কাশ্মীরের তরুণেরা কেন ‘স্বাধীনতা’ আর ‘অস্ত্রের’ ট্যাটু মুছে ফেলছেন
Published: 19th, May 2025 GMT
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে শান্ত–নীরব একটি লেজার ক্লিনিকে সামির ওয়ানি তাঁর হাতটা বাড়িয়ে বসে আছেন। তাঁর চোখ তাকিয়ে আছে ত্বকে মুছে যাওয়া কালির দিকে।
সামিরের হাতে লেখা ছিল ‘আজাদি’ (উর্দু ভাষায় স্বাধীনতা) লেখা ট্যাটু। একসময় ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক ছিল এই শব্দটি। এখন সেটা লেজারের আঘাতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। যা ছিল একসময় সাহসী প্রতিবাদের চিহ্ন, এখন তা এমন এক বোঝা হয়ে উঠেছে, যা তিনি আর বইতে চান না।
২৮ বছর বয়সী সামির সেই দৃশ্যটা মনে করেন, যা তিনি কোনো দিন ভুলতে পারবেন না। তিনি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে মোটরবাইকে চড়ে যাচ্ছিলেন। পথে একটি তল্লাশিচৌকিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের মোটরসাইকেল থামান।
তল্লাশির সময় এক সেনা কর্মকর্তা সামিরের হাতে থাকা ট্যাটু দেখে জিজ্ঞেস করেন, এটা কী?’
ভারতীয় সেনা কর্মকর্তার প্রশ্ন শুনে সামিরের বুক ধড়ফড় করতে থাকে। তিনি বলছিলেন, ‘ভাগ্যিস, ওই কর্মকর্তা উর্দু পড়তে পারেন না। আরেকটু হলেই বিপদে পড়ে যেতাম। তখনই বুঝেছিলাম, এই ট্যাটুর জন্য আমি বড় বিপদে পড়তে পারি।’
সামির বলেন, ‘যখন তিনি তরুণ ছিলেন, তখন এটা ছিল শক্তির প্রতীক, যেন কিছু একটা বোঝাতে চাইছি। কিন্তু এখন এটি ভুল হিসেবে দেখি। এটা এখন আর আমার প্রতিনিধিত্ব করে না। এই ঝুঁকি নেওয়ার মতো আর কিছুই এতে নেই। বরং এটা আমার ভবিষ্যতের পথে বাধা।’
ট্যাটু এখন আর গর্ব নয়, বরং ভয়। সামির কেবল একা নন। তাঁর মতো অনেক কাশ্মীরি তরুণই এখন ট্যাটু মুছে দিচ্ছেন। এগুলো একসময় তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ, আবেগ বা পরিচয়ের প্রতিচ্ছবি ছিল। আগে যেসব ট্যাটু ছিল গর্বের বিষয়, এখন সেগুলো নীরবে, চুপচাপ মুছে ফেলা হচ্ছে।
ভারত ও পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনার মধ্যে এই প্রবণতা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগাম শহরে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাঁদের বেশির ভাগই পর্যটক। এরপর দুই দেশ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়।
পুলিশের হয়রানির ভয়ে কাশ্মীরের হাজার হাজার মানুষ ‘প্রতিবাদী ট্যাটু’ মুছে ফেলছেন.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সেন্টমার্টিনে পর্যটক নেই, হোটেল বন্ধ: ক্যারাম বোর্ডে চলছে সংসার
নীল জলরাশি ঘেরা সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপ একসময় পর্যটকের পদচারণায় মুখর থাকলেও এখন যেন নীরব এক জনপদ। বন্ধ হোটেল-রিসোর্ট, তালাবদ্ধ রেস্তোরাঁ, কর্মহীন মানুষের হাহাকার। সবমিলিয়ে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি এখন পর্যটনশূন্য।
পর্যটক যাতায়াত বন্ধ থাকায় আয়-রোজগার নেই, ফলে অনেক হোটেল মালিক কর্মচারীদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে কেউ কেউ হাল না ছেড়ে জীবিকার নতুন পথ খুঁজে নিয়েছেন। যেমন, খালি রেস্টুরেন্টে ক্যারাম বোর্ড বসিয়ে স্থানীয়দের খেলতে দিয়ে আয়ের পথ বের করেছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেন্টমার্টিন জেটিঘাট থেকে বাজারপাড়া ঢুকতেই ডান পাশে দেখা গেল একসময়ের জমজমাট দারুচিনি রেস্টুরেন্টটি খালি পড়ে আছে। এখন সেখানে চলছে ক্যারাম খেলা। প্রতি গেম ১০ টাকায় খেলে স্থানীয়রা সময় কাটাচ্ছেন। এখান থেকেই প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করে সংসার চালান রেস্টুরেন্টটির মালিক সৈয়দ আমিন।
তিনি বলেন, “চার মাস ধরে হোটেল ব্যবসা বন্ধ। পর্যটক নেই, তাই সবাইকে ছাঁটাই করতে হয়েছে। সংসার তো থেমে থাকবে না, তাই রেস্টুরেন্টের চেয়ার টেবিল সরিয়ে ক্যারাম বোর্ড বসিয়ে কিছুটা আয় করছি।”
তিনি আরও জানান, একসময় এ প্রতিষ্ঠানে ২০ জনের বেশি কর্মচারী কাজ করতেন, এখন সবাই বেকার।
পর্যটন মৌসুম সীমিত হয়ে আসায় বন্ধ হয়ে গেছে আশপাশের শাহিনা রেস্তোরাঁ, আল্লাহর দান রেস্টুরেন্ট, ইউরো বাংলা, এশিয়া বাংলা রেস্টুরেন্টসহ অধিকাংশ হোটেল-রেস্তোরাঁ। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তাঘাটে ঘোরাঘুরি করছে অভুক্ত কুকুর আর কর্মহীন মানুষ। কেউ জাল বুনছেন, কেউ রাস্তায় এবং আশেপাশে সময় পার করছেন।
ক্যারাম খেলার ফাঁকে স্থানীয় যুবক আলমগীর চৌধুরী আকাশ বলেন, “সেন্টমার্টিনের মানুষ এখন খুব কষ্টে আছে। পর্যটক না থাকায় রিকশা, হোটেল, রেস্তোরাঁ-সবখানে আয় নেই।”
শাহজালাল নামে একজন বলেন, “আগে ব্যবসা করতাম, এখন বড়শি নিয়ে সাগরে যাই। কিন্তু মাছ কিনবে এমন সামর্থ্যবান মানুষও নেই। এভাবে চললে না খেয়ে মরতে হবে।”
কোণারপাড়া এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ তৈয়ব উল্লাহ বলেন, “একসময় আমরা গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করে চলতাম। কিন্তু পর্যটন ব্যবসা শুরু হলে সবাই সেদিকেই ঝুঁকে পড়ে। আগে চার মাস ব্যবসা করলেই সারা বছর চলে যেত, এখন সরকারিভাবে তিন মাসের বেশি অনুমতি নেই। এতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে।”
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য হাবিবুর রহমান জানান, দ্বীপে ৫০টির বেশি রেস্টুরেন্ট ছিল, যেখানে প্রায় দেড় হাজার কর্মচারী কাজ করতেন। এখন সবাই বেকার। প্রায় ৪০০ অটোরিকশা চালকও আয়হীন হয়ে পড়েছেন। কেউ গরু-ছাগল বিক্রি করছেন, কেউ স্বর্ণ বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, “নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি- এই তিন মাস সেন্টমার্টিনকে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। তবে নভেম্বরে রাতযাপনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পর্যটক আসে না। বাকি দুই মাসের ব্যবসায় সারা বছর চলে না। এ বিষয়ে সরকারের ভেবে দেখা উচিত।”
হোটেল মালিক রেজাউল করিম বলেন, “আমার হোটেলে আগে ১০ জন স্টাফ ছিল, এখন মাত্র একজন আছে। খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। এভাবে চললে হোটেলটিও বিক্রি করে দিতে হবে।”
হোটেলের সাবেক কর্মচারী রবিউল হাসান বলেন, “আগে দিনে হাজার টাকা বকশিশ পেতাম, এখন বেতনও নেই। পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে আছি।”
পর্যটন ব্যবসায় ধস নামায় কেউ কেউ দ্বীপ ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে পাড়ি জমাচ্ছেন। আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী জসিম উদ্দীন শুভ টেকনাফ সদরে গিয়ে মুদি দোকান খুলেছেন। তিনি বলেন, “সেন্টমার্টিনে আর চলে না, তাই টেকনাফে এসে সংসার চালাচ্ছি। আবার পর্যটক এলে হোটেল ব্যবসায় ফিরব।”
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফয়জুল ইসলাম জানান, দ্বীপবাসীর কষ্টের কথা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে মিছিল-মানববন্ধন করেও সমাধান আসেনি। তিনি আশাবাদী, নির্বাচিত সরকার এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন বলেন, “সেন্টমার্টিন দ্বীপ সুরক্ষায় একটি কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। পর্যটক যাতায়াত বন্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাসিন্দাদের বিকল্প জীবিকার বিষয়টি ভেবে দেখা হচ্ছে।”
সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় সেন্টমার্টিন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০২০ সালের আগস্টে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সেন্টার ফর জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে সমীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। গবেষণায় বলা হয়, সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের রাতযাপন অনুমোদনযোগ্য নয়।
ঢাকা/এস