দেশে কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭.৪ শতাংশ, যেখানে এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়াসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় অনুপাত ১৬ শতাংশের বেশি। এই পরিসংখ্যান আমাদের কর আহরণ এবং রাজস্ব প্রশাসনের সীমাবদ্ধতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ প্রেক্ষাপটেই সংস্কারমুখী অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি রাজস্ব আদায় সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে এনবিআরকে পুনর্গঠন করে কাঠামোগত সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দেশের মোট অভ্যন্তরীণ রাজস্বের ৮৭ শতাংশ এবং কর-রাজস্বের প্রায় ৯৬ শতাংশ সংগ্রহ করে।

সেই সংস্কারের লক্ষ্যে এনবিআর বৃহত্তর পরিসরে অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করে অর্থ উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। সেখানে যুক্তরাজ্যের এইচএম ট্রেজারি-এইচএমআরসি, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি-আইআরএস, ভারতের সিবিডিটি-সিবিআইসিসহ আন্তর্জাতিক ‘উত্তম চর্চা’ হিসেবে স্বীকৃত মডেল অনুসরণে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ– রাজস্বনীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠন, দুটি বিভাগের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব এবং বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয় কীভাবে হবে এবং আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা অনুসরণে পেশাদার রাজস্ব কর্মকর্তাদের জন্য নেতৃত্বের জায়গা নিশ্চিত করার সুস্পষ্ট প্রস্তাব ছিল। এ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, উন্নয়ন সহযোগীসহ কারও দ্বিমত ছিল না। কিন্তু অধ্যাদেশটি চূড়ান্তরূপে প্রকাশের পর দেখা গেল, করনীতি-ব্যবস্থাপনার মতো উচ্চ কারিগরি বিষয়টি পেশাদার রাজস্ব কর্মকর্তাদের জন্য না রেখে সচিবসহ কৌশলগত পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। ফলে রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। তারা আন্দোলন শুরু করেন। তাদের দাবি, গত ১২ মে জারি করা অধ্যাদেশে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠার মূল ধারণাকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। তবে সরকারের ব্যাখ্য, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম যদি একই (কাস্টমস ও কর) ক্যাডারের কর্মকর্তারা সম্পাদন করেন তাহলে পৃথককরণের কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। 

সরকারি চাকরিতে প্রশাসন ক্যাডারের ‘সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কের বিষয়। যে কোনো নতুন বিভাগ সৃষ্টি বা প্রশাসনিক ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের আধিপত্য নিশ্চিত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। নতুন দুটি রাজস্ব বিভাগ গঠনের ক্ষেত্রেও সেই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এমনিতেই বহুকাল ধরে এনবিআরের নেতৃত্বের জায়গাটি প্রশাসন ক্যাডারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিবের হাতে রাখা হয়েছে, যিনি পদাধিকারবলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। 

এনবিআর কর্মকর্তারা যুক্তি দিচ্ছেন, রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনা একটি উচ্চমাত্রার টেকনিক্যাল (বিশেষায়িত) কাজ, যা দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার দাবি রাখে। করনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কাস্টমস ভ্যালুয়েশন, ট্রান্সফার প্রাইসিং, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি, ডব্লিউটিও নীতিমালা। সবই অতি জটিল এবং এগুলো সঠিকভাবে বুঝে কাজ করা সময়সাপেক্ষ। এগুলোর দায়িত্ব যদি সাধারণ প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে রাজস্ব প্রশাসনের কাঠামোগত সক্ষমতা বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পেশাদার কূটনীতিকরা স্বার্থের সংঘাত ছাড়াই যদি নীতি ও দূতাবাস দুটোই পরিচালনা করতে পারেন কিংবা জনপ্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে কাজ শিখে পরে সচিবালয়ে নীতি-সংক্রান্ত কাজ কোনো দ্বন্দ্ব ছাড়াই করতে পারেন, তাহলে রাজস্ব বিভাগের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব কেন হবে? 
আসলে সংস্কার বলতে আমরা কী বুঝি– সেটা আগে পরিষ্কার হওয়া দরকার। শুধু একটি বিশেষ ক্যাডারের জন্য সুযোগ সৃষ্টি তো প্রকৃত সংস্কার নয়। সংস্কার হবে তখনই, যখন টেকনিক্যাল কাজের জন্য পেশাদার, অভিজ্ঞ এবং প্রশিক্ষিত জনবলকে দায়িত্ব দেওয়া হবে এবং নেতৃত্বে থাকবে প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ ব্যবস্থা। 

ভবিষ্যতে সরকার কখনও জনপ্রশাসন সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করলে এবং আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার অনুসরণে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে সব সচিব পদে নিয়োগ দিলে (যেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের যোগ্য ব্যক্তিদের জন্যও সমান সুযোগ থাকবে) রাজস্ব বিভাগেও যে কোনো যোগ্য ব্যক্তির নিয়োগ পেতে কোনো বাধা থাকবে না। কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না। কর-জিডিপি অনুপাতকে একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা পৃথককরণ ছাড়াও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার প্রয়োজন। এ কাজে বিনিয়োগও করতে হবে।
এ ছাড়াও রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণাও হওয়া দরকার। অত্যধিক কর অব্যাহতি, একাধিক করহার এবং উচ্চহারের কাস্টমস ট্যারিফের যে চিরায়ত সমস্যা কম রাজস্ব আহরণ বা রাজস্ব ফাঁকির ক্ষেত্র তৈরি করছে, সেগুলো নিয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক তথ্য-উপাত্ত, গবেষণা এবং বিশ্লেষণ প্রয়োজন, যা বর্তমানে নেই। একটি স্বতন্ত্র নীতি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলে আশা করা যায়, এ কাজগুলো আরও পেশাদারিত্বের সঙ্গে সম্পাদন করা হয়তো সম্ভব হবে। করহারের উৎপাদনশীলতা, ট্যারিফ সুরক্ষা বনাম রপ্তানি বৈষম্য, দেশের অর্থনীতিতে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থানের ম্যানুফ্যাকচারিং নাকি সেবা খাতের ওপর আর্থিক সুবিধা প্রদান দীর্ঘ মেয়াদে অধিকতর যৌক্তিক হবে, অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রকৃত ধারণা, কোন বিশেষ শুল্ককর নীতির কারণে কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে না ইত্যাদি বিষয়ে এনবিআরের গবেষণা বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্রগুলোকে প্রণোদনা দিতে হবে, যাতে তারা করনীতি নিয়ে ডেটানির্ভর কাজ করে। এতে উন্নত বিশ্লেষণ ও চূড়ান্ত নীতি প্রস্তাবের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে।
তাই এনবিআরের আপত্তিকে ‘পেশাগত সংকীর্ণতা’ হিসেবে দেখার আগে আমাদের উচিত হবে সংস্কারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও বাস্তবতা বিবেচনা করা। প্রশাসনিক আধিপত্য নয়, বরং টেকনিক্যাল সক্ষমতাই রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সফলতার চাবিকাঠি হতে পারে। একে পেশাদারদের হাতে তুলে না দিলে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে না, যা আমাদের বাজেট বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।

মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ কর মকর ত দ র র কর মকর ত ত দ র জন য অন প ত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ইলিশ রক্ষায় জাটকা শিকারে আজ থেকে ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা

ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও টেকসই সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে শনিবার (১ নভেম্বর) থেকে শুরু হচ্ছে দেশব্যাপী জাটকা ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা। 

আগামী ৩০ জুন ২০২৬ পর্যন্ত চলবে এই ৮ মাস মেয়াদি নিষেধাজ্ঞা।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এবং মৎস্য অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় ২৫ সেন্টিমিটারের ছোট ইলিশ (জাটকা) আহরণ, পরিবহণ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও মজুত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।

এর আগে ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর ২০২৫ (১৯ আশ্বিন থেকে ৯ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ) পর্যন্ত ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে প্রজননক্ষম ইলিশ রক্ষায় ‘ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান-২০২৫’ বাস্তবায়ন করা হয়। ওই সময়ে ডিমওয়ালা ইলিশ থেকে নিঃসৃত ডিমের পরিস্ফুটনের মাধ্যমে উৎপাদিত পোনা বর্তমানে উপকূলীয় নদ-নদী ও মোহনাসমূহে বিচরণ করছে। এসব পোনা নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারলেই ভবিষ্যতে দেশের ইলিশ উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পাবে বলে সরকার জানায়।  

নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে অনধিক ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়া লাগতে পারে। 

মৎস্য অধিদপ্তর সারাদেশে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশ, র‌্যাব, ও স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতায় কঠোরভাবে এ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করবে।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইলিশ রক্ষায় জাটকা শিকারে আজ থেকে ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা