দেশের উল্লেখযোগ্য সরকারি হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র-ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) সেবা যেইভাবে অচল রহিয়াছে, উহা হতাশাজনক। জটিল ও সংকটাপন্ন এবং সাধারণত মুমূর্ষু রোগীদের যে আইসিইউর আবশ্যকতা দেখা দেয়, সরকারি হাসপাতালে উক্ত ব্যবস্থার অনুপস্থিতির অর্থ হইল প্রতিদিন দেশের শত-সহস্র সাধারণ মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র রোগী উক্ত সেবা হইতে বঞ্চিত হইতেছেন। কারণ সেবার মানে পতন সত্ত্বেও উক্ত শ্রেণিভুক্ত রোগীদের জন্য সরকারি হাসপাতালই ভরসা। বুধবার প্রকাশিত সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদন হইতে আরও জানা যাইতেছে, হাসপাতালসমূহে আইসিইউ থাকিলেও জনবল সংকটে ঐগুলি ব্যবহার করা যাইতেছে না। ইহাও স্পষ্ট, শীঘ্রই জনবল নিয়োগ না দিলে আইসিইউর মূল্যবান যন্ত্রপাতি বিকল হইয়া সম্পূর্ণ অচল হইতে পারে।
আমরা বিস্মিত, খোদ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বন্ধ রহিয়াছে, যাহাতে প্রতিদিন অন্তত অর্ধশত রোগীর এমন জরুরি সেবা প্রয়োজন বলিয়া প্রতিবেদনে আসিয়াছে। সাধারণত আইসিইউ সেবা অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল। তবে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির কারণে বেসরকারি হাসপাতাল অপেক্ষা সরকারি হাসপাতালে এই ব্যয় অনেক কম। অতএব শেষোক্ত হাসপাতালে আইসিইউ অচল থাকিবার সহিত বেসরকারি খাতের ব্যবসায় বৃদ্ধির কোনো দুষ্টযোগ থাকিলে তাহা বিস্ময়কর কিছু হইবে না। সংকাটাপন্ন রোগীর জন্য আইসিইউ সেবা কতটা জরুরি এবং উহা কতটা অপ্রতুল, করোনা সংকটকালেই আমরা দেখিয়াছি। প্রতিটি আইসিইউ আসনের জন্য প্রত্যাশিত রোগীর সংখ্যা সরকারি হাসপাতালের অসহায়ত্ব সম্পর্কে আমাদের চক্ষু খুলিয়া দিয়াছিল। বস্তুত ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় শ্বাসকষ্টের রোগীসংখ্যা বৃদ্ধি পাইবার কারণে কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস-ইআরপিপি প্রকল্পের অধীনে দেশের অধিকাংশ জেলায় সরকারি হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা হইয়াছিল। ঐ প্রকল্পের মাধ্যমে ২৩ জেলায় আইসিইউ সেবা চালুও হইয়াছিল এবং পরবর্তীকালে জনবল সংকটে কতক হাসপাতালে আইসিইউ সেবা বন্ধ হইয়া যায়। কারণ কভিড-১৯ ইআরপিপি প্রকল্পের মাধ্যমে অস্থায়ীভাবে মেডিকেল অফিসার, নার্স, টেকনোলজিস্ট, স্বাস্থ্যকর্মীসহ সহস্রাধিক জনবল দেওয়া হইয়াছিল, যাহাদের মাধ্যমে আইসিইউ সেবা সচল ছিল। গত ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হইলে এই সকল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে বিদায়ের মাধ্যমে এই সেবারও বিদায়ঘণ্টা বাজিয়া গিয়াছে, যাহা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা মনে করি, এই প্রকল্পের জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের প্রয়োজন ছিল, তাহাতে আইসিইউর জরুরি সেবা চালু রাখা সম্ভব হইত।
আপাত স্বস্তির বিষ, আইসিইউ সচল করিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নূতন প্রকল্প গ্রহণ করিতেছে বলিয়া কর্তৃপক্ষ সমকাল প্রতিবেদককে জানাইয়াছে। তবে নূতন প্রকল্প অনুমোদন করিতে এমন সময় ব্যয় করা যাইবে না, যাহাতে আইসিইউর যন্ত্রপাতিই অচল হইয়া পড়ে। সমকালের হিসাবে, এই সকল যন্ত্রপাতি নষ্ট হইলে ১৪টি হাসপাতালে সরকারের অন্তত দেড়শ কোটি টাকা গচ্চা যাইবে। আমরা বিশ্বাস করি, হাসপাতালসমূহে আইসিইউ সেবা সচল রাখিলে অনেক ভুক্তভোগী সেবা পাইবে এবং অনেক মানুষের জীবন রক্ষায় ভূমিকা পালন করিবে।
সরকারি হাসপাতালসমূহে যথাযথ সেবা পাইলে দেশের দরিদ্র মানুষ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস লইতে পারিবে। আইসিইউ বাণিজ্যের পথও অনেকাংশে বন্ধ হইবে। আমাদের সংবিধান সকল নাগরিকের সুস্বাস্থ্য ও সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব দিয়াছে। তাই আইসিইউ সেবার ক্ষেত্রে যে কোনো ব্যত্যয় সংবিধানের লঙ্ঘনরূপে চিহ্নিত হইবে। একই কারণে সরকারি হাসপাতালসমূহের আইসিইউ ব্যবস্থাপনায় যে অনিয়মের অভিযোগ রহিয়াছে উহা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলিয়া আমরা মনে করি। মোদ্দা কথা, আলোচ্য সরকারি হাসপাতালসমূহে দ্রুত সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে মূল্যবান আইসিইউ সেবা সচল রাখা হউক।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রকল প র আইস ইউর ব যবস সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুনজর কখন পড়বে
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নে দ্বিতল ভবনবিশিষ্ট একটি মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রে ওষুধ নেই, চিকিৎসক নেই, বিদ্যুৎ–সংযোগ নেই। ফলে তেমন একটা রোগীও নেই। এই ‘নাই নাই’ হাসপাতালটির নাম মাস্টারদা সূর্য সেন মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র। এভাবে কি একটা হাসপাতাল চলতে পারে? প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যাওয়ার এমন নমুনা আমাদের হতাশ করে। দেশজুড়ে এ রকম আরও চিত্র আমরা দেখতে পাই, যা আমাদের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে ইতিবাচক কোনো বার্তা দেয় না।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং ২০০৩ সালে চালু হওয়া এই ১০ শয্যার হাসপাতালটির মূল সমস্যা জনবলসংকট। ১৬টি পদের ১টিতেও স্থায়ী জনবল পদায়ন করা হয়নি। অন্য হাসপাতাল থেকে প্রেষণে এসে মাত্র তিনজন কর্মচারী (একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, একজন মিডওয়াইফ ও একজন আয়া) সপ্তাহে কয়েক দিন করে দায়িত্ব পালন করেন। এটি একটি জরুরি প্রসূতিসেবাকেন্দ্র, যা ২৪ ঘণ্টা চালু থাকার কথা। কিন্তু বিদ্যুৎ নেই, ডাক্তার নেই এবং প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে এর কার্যক্রম এখন প্রায় স্থবির।
হাসপাতালের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় প্রায় তিন মাস ধরে বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন। ফলে পানীয় জলের ব্যবস্থাও নেই। বিনা মূল্যের ওষুধ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে প্রায় ছয় মাস ধরে। এ পরিস্থিতিতে একজন রোগী কীভাবে এখানে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসবেন? যেখানে হাসপাতালের বাইরের সাইনবোর্ডে জরুরি প্রসূতিসেবার জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার কথা লেখা, সেখানে মূল ফটকে তালা ঝোলানো। এটি জনগণের সঙ্গে একধরনের প্রতারণা। হাসপাতালটি চালু না থাকায় মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতাল বা চট্টগ্রাম শহরে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। এতে সময় ও অর্থ—দুটোরই অপচয় তো বটেই, চরম ভোগান্তিরও শিকার হতে হয় মানুষকে।
যে মিডওয়াইফরা এখানে কাজ করছেন, তাঁরা জানান, এখন মাসে মাত্র চার-পাঁচজন প্রসূতি সেবা নিতে আসেন, যেখানে আগে শতাধিক প্রসূতি সেবা পেতেন। নিরাপত্তা প্রহরীরা দুই বছর ধরে বেতন পাচ্ছেন না। তবু নিয়মিত বেতন পাওয়ার আশায় তাঁরা এখনো কাজ করে যাচ্ছেন। এ অসহনীয় দুর্ভোগের কারণ হলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানান, তাঁরা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জনবলসংকটের কথা জানিয়েছেন, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।
একটি মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে কেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার ধরনা দিতে হবে? জনবল নিয়োগ, কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ, বিদ্যুতের ব্যবস্থা কার্যকর করা—সব ধরনের সংকট দূর করতে হাসপাতালটির দিকে আন্তরিক মনোযোগ দেওয়া হবে, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।