সচিব নিয়োগে ‘মতামত’ প্রতিফলিত হয়নি, নাখোশ কর্মকর্তারা
Published: 27th, April 2025 GMT
রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা—এই দুই বিভাগে ভাগ হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। তবে রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, দুইটি বিভাগ করার বিষয়ে কর্মকর্তারা যে মতামত দিয়েছেন, তা খসড়ায় প্রতিফলিত হয়নি। বিশেষ করে রাজস্ব নীতি বিভাগে সচিব পদে নিয়োগের বিষয়ে মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
রোববার বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী মোস্তাফিজুর রহমান ও মহাসচিব একেএম নুরুল হুদা আজাদ সই করা বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়।
এতে বলা হয়, শনিবার এনবিআরের মাল্টিপারপাস হলে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশনের এক বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অ্যাসোসিয়েশনের বিপুলসংখ্যক সদস্য এবং সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও রাজস্ব কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাকাএভ) প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় কর-জিডিপি উন্নয়নে রাজস্ব প্রশাসন সংস্কারের ভূমিকা ও করণীয় বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এছাড়া গত ১৭ এপ্রিল উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে আলোচনা করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি বলেছে, আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস—এই দুইটি অ্যাসোসিয়েশন রাজস্ব নীতি বিভাগে সচিব পদে নিয়োগে মতামত দিয়েছেন, ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মরত কর্মকর্তাদের থেকে’ রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব নিয়োগ হবে। কিন্তু খসড়ায় সেই মতামত প্রতিফলিত হয়নি। এতে মাঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। রাজস্ব বিভাগে অভিজ্ঞদের থেকে চেয়ারম্যান (সচিব পদমর্যাদা) নিয়োগ না করে বাইরে থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হলে যে উদ্দেশ্যে এনবিআর দুই ভাগ হচ্ছে, তা ব্যাহত হবে। তাই অধ্যাদেশ জারির আগেই তা সংশোধন করতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শনিবারের সভায় কর-জিডিপির অনুপাতের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে অতিমূল্যায়িত জিডিপি, রাজস্ব প্রশাসনের শীর্ষ পদের রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব এবং কর-রাজস্ব আহরণে এ অঞ্চলের মধ্যে সর্বনিম্ন বিনিয়োগকে অন্যতম বাধা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। রাজস্ব আহরণে বিনিয়োগের সঙ্গে কর-জিডিপি অনুপাতের সরাসরি সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে এর উন্নয়নে অগ্রাধিকারভিত্তিক গুরুত্ব দেওয়ার অনুরোধ করা হয়।
রাজস্ব নীতি থেকে রাজস্ব বাস্তবায়ন আলাদা করাকে স্বাগত জানিয়েছে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন। তবে অ্যাসোসিয়েশন মনে করে রাজস্ব সংস্কার কেবল আলাদা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা সমীচীন নয়। বরং তা টেকসই করতে রাজস্ব ব্যবস্থার সামগ্রিক শক্তিশালীকরণ, যথাযথ বিনিয়োগ ও উন্নয়নের বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সরকার পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট রাজস্ব সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটি গঠন করে। বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন এবং বিসিএস (কর) অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে দুইবার তাদের মতামত তুলে ধরেছে। গত ১৩ এপ্রিল দুই সংগঠন সেই মতামত পুনর্ব্যক্ত করে যৌথভাবে অর্থ উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে।
কিন্তু ১৭ এপ্রিল উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশের খসড়ায় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুই সংগঠনের মতামত প্রতিফলিত হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাসোসিয়েশন সাতটি পর্যবেক্ষণ ও মতামত তুল ধরেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিসিএস (কর) অ্যাসোসিয়েশন ও বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মরত কর্মকর্তাদের থেকে’ রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব নিয়োগের মতামত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অধ্যাদেশের খসড়ার অনুচ্ছেদ ৪(৩) এ ‘উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন যে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে’ রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব বা সিনিয়র সচিব নিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়েছে। এতে রাজস্ব নীতি প্রণয়নে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
প্রসঙ্গত, রাজস্ব নীতি বিভাগ গঠনের মূল লক্ষ্য হলো- নীতি ও ব্যবস্থাপনা পৃথককরণের মাধ্যমে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিশেষায়িত বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে যুগোপযোগী, আধুনিক ও ব্যবসাবান্ধব রাজস্ব নীতি প্রণয়ন। রাজস্ব নীতি প্রণয়নে কর রাজস্ব আহরণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের থেকে রাজস্ব নীতি বিভাগের শীর্ষ পদে পদায়ন করা হলে রাজস্ব বিভাগকে আলাদা করার মূল উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক হবে।
রাজস্ব নীতি বিভাগের মৌলিক পদগুলো বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) এবং বিসিএস (কর) ক্যাডার থেকে পূরণের প্রস্তাব করা হলেও খসড়ার অনুচ্ছেদ ৪(৪)-এ আয়কর, কাস্টমস, ভ্যাট, অর্থনীতি, ব্যবসায় প্রশাসন, গবেষণা, পরিসংখ্যান, প্রশাসন, অডিট, আইন সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের থেকে পূরণের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। যেখানে নীতিসংক্রান্ত বিভিন্ন মৌলিক পদগুলোতে বর্তমানে দায়িত্বরত রাজস্ব আহরণ, ব্যবস্থাপনা ও নীতি প্রণয়নে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদেরকে রাজস্ব নীতি বিভাগে সুনির্দিষ্টভাবে পদায়নের সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে নীতিনির্ধারণী ও দায়িত্বশীল পর্যায়ে এই দুই ক্যাডারভুক্ত অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ প্রতিপাদ্য না হওয়ায় মাঠ অভিজ্ঞতা ও নীতির মধ্যে মারাত্মক ব্যবধান রয়ে যাবে; যা রাজস্ব সংস্কারের মূল লক্ষ্যকে ব্যাহত করবে। কর-রাজস্ব আহরণে নিয়োজিত কর্মকর্তারা দীর্ঘমেয়াদে ভ্যাট, আয়কর, কাস্টমস মূল্যায়ন, পণ্য শ্রেণিবিন্যাস, আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে কাজ করে দক্ষতা অর্জন করেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ ও নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া দীর্ঘদিন কাজ করেও নীতিনির্ধারণী পদে সুনির্দিষ্টভাবে সুযোগ না থাকলে হতাশাজনিত কারণে কর্মস্পৃহা কমে যাবে। পক্ষান্তরে উপযুক্ত মর্যাদা দিলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও প্রেরণার উন্নয়ন ঘটবে; যা সামগ্রিকভাবে রাজস্ব প্রশাসনকে বেগবান করবে।
অ্যাসোসিয়েশন বলছে, খসড়ার অনুচ্ছেদ ৯-এ রাজস্ব নীতি বিভাগে জনবল পদায়নের জন্য সুপারিশের লক্ষ্যে একটি কমিটির কথা উল্লেখ থাকলেও ধারা ৪(৪)-এ এমন কোনো কমিটির উল্লেখ নেই। এই কমিটির গঠন উল্লেখ করা প্রয়োজন। খসড়ার অনুচ্ছেদ ৫ এর দফা (চ)-এ রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধিতে ‘কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিস্থিতি পরিবীক্ষণ’ যুক্ত করা হয়েছে। এই পরিবীক্ষণের বিধান রাখায় নীতি বিভাগকে ব্যবস্থাপনা বিভাগের কার্যক্রম তদারকির সুযোগ থেকে যায়। এক বিভাগের কার্যক্রম সমমর্যাদাসম্পন্ন অন্য বিভাগের মাধ্যমে পরিবীক্ষণের বিধান রাখা হলে তা আইনের দৃষ্টিতে সাংঘর্ষিক। খসড়ার অনুচ্ছেদ ৭(৩)-এ ‘বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের থেকে রাজস্ব আহরণে ন্যূনতম ২০ বছরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাকে পালাক্রমে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সিনিয়র সচিব বা সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পরিবর্তে রাজস্ব আহরণে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব বা সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ এই পদে কর-রাজস্ব আহরণের বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নয়-এমন কর্মকর্তাদের প্রবেশাধিকার সৃষ্টি হতে পারে; যা কর-রাজস্ব আহরণে দীর্ঘদিনের অর্জিত বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ সীমিত করবে।
খসড়ার অনুচ্ছেদ ৭(৫)-এ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদগুলোতে প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বর্তমানে এনবিআরের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা পদস্থ রয়েছেন; যা তাদের নির্ধারিত পদ। কিন্তু খসড়ায় প্রশাসনিক পদগুলোতে এই দু্ই খাতের ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের থেকে পূরণের সুযোগ রাখা হয়নি। বিশেষায়িত দক্ষ জনবল সৃষ্টি, বিদ্যমান জনবলের ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্যারিয়ার প্লানিং ও পেশাগত স্বার্থরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক পদগুলোতে সংশ্লিষ্ট ক্যাডারভুক্ত জনবল দিয়ে পূরণ করা উচিত। এছাড়া রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদনটি জনসমক্ষে প্রকাশ করার আহ্বান জানান তারা।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এনব আর কর মকর ত দ র থ ক ন কর মকর ত দ র ত কর মকর ত দ র কর মকর ত র ক পদগ ল ত ও ব স এস য ক ত কর প রণয়ন উল ল খ কম ট র মত মত স গঠন খসড় য়
এছাড়াও পড়ুন:
আইন যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার
এটা অনস্বীকার্য যে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য আইন তৈরি করা হয়, অন্যভাবে বললে মানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই আইনই মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের সহযোগী উপাদান বা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে, বিশেষত আইন যখন এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়, যাতে অতিবিস্তৃত, অস্পষ্ট এবং অসংগতিপূর্ণ ধারা থাকে কিংবা আইনের দুর্বল এবং ‘সিলেকটিভ’ প্রয়োগ হয়; আইনকে ইচ্ছাকৃতভাবে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যা নির্বিচার আটকের ন্যায্যতা দেয়, মৌলিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং বৈষম্যমূলক চর্চাকে উৎসাহিত করে।
আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে সেসব দেশে, যেখানে আইনের শাসন ভঙ্গুর, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সীমিত এবং গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকে। বাংলাদেশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
২.
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন অধ্যায়, যেখানে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটে। সরকারি চাকরিতে অন্যায্য কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও তৎকালীন সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন এবং সহিংস আক্রমণের ফলে পরবর্তীকালে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। গণ-অভ্যুত্থানে সমাজের সব স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এবং একটি স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন হয়।
জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বিগত সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যা, সহিংসতা, নির্বিচার আটক ও নির্যাতনের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে জড়িত ছিল।
আন্দোলন চলাকালীন হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে নির্বিচার আটক করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে স্বীকৃত ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার এবং আটকের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া (ডিউ প্রসেস) অনুসরণের যে বিধান, তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গণগ্রেপ্তার অভিযানের সময় আটক হওয়া প্রায় ৮৫ শতাংশ ছিল শিক্ষার্থী এবং সাধারণ নাগরিক আর ১৫ শতাংশ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিল। হত্যা, নির্বিচার আটক এবং নির্যাতনের পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে মানুষের যোগাযোগের অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।
এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, আত্মরক্ষায় বলপ্রয়োগ কিংবা জনস্বার্থের মতো ‘অস্পষ্ট’ বিষয়ের কথা বলা হয়েছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিপীড়ন, হয়রানি ও নির্যাতনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এসব ক্ষেত্রে আইন সহযোগী উপাদান বা অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যেমন, কারফিউ জারি, প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বা দেখামাত্রই গুলির নির্দেশকে ন্যায্যতা দিতে জননিরাপত্তা এবং জনস্বার্থের মতো বিষয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে মূলত আইন রাষ্ট্রের দমনমূলক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে সহায়তা করেছে, যা মানবাধিকারের মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৩.
জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানেই নয়, বছরের পর বছর ধরে দেশের শাসনব্যবস্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হিসেবে আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন বিগত সময়ে কিছু কঠোর ও দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেছিল, যা স্পষ্টভাবে মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই আইনগুলো ভিন্নমত দমন, নির্যাতন এবং নিপীড়ন করে কর্তৃতবাদী শাসন টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ছিল। বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ছিল এমন একটি আইন (যা পূর্ববর্তী আইসিটি আইনের বিতর্কিত এবং দমনমূলক ৫৭ ধারার একটি পদচিহ্ন)। এ আইন বাংলাদেশে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার ভুক্তভোগী ছিলেন অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, এমনকি সাধারণ নাগরিকও।
এই দমনমূলক ডিএসএ আইনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে আইনের অপব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না, বরং আইনটি ব্যবহার করেই অর্থাৎ আইনের মধ্যে থেকেই মানুষকে হয়রানি এবং নির্যাতন করা সম্ভব ছিল। ডিজিটাল আইনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ভীতি এবং সেলফ-সেন্সরশিপের সংস্কৃতি তৈরি করে ভিন্নমতকে দমন করা, যা সংবিধান প্রদত্ত বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে। লক্ষণীয়, নিপীড়নমূলক ডিজিটাল আইন প্রণয়নে এবং প্রয়োগে বিগত সরকার ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যখন ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকারের ধারণা ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে, বাংলাদেশে দমনমূলক ডিজিটাল আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবং বিরোধী কণ্ঠ দমন করে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে পাকাপোক্ত করতে সহায়তা করেছে।
বিগত সরকারের আমলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়ে উঠেছিল ভিন্নমত দমনের বড় অস্ত্র