পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচের ঢাকা সফরের খবরটি পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমের চেয়েও ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। হয়তো তার কারণও আছে। বৈঠকটি এমন সময়ে হলো, যখন অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, ট্রান্সশিপমেন্ট, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, সীমান্তে হত্যাসহ নানা বিষয়ে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নেয়, সে বিষয়ে নয়াদিল্লির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকাটাই স্বাভাবিক। আরেকটি কারণ হতে পারে, ভারত ও পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্কের কারণে সার্ক মৃতপ্রায়। ঢাকা ও ইসলামাবাদ সার্কের পুনরুজ্জীবন চায়। কয়েক বছর আগে এক ভারতীয় কূটনীতিক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সার্ক মৃত হলেও দাফন করার দরকার নেই। যেকোনো সময় পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। 

আরও পড়ুনইউনূস-মোদি বৈঠকের ফলাফল কী০৯ এপ্রিল ২০২৫

১৫ বছর পর এবার বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে বৈঠক হলো। এর আগে বৈঠক হয়েছিল ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে। এরপর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হলে উচ্চপর্যায়ে কূটনৈতিক যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। বৃহস্পতিবারের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, যার সঙ্গে আমাদের ইতিহাসের গৌরব ও বেদনা দুটোই জড়িত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে। 

প্রথম আলোয় দুই পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকের শিরোনাম ছিল: ‘৭১-এ গণহত্যার জন্য ক্ষমাসহ ৩ সমস্যার সমাধান চায় ঢাকা।’ খবরে বলা হয়, একাত্তরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যার অভিযোগে দেশটির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়াসহ অমীমাংসিত তিনটি বিষয়ের সুরাহা চেয়েছে ঢাকা। অপর দুটি সমস্যা হলো পাকিস্তানের কাছে ৪ দশমিক ৩২ বিলিয়ন বা ৪৩২ কোটি ডলার পাওনা পরিশোধ ও এখানে আটকে পড়া ৩ লাখ ২৫ হাজার পাকিস্তানিকে ফেরত নেওয়া। এ ছাড়া ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের ঘূর্ণিদুর্গত মানুষের জন্য আসা ২০ কোটি ডলার বিদেশি সহায়তাও ফেরত দেওয়ার প্রসঙ্গও তুলেছে ঢাকা।

স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের তথ্য বলছে, চলতি মাসের ৪ তারিখে পাকিস্তানের রিজার্ভ ছিল ১৫ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৫৭৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের দাবি মেটাতে হলে পাকিস্তানকে তাদের রিজার্ভের এক-চতুর্থাংশের বেশি ব্যয় করতে হবে।

অনেকে ভেবেছিলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তান যখন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী, তখন বাংলাদেশ ৫৪ বছর আগের প্রসঙ্গ না–ও তুলতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার বোধ হয় কিছুটা পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কিন্তু এই বৈঠকের মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশের অবস্থানের কথা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে।

এর আগেও বিভিন্ন বৈঠকে ক্ষমা পাওয়া ও দেনা–পাওনার বিষয়টি উঠলেও পাকিস্তান বরাবর এড়িয়ে গেছে।  ১৯৭৪ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে বঙ্গবন্ধু দেনা–পাওনা উত্থাপন করলে তিনি দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘আমি ব্ল্যাঙ্ক চেক নিয়ে আসিনি।’ বৈঠক ওখানেই শেষ।  ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইবে না কেন?

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব জসিম উদ্দিন বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো উত্থাপন করেছি। এ বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন এবং অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদান ও ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য প্রেরিত বিদেশি সাহায্যের অর্থ হস্তান্তর।’

পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ঢাকায় এসে আমি খুশি। আলোচনা খুব চমৎকার হয়েছে।’ আলোচনা চমৎকার হয়েছে বলা হলেও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র  মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বাংলাদেশের দাবি সম্পর্কে কোনো কথা নেই। সেখানে শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের কথা বলা হয়েছে। সচিব পর্যায়ের বৈঠকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফরসূচিও চূড়ান্ত হয়েছে। তিনি ২৭ ও ২৮ এপ্রিল ঢাকা সফর করবেন। 

গত বছরের ২ অক্টোবর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বৈঠকের প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর কৃতকর্মের জন্য দেশটি ক্ষমা চাইলে সম্পর্ক স্বাভাবিক করাটা সহজ হয়ে যাবে।

পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন–এর খবরে বলা হয়, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ভাঙন ধরার পর ঢাকার নেতারা বিশেষভাবে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতীয় শিবিরে অবস্থান করছিলেন এবং দিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলছিলেন এবং ইসলামাবাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। গত বছর আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পতন ও ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। 

ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকার টানাপোড়েন তৈরি হওয়ার কথাটি সত্য নয়। এটি হয়েছে মূলত যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতার কারণে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে পাকিস্তান বিরোধিতা করে। এমনকি সেখানকার পার্লামেন্টেও এর বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেওয়া হয়।

পাকিস্তানি পত্রিকায় যেমন পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকদের মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি ভারতের গণমাধ্যমেও ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন রয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস–এর খবরে বলা হয়, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো উত্থাপন করে এবং একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি আরও উল্লেখ করে, একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে খাটো করে দেখছে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার।

পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ একাত্তরের গণহত্যা ও পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলায় ভারত খুশি হয়েছে। সেখানকার সংবাদমাধ্যম একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কথাও ফলাও করে প্রচার করেছে। 

কিন্তু কোনো দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক তো কারও খুশি বা বেজার হওয়ার ওপর নির্ভর করে না। এটা নির্ধারিত হয় সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় স্বার্থের নিরিখে। যেদিন পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাইতে বলেছে, সেদিনই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের ‘পূর্ণ নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়। মুর্শিদাবাদের ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশকে জড়ানোর খবরেরও প্রতিবাদ জানায় অন্তর্বর্তী সরকার।

গত বছর আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ভারত ক্রমাগত বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিগ্রহের অভিযোগ জানিয়ে আসছিল। এমনকি ব্যাংককে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বিষয়টি তুলে ধরেন। 

কোনো দেশেই সংখ্যালঘু নিগ্রহ কাম্য নয়। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব যেমন আমাদের সরকার ও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের, তেমনি ভারতের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বও সেই দেশটির সরকার ও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের। এটা নিয়ে একে অপরের প্রতি আঙুল তোলার চেয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত বলে মনে করি।  

অনেকে ভেবেছিলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তান যখন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী, তখন বাংলাদেশ ৫৪ বছর আগের প্রসঙ্গ না–ও তুলতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার বোধ হয় কিছুটা পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কিন্তু এই বৈঠকের মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশের অবস্থানের কথা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে।

এটা অন্তর্বর্তী সরকারের সাহসী ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন বলে মনে করি। এ বিষয়ে একজন সাবেক কূটনীতিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন,  ‘একাত্তরের সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সম্পর্ক। এখানে নমনীয় হওয়া বা ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।’

দুই দেশকে দুই বার্তা দিয়ে বাংলাদেশ প্রমাণ করল, ‘আমরাও পারি।’ 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র পরর ষ ট র য দ ধ পর ধ র প রসঙ গ র গণহত য ক টন ত ক সরক র ব উপদ ষ ট র খবর

এছাড়াও পড়ুন:

যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল

ইসরায়েল আবারও ইরানে বড় রকমের হামলা করেছে। হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। হামলা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও আবাসিক এলাকায়। একদিন পর পাল্টা হামলা চালায় ইরান। এতে কয়েকজন ইসরায়েলি নিহত হয়। ধ্বংস হয় তেলআবিবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

ইসরায়েল তার ইরানবিরোধী এ হামলার নাম দিয়েছে ‘রাইজিং লায়ন’। এ নাম রাখা হয়েছে হিব্রু বাইবেলের একটি চরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। যে নাম ইসরায়েলের একটি শক্তিশালী ও বিজয়দীপ্ত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয়।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার ইহুদিদের সবচেয়ে পবিত্র উপাসনাস্থল জেরুজালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়ালের একটি ফাটলে হাতে লেখা একটি চিরকুট রেখে আসার সময় ছবি তোলেন। এটি ছিল মূলত ইরানে ইসরায়েলের হামলার ইঙ্গিত।

শুক্রবার তার অফিস থেকে সেই চিরকুটে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। সেখানে লেখা ছিল: ‘জনগণ সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে।’

এই বাক্যাংশটি হিব্রু বাইবেলের গ্রন্থ বুক অব নাম্বারস (গণনা পুস্তক) ২৩:২৪ পদ থেকে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে: ‘দেখো, এই জাতি একটি মহান সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে এবং একটি তরুণ সিংহের মতো নিজেকে উদ্দীপ্ত করবে; সে শিকার না খাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না এবং নিহতদের রক্ত না পান করা পর্যন্ত থামবে না।’

এই চরণটি হিব্রু বাইবেলের অ-ইসরায়েলীয় একজন নবী ও ভবিষ্যদ্বক্তা বালামের প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীর অংশ। সেখানে তিনি ইসরায়েলের শক্তি ও ক্ষমতার কথা বলেন। তাদের এমন এক সিংহের সঙ্গে তুলনা করেন যে নিজের ক্ষুধা না মেটানো পর্যন্ত বিশ্রামে যায় না।

অনেকেই মনে করেন, এই অভিযানের নাম ইরানের শেষ শাহ-এর পুত্রের প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে। কারণ পারস্য রাজপরিবারের প্রতীক হিসেবেও সিংহ ব্যবহৃত হতো।

ইসরায়েলের ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি

ইসরায়েল প্রায়শই তার সামরিক অভিযানের নাম হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টেমেন্ট থেকে নেয় বা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থেকে গ্রহণ করে। ফিলিস্তিনি ভূমির উপর ইহুদিদের তথাকথিত ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে ইসরায়েল এসব ধর্মীয় বিষয় ব্যবহৃত করে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো এক অভিযানের নাম দিয়েছিল, ‘অ্যারো অব বাশান।’ ‘বাশান’ শব্দটি ইসরায়েলিদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি দিয়ে মূলত সিরিয়ার দক্ষিণ ও জর্ডান নদীর পূর্বে অবস্থিত একটি অঞ্চলকে নির্দেশ করা হয়। বাশানের রাজাকে পরাজিত করে ইসরায়েলিরা সেই অঞ্চলকে দখল করেছিল।

গাজা উপত্যকার ওপর হামলা চালাতেও অস্ত্র ও অভিযানের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় প্রতীক বা অনুষঙ্গ ব্যবহার করছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু অন্তত তিনবার গাজায় আক্রমণের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় আমালেক কাহিনি ব্যবহার করেছেন।

২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের গ্রন্থ ‘বুক অব ডিউটেরনমি’(২৫:১৭) এর থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:

‘আমালেক তোমার সঙ্গে যা করেছিল তা মনে রেখো, আমরা মনে রাখি এবং আমরা যুদ্ধ করি।’

এর মধ্য দিয়ে গাজাবাসীদের উপর পূর্ণাঙ্গ হামলা করা উচিত বলে নেতানিয়াহু ইঙ্গিত করেন। কারণ ডিউটেরনমির এই উদ্ধৃতি বাইবেলের স্যামুয়েল গ্রন্থে বর্ণিত আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংসের আহ্বান হিসেবে বিবেচিত হয়।

বাইবেলের এ কাহিনিতে ইসরায়েলিদের ওপর আক্রমণকারীদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। গাজার গোটা জনসংখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বাইবেলের এ কাহিনিকে হাজির করেছেন নেতানিয়াহু।

গণহত্যার মামলায় নেতানিয়াহুর বক্তব্য

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা গণহত্যার মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রথম শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষের আইনজীবী হিব্রু বাইবেলের উদ্ধৃতির মাধ্যমে নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে গাজার জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যায় প্ররোচনা হিসেবে তুলে ধরেন।

আইনজীবী আরও জানান, নেতানিয়াহু ৩ নভেম্বর সেনাদের উদ্দেশ্যে লেখা আরেকটি চিঠিতে একই আমালেকীয় গল্প পুনরাবৃত্তি করেন।

ধর্মীয় নাম ব্যবহার করে সামরিক প্রযুক্তি

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি গাজায় বোমাবর্ষণে সহায়তা করছে, তাদের নাম ‘ল্যাভেন্ডার’ এবং ‘দ্য গসপেল’, যা উভয়ই হিব্রু বাইবেলীয় ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।

টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক রাভালে মহিদিনের মতে, প্রায়ই ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রের নামকরণ করা হয়। যেমন, স্যামসন রিমোট কন্ট্রোলড ওয়েপন স্টেশন।

জেরিকো ব্যালিস্টিক মিসাইল-এর নাম রাখা হয়েছে জেরিকো শহরের নামে। হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব যশুয়া’ অনুসারে ইসরায়েলিরা এই শহর ফিলিস্তিনিদের কাছ দখল করেছিল।

ডেভিড’স স্লিং নামক আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার নাম রাখা হয়েছে বাইবেলের মেষপালক ডেভিড ও বিশাল যোদ্ধা গোলিয়াথের মধ্যকার বিখ্যাত সেই লড়াইয়ের স্মরণে, যেখানে ডেভিডের বিজয় হয়েছিল। এই কাহিনী আছে হিব্রু বাইবেল ও ওল্ট টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব স্যামুয়েল’-এ।

*দ্য নিউ আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক ও হার্ভার্ডের গবেষক রাভালে মহিদিনের একটি লেখার অবলম্বনে দ্য নিউ আরব এ বিশ্লেষণটি প্রকাশ করেছে। অনুবাদ করেছেন: রাফসান গালিব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, ভালো উদ্যোগ নিলেও বিরোধিতা আসে
  • যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল
  • তেহরানে ইসরায়েলের বিমান হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল