যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে শুল্ক-বিরোধের মধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবার দুই বৃহৎ মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। আইফোন ও কম্পিউটার নির্মাতা অ্যাপলকে ৫০০ মিলিয়ন ইউরো এবং ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটাকে ২০০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা করা হয়েছে।

বুধবার ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কমিশন জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠান দুটি ডিজিটাল মার্কেটস অ্যাক্ট (ডিএমএ) আইন লঙ্ঘন করেছে। ডিজিটাল আইন লঙ্ঘনের দায়ে এই দুই মেগা মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানির জরিমানার বিষয়ে ইইউর এই সিদ্ধান্ত ইউরোপের সংবাদমাধ্যমগুলোতে শিরোনাম হয়েছে।

এই প্রথমবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই আইনের আওতায় জরিমানা করল। ২০২২ সালে প্রণীত এই আইনে বড় ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোকে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্ল্যাটফর্মগুলোকে উন্মুক্ত রাখার বাধ্যবাধকতার বিষয়ে বলা হয়। এখন এই আইন লঙ্ঘনের জন্য ব্রাসেলস ১০ শতাংশ পর্যন্ত বার্ষিক আয়ের সমপরিমাণ জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বুধবার ঘোষিত জরিমানাগুলি সম্ভাব্য জরিমানা থেকে অনেক কম। কেন কম বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।

ডিজিটাল নীতির দায়িত্বে থাকা ইউরোপীয় কমিশনার তেরেসা রিবেরা ও হেন্না ভির্ককুনেন সিদ্ধান্তের বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে ব্যাখ্যা করেননি। সময়াভাবে তারা এই ঘোষণার সময় অনুপস্থিত ছিলেন বলে জানানো হয়। তবে ব্রাসেলসের বিশ্লেষকদের মতে, তারা ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এড়াতেই এমনটা করেছেন। ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ইইউর আইনগুলোকে ‘অন্যায্য’ বলে চিহ্নিত করেছেন।

কমিশনের একজন মুখপাত্র জানান, এই জরিমানার পেছনে কেবলমাত্র ইন্টারনেট-ভিত্তিক প্রতিযোগিতার সুরক্ষা এবং ইউরোপে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য করা হয়েছে। অ্যাপলকে তাদের অ্যাপ স্টোরে কঠোর নিয়মের কারণে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। মেটার অপরাধ তারা ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম অ্যাপের সাবস্ক্রিপশন মডেল চালু করে তথ্য সুরক্ষা ও ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতার বিধান লঙ্ঘন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের কুপারটিনোতে অবস্থিত অ্যাপলের সদর দপ্তর ঘোষণা করেছে যে তারা ইইউর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করবে। এই আইন ব্যবহারকারীদের তথ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ক্ষতি করে। মেটাও ইইউর এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেছে, ‘ ইইউ কমিশন মেটার ওপর বহু বিলিয়ন ইউরোর শুল্ক আরোপ করে আমাদের ব্যবসায়িক মডেল পরিবর্তন করতে বাধ্য করছে।’

অন্যদিকে ইইউর ভোক্তা ও সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞরা এই জরিমানাকে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছে। ভিডিও গেম ডেভেলপার এপিক গেমসের প্রধান টিম সুইনি এই সিদ্ধান্তকে ‘বিশ্বব্যাপী সফটওয়্যার ডেভেলপারদের জন্য সুসংবাদ’ বলে বর্ণনা করেছেন। এপিক গেমস তাদের অ্যাপ স্টোরের ব্যবসায়িক পদ্ধতির জন্য অ্যাপল ও গুগলের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কোম্পানিটি ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্রে আংশিকভাবে সফল হয়েছে, এখন ইইউতেও তাদের যুক্তির পক্ষে সমর্থন পেল।

ইউরোপীয় ভোক্তা সুরক্ষা সংগঠন বিউকের প্রধান অগাস্টিন রেইনাও এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে একমত। তিনি বলেন, ভোক্তাদের আরও পছন্দের অধিকার রয়েছে। ‘অ্যাপল ও মেটার কাছে ডিজিটাল মার্কেটস অ্যাক্ট মেনে চলার জন্য প্রচুর সময় ছিল, কিন্তু তারা তা করতে বিলম্ব করেছে। এ ছাড়া তাদের সুবিধার জন্য নিয়ম গুলিকে ভুল ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে।’

ইউরোপীয় পার্লামেন্টে সব রাজনৈতিক দলের সদস্যরা মার্কিন প্রযুক্তি করপোরেশনগুলির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট থেকে বলা হয়েছে, ‘যদি আমরা দৃঢ়ভাবে আমাদের আইন প্রয়োগ করি, তবেই আমরা ইউরোপের ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত করতে পারব।’ ইউরোপীয় সামাজিক গণতান্ত্রিক দলের অভ্যন্তরীণ বাজার নীতির মুখপাত্র ক্যাটরিনা বার্লি বলেন, ‘এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী ডিজিটাল করপোরেশনগুলোও আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’

জার্মানির টাজ পত্রিকাটি জানিয়েছে, এই জরিমানার সিদ্ধান্তের বিষয় এখন কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। অ্যাপল ও মেটা তাদের অভিযোগের মাধ্যমে জরিমানা পরিশোধ বিলম্বিত করতে পারে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি হস্তক্ষেপ করেন ও শুল্ক বিরোধের সঙ্গে ডিজিটাল মার্কেটস অ্যাক্ট আইনকে গুলিয়ে ফেলেন, তাহলে কী হবে? তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে। বিষয়টি হয়তো এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউও শুল্ক বিরোধের সমাধানের ওপর নির্ভর করবে। ট্রাম্প ইউরোপ থেকে অ্যালুমিনিয়াম, ইস্পাত ও গাড়ির ওপর আমদানি শুল্ক আরোপ করেছেন। তবে, ইইউ কমিশন আলোচনার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে গৃহীত পাল্টা ব্যবস্থা স্থগিত রেখেছে। যাতে করে ভবিষ্যতে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো আরও কঠিন না হয়ে পড়ে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এই স দ ধ ন ত ল য ন ইউর অ য পল ও ইউর প য এই আইন র জন য কর ছ ন ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

ইউনূস-তারেক সফল বৈঠকে স্বপ্নভঙ্গ হলো যাদের

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের বৈঠক দেশের রাজনীতির মোড়  অনেকটাই  ঘুরিয়ে দিয়েছে। নানা অনিশ্চয়তা, শঙ্কা, গুজব রাজনীতিকে ঘিরে ধরেছিল। একধরনের অনাস্থার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এ বৈঠক অনিশ্চয়তা, শঙ্কার কালো মেঘ সরিয়ে দিয়ে রাজনীতিতে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করবে বলে আশা করা যায়।

পারস্পরিক যে কাদা ছোড়াছুড়ি, দুর্নাম করার রাজনীতি, সেখান থেকে বেরিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ তৈরিতে সহায়তা করবে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক। নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির কিছুদিন ধরে টানাপোড়েন চললেও বৈঠকটি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে হয়েছে। এটা আমাদের রাজনীতিতে উদাহরণ হয়ে থাকবে।

বৈঠকটি সারা দেশের মানুষের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে। এখন মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। মানুষের ধারণাকে বাস্তবে রূপদান করার দায়িত্ব সরকারের।

বিএনপি এর আগে ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইলেও কিছুটা সরে এসে ফেব্রুয়ারির সময়সীমাকে মেনে নিয়েছে। সরকারও এপ্রিল থেকে সরে এসে নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হতে পারে বলে মন্তব্য করেছে। উভয় পক্ষেরই কিছুটা সরে আসা, কিছুটা ছাড় দেওয়া—এটাই আমাদের রাজনীতি থেকে একদম হারিয়ে গিয়েছিল।

রাজনীতি মানেই প্রতিপক্ষের সঙ্গে শত্রুতা করতে হবে, এমন পরিস্থিতিতে আমাদের রাজনীতি পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু শুধু কথায় কথায় উদার হলে হবে না। কাজে-কর্মেও উদারতা দেখাতে হবে। লন্ডনের বৈঠকে সেই উদারতার কিছু নমুনা আমরা দেখতে পেলাম।

আরও পড়ুনলন্ডনে ইউনূস-তারেকের আলোচনায় বিএনপিরই কি জিত১৩ জুন ২০২৫

বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে আলোচনার ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। তা নিয়ে আপাতত আলোচনার কিছু নেই। আমরা বরং রাজনীতিতে এ বৈঠকের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করি। প্রথমত, এ বৈঠক সারা দেশের মানুষকে আশান্বিত করলেও রাজনীতির কোনো কোনো পক্ষ বা ব্যক্তি হতাশ হয়েছেন।

এসব গোষ্ঠীর মূল কাজ যেন বিএনপিকে যে কোনোভাবে ঠেকানো। ব্যক্তি পর্যায়ে যারা হতাশ হয়েছেন তাদের মধ্যে  রাজনীতিবিদ ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা আছেন। তাঁদের মূল লক্ষ্যই ছিল, যেকোনো প্রকারে বিএনপির রাজনীতিকে প্রতিহত করা। এ অংশ চাইছে না বিএনপির রাজনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাক। বিএনপির নেতৃত্বে নতুন করে বাংলাদেশের বিনির্মাণ হোক।

কেউ যদি সহজ রাজনীতির পথ পরিহার করে অহেতুক কুটিল ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে, তবে তারা নিজেরাই রাজনীতি থেকে হারিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ ও জাসদ আমাদের সামনে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

বিএনপি যে শত ভাগ শুদ্ধ ও সঠিক রাজনীতি করছে, এটা বলা যাবে না। ভুল-ত্রুটি বিএনপিরও আছে। স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখল, হত্যাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। বিএনপি নিজ দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এই পর্যন্ত চার হাজারের মতো নেতা-কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে এসব কর্মকাণ্ডের জন্য। দেশের ইতিহাসে কোনো দল নিজেদের এতসংখ্যক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করেনি। এ ধরনের অপরাধ শুধু বিএনপির নেতা-কর্মীরাই করছেন না। বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরাও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এটা আমাদের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা লাগবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে। এটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের রাজনীতি এই অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাই রাজনৈতিক সরকার লাগবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। কারণ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

এ ধরনের পরিস্থিতি শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এর সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তিরও প্রয়োজন হয়। বিকল্প অর্থনৈতিক কর্মসূচিও লাগে। এ জন্যই বিএনপি বারবার নির্বাচনের কথা বলে আসছে। আমরা মনে করি, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সার্বিক অবস্থান উন্নতি ঘটবে। বিএনপির বিকল্প অর্থনৈতিক পরিকল্পনা আছে।

বৈঠক শেষে যৌথ ঘোষণা

সম্পর্কিত নিবন্ধ