ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় বিএনপিসহ অনেক দল
Published: 3rd, June 2025 GMT
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় নির্বাচন কবে তার পথনকশা (রোডম্যাপ) দেওয়ার বিষয়টিই ঘুরেফিরে গুরুত্ব পেয়েছে।
আলোচনায় অংশ নেওয়া বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছে। কোনো কোনো দল বলেছে, প্রধান উপদেষ্টা যে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছেন, সেটা কোন মাসে হবে, তা ঘোষণা করা উচিত। আবার কোনো দল ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার পর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে বলেছে।
গতকাল সোমবার বিকেল পাঁচটার দিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে আলোচনা শুরু হয়। সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে শেষ হয় আলোচনা সভা।
ফরেন সার্ভিস একাডেমি মিলনায়তনে এ আলোচনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ ৩০টির বেশি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
আলোচনার সূচনা করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। একটি চমৎকার জুলাই সনদ করা সম্ভব হবে, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘এ সুযোগ যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি।’
গতকাল ছিল মূলত দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার উদ্বোধনী। আজ মঙ্গলবার দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আগামী মাসে জুলাই সনদ তৈরির লক্ষ্য রয়েছে ঐকমত্য কমিশনের।
গত বছরের অক্টোবরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ফেব্রুয়ারিতে কমিশনগুলো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেয়। সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। পুলিশ সংস্কার কমিশন বাদে বাকি পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি প্রস্তাব ছক আকারে দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে মতামত নেয় কমিশন। এরপর গত ২০ মার্চ দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে প্রথম পর্বের আলোচনা শুরু হয়। প্রথম পর্বের আলোচনা শেষ হয় ১৯ মে। প্রথম পর্বে ৩৩টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন।
অধিকাংশ দল ডিসেম্বরে নির্বাচনের পক্ষেগতকাল আলোচনা শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা সাংবাদিকদের কাছে আলোচনার বিষয়বস্তু ও নিজেদের অবস্থানের কথা জানান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গতকালের বৈঠকে অংশ নেয়। আলোচনা শেষে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা মনে করি, ডিসেম্বরের ভেতরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব। আগেই জরুরি ভিত্তিতে যেসব সংস্কার করা প্রয়োজন, বিশেষ করে নির্বাচনমুখী, সেই সংস্কারগুলো চিহ্নিত করে আমরা ঐকমত্যের মাধ্যমে সেগুলো বাস্তবায়ন করি। এমন কোনো সংস্কার নেই, যেগুলো এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।’
সংবিধান সংশোধন ছাড়া অন্য সব সংশোধন, যেগুলোর বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাবে সবাই একমত, সেগুলো নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করেন সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন নির্বাচন ডিসেম্বরের পরে যাওয়ার মতো একটিও কারণ উল্লেখ করার মতো নেই।
সালাহউদ্দিন আরও বলেন, ‘আজকে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বক্তব্যে আমরা দেখলাম, ডিসেম্বরের আগে নির্বাচনের জন্য প্রস্তাব আছে। প্রধান উপদেষ্টা সেটি বিবেচনা করবেন। আশা করি, তিনি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে নিরপেক্ষভাবে সেই ভূমিকা পালন করবেন।’
জামায়াতে ইসলামী যেকোনো সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, প্রথম হচ্ছে সংস্কারের বিষয়। তাঁরা বলেছেন, জুলাইয়ের ভেতরে এ সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। অনেক বিষয় ঐকমত্য হয়েছে। কিছু বিষয়ে সামান্য দ্বিমত আছে বিভিন্ন দলের মধ্যে।
বৈঠকে নির্বাচনের তারিখের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘এ ব্যাপারে তিনটি বক্তব্য এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন ডিসেম্বর টু জুন, কিছু পলিটিক্যাল পার্টি বলেছেন ডিসেম্বর। আর আমরা বলেছি জুন ও মে মাস আবহাওয়াগতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য উপযোগী নয়। তাহলে মে–জুন বাদ দিলে ওনার কমিটমেন্টের যে টাইমলাইন সেটা হচ্ছে ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল। এর মধ্যে রোজা আছে। আমরা বলেছি, এর ভেতরেই তিনি একটা ডেট ঘোষণা করবেন।’
তবে জুলাই সনদ ঘোষণার আগে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার বিপক্ষে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘১৬ বছর আমরা অপেক্ষা করেছি, এরপর ১০ মাস অপেক্ষা করেছি, আরও দুই মাস অপেক্ষা করতে চাই এবং সরকারকে সময় দিতে চাই সব রাজনৈতিক দল মিলে। দুই মাসের মধ্যে আমাদের জুলাই সনদ, যেখানে জনগণ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ শাসনের রূপরেখা, শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা দেখতে পারবে। সেই জুলাই সনদ হওয়ার পরে সরকার যাতে নির্বাচনে তারিখ ঘোষণা করে, সে আহ্বান আমরা জানিয়েছি। জুলাই সনদ হওয়ার পরে আমরা আমাদের দলীয় মন্তব্য জানাব যে, আমরা কখন নির্বাচন চাইছি।’
নির্বাচন কমিশন এখন যে প্রক্রিয়ায় চলছে, তার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না বলে উল্লেখ করেছেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার। নির্বাচন–সংক্রান্ত ও নির্বাচন কমিশন–সংক্রান্ত যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলো সংস্কার করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে যাতে জুলাই ঘোষণাপত্রটি জারি করা হয়, সে বিষয়ে জোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। সরকার নিজেই বলেছে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো স্বাভাবিক কারণে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়।
বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন সেলিম বলেন, প্রায় ৩২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৬ জন বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২৩ জন অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ডিসেম্বরে নির্বাচন দাবি করেছেন। একটি দল বলেছে, নির্বাচন জানুয়ারিতে হতে পারে, ফেব্রুয়ারিতে হতে পারে। তারপর নির্বাচন হওয়ার মতো প্রাকৃতিক পরিবেশ নেই। একটি রাজনৈতিক দল বিচার ও সংস্কারের পর নির্বাচন দাবি করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সংস্কারের কাজ শেষ করে নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে হতে হবে।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ল হউদ দ ন ন ড স ম বর জ ল ই সনদ প রস ত ব ন র জন য র র পর বল ছ ন সরক র গতক ল ইসল ম ব এনপ প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন চায় বাসদ
ডিসেম্বরের আগেই জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। আজ সোমবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বৈঠকে দলের পক্ষ থেকে এ দাবি জানানো হয়েছে বলে বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ জানিয়েছেন।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এ বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বজলুর রশীদ ফিরোজ। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন একটি আরেকটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুন কেন, এমন প্রশ্ন তুলে বাসদের এই নেতা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন বলেছে, জুলাই মাসের মধ্যেই তারা প্রস্তুত। আমরা বলেছি, ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচনের তারিখ সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে এবং নির্বাচনের তারিখ দিয়ে সংস্কার প্রস্তাবকে এগিয়ে নিতে হবে এবং বিচারকে দৃশ্যমান করতে হবে।’
বৈঠকের আলোচনা নিয়ে বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘আমরা বলেছি যে প্রধান উপদেষ্টা জাপান গিয়ে যে বক্তব্য রেখেছে, সেটা একটি পার্টিকে ব্লেম করা হয়েছে। বন্দর ও মানবিক করিডর দেওয়ার যে চক্রান্ত, সেগুলো বন্ধ করতে হবে। এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নয়। আমরা বলেছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিরপেক্ষ সেটা প্রমাণ করতে হবে।’
এ ছাড়া জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো জাতির সামনে স্পষ্ট করার দাবি জানিয়েছে বাসদ। বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেছেন, ‘তিন মাস ধরে আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, সেই তিন মাসের আলোচনার সারসংক্ষেপ কী? কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো জাতির সামনে পরিষ্কার করতে হবে। আমাদের কাছে পরিষ্কার করতে হবে, সেগুলো বাস্তবায়নের কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ চায় বাংলাদেশ জাসদ
বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘সংস্কারের আলোচনাকে যদি আমাদের অর্থবহ করতে হয়, তাহলে সর্বাগ্রে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে হবে, সম্ভব হলে ডিসেম্বরের আগে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা যায়।’
এ ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদকে তার নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে হবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ জাসদের এই নেতা বলেন, ‘প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে মাঠপর্যায়ে যারা নির্বাচনের ডিউটি করবে, তাদেরও নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে হবে। যদি সংস্কারের আলোচনা করতে হয়, তাহলে সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে এবং বিদেশের সঙ্গে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ চুক্তি করা যাবে না। এগুলো যদি আমরা নিশ্চয়তা পাই, তাহলে সংস্কারের আলোচনা সফল হতে পারে।’