ঘুরতে নিয়ে স্কুলছাত্রীকে দলবব্ধ ধর্ষণের দায়ে পঞ্চগড়ে ৬ জনের যাবজ্জীবন
Published: 28th, May 2025 GMT
পঞ্চগড়ে এক স্কুলছাত্রীকে (১৬) দলবদ্ধ ধর্ষণের মামলায় কথিত প্রেমিকসহ ছয়জনের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে আসামিদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আজ বুধবার দুপুরে পঞ্চগড় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মো. মাসুদ পারভেজ এ রায় ঘোষণা করেন। আদালতের বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি জাকির হোসেন রায়ের বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন।
দণ্ড পাওয়া ব্যক্তিরা হলেন জেলার আটোয়ারী উপজেলার ধামোর ইউনিয়নের মালগোবা এলাকার হাসান আলী (২২), পুরাতন আটোয়ারী এলাকার সাইফুল ইসলাম (৪৯), আমিনুল ইসলাম ওরফে ডিপজল (২৪), অমর চন্দ্র বর্মণ (৩৫), নজরুল ইসলাম (৪৫) এবং ফতেপুর এলাকার সবুজ আলী (২৭)।
২০২২ সালের ৭ আগস্ট পঞ্চগড়ের আটোয়ারী থানায় ভুক্তভোগী স্কুলছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে সাতজনের নামে একটি মামলা করেন। মামলার অন্য আসামি কিশোর হওয়ায় (ঘটনার সময় বয়স ১৭ বছর ৬ মাস ১৯ দিন) তার বিষয়ে শিশু আদালতে আগামী ১৭ জুন রায় ঘোষণা হবে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকে জানা গেছে, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার একটি গ্রামের বাসিন্দা ওই কিশোরী স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ত। মুঠোফোনে পরিচয়ের সূত্র ধরে স্কুলছাত্রীর সঙ্গে আটোয়ারী উপজেলার মালগোবা এলাকার হাসান আলীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০২২ সালের ৬ আগস্ট বিকেলে হাসান মেয়েটিকে পঞ্চগড় শহরে ডেকে নিয়ে আসেন। পরে হাসান তাঁর এক বন্ধুসহ (১৭ বছর বয়সী কিশোর) ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে মেয়েটিকে মোটরসাইকেলে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরিয়ে সন্ধ্যার পর আটোয়ারী উপজেলার পুরাতন আটোয়ারী-বন্দরপাড়া এলাকার নির্জন বাগানে নিয়ে যান। ওই বাগানে রাত আটটার দিকে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন কথিত প্রেমিক হাসান আলী ও তাঁর সহযোগী বন্ধু। এর মধ্যে সেখানে স্থানীয় আরও পাঁচ ব্যক্তি (সাইফুল, আমিনুল, অমর চন্দ্র , নজরুল ও সবুজ) চলে আসেন। তাঁদের দেখে হাসান ও তাঁর সহযোগী কিশোর মেয়েটিকে রেখে মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যান। পরে মেয়েটি ওই পাঁচ ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাইলে তাঁরা সাহায্য করার কথা বলে পাশের ঝোপঝাড়ে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করেন। পরে ধর্ষণকারীদের মধ্যে একজন মেয়েটিকে ঝোপঝাড় থেকে পাশের সড়কে রেখে পালিয়ে যান।
ঘটনার পর রাতে স্থানীয় এক ব্যক্তি মেয়েটিকে উদ্ধার করে পাশের একটি বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে মেয়েটির কাছ থেকে তাঁর স্বজনদের মুঠোফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করলে স্বজনেরা গভীর রাতে মেয়েটিকে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন।
এ ঘটনায় মামলার পর ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও আটোয়ারী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.
আসামিপক্ষের আইনজীবী আহসান হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, ছয়জন আসামির মধ্যে একেক আসামির পক্ষে ভিন্ন ভিন্ন আইনজীবী ছিলেন। আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা উচ্চ আদালতে আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আশা করছেন, উচ্চ আদালতে তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপজ ল র এল ক র আট য় র
এছাড়াও পড়ুন:
এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না
অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।
এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।
ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।
তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।
আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।
এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।
আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।
মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।
‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’