গণপিটুনি ও সংঘবদ্ধ বিচারবহির্ভূত আক্রমণের সামাজিক বিশ্লেষণে সাধারণত আমরা দুই ধরনের প্রবণতা দেখতে পাই। এক, কোনো অপরাধের প্রতিক্রিয়া। যেমন চুরি, ডাকাতি, আক্রমণ, খুন– এসবের পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থিত জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ। উদাহরণস্বরূপ সাতকানিয়ায় নিহত ২: পিটুনির আগে গুলি ছোড়া হয় থানা থেকে লুট হওয়া পিস্তল দিয়ে। এর কারণ আগের একটি লেখায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। গণপিটুনি প্রতিরোধে প্রয়োজন বিচারহীনতার অবসান (সমকাল, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। দুই, কোনো মতবাদ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামনে রেখে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা ‘ভিন্ন পরিচয়ের’ মানুষদের (যেমন নারী, অন্য ধর্ম, বর্ণ, জাতিসত্তা, মতাদর্শ ইত্যাদি) আক্রমণ করা (পঞ্চগড়ে আহমদিয়াদের বাড়িঘর ও দোকানে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ; তারাগঞ্জে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধের ডাকের পর প্রশাসনের ১৪৪ ধারা জারি)। এসব কাজ বেশির ভাগ সময় করা হয় ‘তৌহিদি জনতা’র নামে। এই ‘তৌহিদি জনতা’ বিষয়টি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এই নামে কোনো সংগঠন না থাকলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় (কয়েক দশক ধরে) কিছু মানুষ যারা দৃশ্যত ‘ধার্মিক’ মুসলমান অথবা মোল্লা শ্রেণির এবং মূলত পুরুষ, তারা সংঘবদ্ধভাবে কোনো কিছুর সহিংস ‘প্রতিবাদ’  জানায়; তার বিরোধিতা অথবা তাকে আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু সাধারণত ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু’, ভিন্ন জাতিসত্তা, নারী বা সমাজের প্রবল মতাদর্শ থেকে ভিন্ন ‘অন্য’ ধরনের মানুষ।

বিগত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা থেকে এটা স্পষ্ট– ‘তৌহিদি জনতা’ কোনো স্বতঃস্ফূর্ত জনতা নয়, বরং সংগঠিত শক্তি। তারা খুব অল্প সময়ে সংগঠিত হয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আক্রমণ করতে পারে, যা সাংগঠনিক কাঠামো ছাড়া সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ এত অল্প সময়ে সংগঠিত হতে ও একই লক্ষ্যে কাজ করতে পারে না। তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হলো তথাকথিত ‘ইসলাম ধর্ম অবমাননাকারী’, যারা সাধারণত অন্য ধর্মের অনুসারী। কখনও মহানবী, কখনও কোরআন, কখনও খোদ ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করার অভিযোগ করা হয়; যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ঘটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই স্থানীয় ধর্মীয় ‘সংখ্যালঘুদের’ ওপর আক্রমণ করা হয় (সুনামগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় চারজন গ্রেপ্তার; বৌদ্ধমন্দিরে হামলা)। এদের আক্রমণের আরেকটি লক্ষ্য হলো নারী ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। গণআন্দোলনে স্বৈরাচারী হাসিনার পলায়নের পর থেকে দেখা যাচ্ছে, একটি বিশেষ গোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতাবান ভাবতে শুরু করেছে এবং ক্রমবর্ধমান হারে জনসমাগমস্থলে নারীদের হেনস্তা করছে। তাদের খেলাধুলাসহ নানা কর্মকাণ্ডে বাধা দিচ্ছে; একই সঙ্গে ধর্মীয় ‘সংখ্যালঘুদের’ ওপর আক্রমণ করছে (টাঙ্গাইলে ফুলের দোকানে ‘তৌহিদি জনতা’র ভাঙচুরের পর আতঙ্কে ঘুড়ি উৎসব বন্ধ, ‘ব্যবসায়ী ও তৌহিদি জনতা’র বাধা, শোরুম উদ্বোধন করতে পারেননি মেহজাবীন; রামপালে যাত্রাপালা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ’, বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা)।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, ‘তৌহিদি জনতা’ আপাতদৃষ্টিতে একটি নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থান থেকে এসব কাজ করে মনে হলেও সমাজের জন্য ক্ষতিকর ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, প্রকাশ্যে নারীদের হয়রানি করা, যৌন নিপীড়ন– এসব বিষয়ে তাদের কখনও কিছু বলতে বা করতে শোনা যায় না। অথচ ইসলামে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ফরজ বা অবশ্য করণীয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রশাসনের চাপে পড়ে তাদের প্রতিরোধ প্রত্যাহার করে (তারাগঞ্জে বাধার মুখে বন্ধ হওয়া নারী ফুটবল দলের খেলা অনুষ্ঠিত)। মনে হয়, তাদের সব প্রতাপ শুধু অসহায়, দুর্বল মানুষদের জন্য। এ থেকে অনুমেয়, এই ‘তৌহিদি জনতা’র কর্মকাণ্ড যতটা না ধর্মীয় ও নৈতিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ, এর পেছনে রয়েছে ধর্মভিত্তিক দল ও মসজিদ-মাদ্রাসাকেন্দ্রিক একটি গোষ্ঠী, যারা নিজেদের রাজনৈতিক ও কায়েমি গোষ্ঠীস্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে। এসব ঘটনায় তাদের নেতাকর্মীর সম্পৃক্ততা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর দ্বারাও সমর্থিত। 
অন্যদিকে আমরা রাষ্ট্র ও প্রশাসনের দিক থেকে দেখতে পাই, ধর্ম অবমাননা বা এ ধরনের কোনো অভিযোগ উঠলেই তারা কোনো তদন্ত, পর্যালোচনা ছাড়াই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা করে; তাকে গ্রেপ্তার করে, যা আইনগতভাবে সিদ্ধ নয় এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। একে বলা যায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। পক্ষান্তরে সংঘবদ্ধ জনতার বিচারবহির্ভূত আক্রমণ ও ক্ষতিসাধনের (এমনকি হত্যা) সময় রাষ্ট্র ও প্রশাসন কার্যকর প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয় না। এমনকি মামলা হলেও কোনো শাস্তি হয় না। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার যে অভাব আছে– তা না বললেও চলে। ফলে এসব স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আরও উৎসাহিত হয়, নিজেদের ক্ষমতাবান ভাবে এবং তাদের অপকর্ম চলতেই থাকে। 

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হেনস্তা করলে পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে। রাতারাতি এক দল লোক থানায় গিয়ে তাকে মুক্ত করার চেষ্টা করে এবং ওই ছাত্রীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ্যে কুরুচিপূর্ণ বার্তা পাঠায়, যা যৌন নিপীড়নের শামিল এবং নারী নির্যাতন ও ডিজিটাল সুরক্ষা আইনে দণ্ডনীয়; কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ওই ‘জনতা’ সারারাত থানায় অবস্থান করে। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবির সভাপতিসহ কয়েকজন গিয়ে তাদের সঙ্গে ‘মধ্যস্থতা’ করে। পরে ছাত্রীটি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করে এবং নিপীড়নকারী অর্ণবের জামিনে তার আপত্তি নেই মর্মে জানায়। পরদিন আদালত নিপীড়নকারীকে জামিন দিলে ওই ‘তৌহিদি জনতা’ তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ ও উল্লাস করে (ছাত্রীকে হেনস্তায় যুবক গ্রেপ্তার, মধ্যরাতে থানায় হট্টগোল, দুপুরে জামিন)। আমরা এটা আশা করতেই পারতাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সংগঠন একত্রে ওই ছাত্রীকে সমর্থন ও সহযোগিতা করবে এবং ওই উচ্ছৃঙ্খল ‘জনতা’কে প্রতিহত করবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। এমনকি অতিনন্দিত ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতা’দেরও কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্থানে এমন ঘটনা ঘটার ফলে শুধু ওই ছাত্রী নয়, বরং দেশের সব নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নিরুৎসাহিত হবে আর নিপীড়নকারীরা উজ্জীবিত হবে, যা আমাদের নারী অধিকার অবক্ষয়ের একটি সুস্পষ্ট লক্ষণ (নারীবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড বাড়ছে, থামাতে সরকারের উদ্যোগ নেই: বাম জোট)। এটি যেমন বর্তমান সরকার ও প্রশাসনের জন্য একটি লজ্জাজনক ব্যর্থতা, তেমনি নব্য আবির্ভূত নেতাদের ‘নতুন’ বাংলাদেশ গড়ার সক্ষমতার ওপরেও বড় ধরনের প্রশ্ন ওঠায়।  

এসব প্রতিরোধে যেমন আইনের কঠোর প্রয়োগ ও অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। যেহেতু পরিকল্পিত সংঘবদ্ধ আক্রমণের পেছনে সংগঠিত সামাজিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠী জড়িত থাকে, তাই তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করাও জরুরি। আমাদের একটি জাতীয় ঐকমত্যে আসতে হবে– এ ধরনের কর্মকাণ্ডে মদদ দেওয়া রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলোকে অন্যরা বয়কট করবে, আর জনগণের মাঝেও সচেতনতা তৈরি করতে হবে যেন তারা এ ধরনের দল বা গোষ্ঠীকে সমর্থন না করে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং গণপ্রত্যাখ্যানই পারে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে। 

আবু আলা মাহমুদুল হাসান: গবেষক, লেখক ও নৃবিজ্ঞানী

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: মব জ স ট স র জন ত ক স ঘবদ ধ এ ধরন র ব যবস র একট

এছাড়াও পড়ুন:

জকসুতে এআই ব্যবহারে থাকবে শিথিলতা, তবে অপব্যবহার করা যাবে না: নির্বাচন কমিশন

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচনে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহারে শিথিলতা থাকবে। তবে এর অপব্যবহার করা যাবে না বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সদস্য জুলফিকার মাহমুদ।

রোববার উপাচার্যের সভাকক্ষে রাজনৈতিক ও সক্রিয় সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত জকসু ও হল সংসদ নির্বাচন-২০২৫-এর আচরণবিধিবিষয়ক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।

ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক ফয়সাল মুরাদের এক দাবির জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। এর আগে ফয়সাল মুরাদ বলেন, ‘নির্বাচনী আচরণবিধির ৭–এর ঘ ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করা যাবে না। আমরা যারা ছোট সংগঠন, আমাদের তহবিল সীমিত। আমরা নির্বাচনী প্রচারের জন্য এআই ব্যবহার করে দু-এক মিনিটের ভিডিও বানিয়ে প্রচার কার্যক্রম চালাতে চাই। আমাদের দাবি, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন যেন শিথিল নীতি গ্রহণ করে।’

মুরাদ আরও বলেন, বিগত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কিছু ত্রুটি লক্ষ করা গেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচনকে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও বিতর্কমুক্ত রাখার জন্য যতগুলো ভোটকক্ষ থাকবে, সব কটি সিসিটিভি ফুটেজের আওতায় রাখতে হবে। সবার জন্য সেই সিসিটিভি ফুটেজ উন্মুক্ত রাখতে হবে। ভোট গ্রহণকে স্বচ্ছ রাখার জন্য ভোটকক্ষের ভেতরে জাতীয় গণমাধ্যমকে সরাসরি সম্প্রচার করার অনুমতি দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জকসুর নির্বাচন কমিশনার জুলফিকার মাহমুদ বলেন, ‘এআই ব্যবহার করে বিভিন্নজনের চরিত্র হনন করা হয়, অপপ্রচার চালানো হয়। সেদিক থেকে চিন্তা করে এআই ব্যবহার নিষিদ্ধ রেখেছিলাম। তোমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এআই ব্যবহারে শিথিলতা থাকবে প্রচার–প্রসারে, তবে অপব্যবহার করা যাবে না। আর সরাসরি সম্প্রচারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আলোচনা করে।’

প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোস্তফা হাসানের সভাপতিত্বে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য রেজাউল করিম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ ও হল শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচন ২০২৫–এর নির্বাচন কমিশনার ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ