিশনের পক্ষ থেকে কঠোর শাস্তি প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে।
ফরেনসিক অডিট
বিএসইসি কর্তৃক এলআর গ্লোবালের অধীনে থাকা মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর ট্রাস্টি বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডকে (বিজিআইসি) নির্দেশ দেওয়া উচিত যে, যাতে তারা অবিলম্বে উক্ত ফান্ডগুলোর (এনসিসিবিএল মিউচ্যুয়াল ফান্ড-১, এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান, এআইবিএল ১ম ইসলামিক মিউচ্যুয়াল ফান্ড, এমবিএল ১ম মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ডিবিএইচ ১ম মিউচ্যুয়াল ফান্ড এবং গ্রিন ডেল্টা মিউচ্যুয়াল ফান্ড) সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করবে এবং বর্তমান আর্থিক অবস্থা নির্ধারণে ফরেনসিক হিসাব নিরীক্ষা পরিচালনা করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোয়েস্ট বিডিসির চেয়ারম্যান ও এলআর গ্লোবালের উপদেষ্টা রেজাউর রহমান সোহাগ রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “আমি একজন অনরারি চেয়ারম্যান। আমার কোনো শেয়ার নেই, আমি শেয়ারহোল্ডার নই। আমি এ কোম্পানিতে থেকে পরামর্শক হিসেবে শুধু বেতন পাই। এর বাহিরে আমার কোনো ইনভলভমেন্ট নেই। কি অনিয়ম হয়েছে বা কি হয়নি তা বিস্তারিত বলতে পারবেন, যারা সরাসরি কোম্পানি পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। আর যে অভিযোগের কথা বললেন, সে বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।”
ঢাকা/এনটি/তারা