প্রকাশ্য বিরোধে ট্রাম্প-মাস্ক: পাল্টাপাল্টি হুমকিতে উত্তপ্ত পরিস্
Published: 6th, June 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়েছেন। অথচ কয়েকদিন আগেও তাদের বন্ধুত্ব ছিল বেশ আলোচনার বিষয়। মাস্ক গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দক্ষতা বিভাগের (ডিওজিই) প্রধানের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করার পর ট্রাম্পের আলোচিত কর ও ব্যয়-সংক্রান্ত বাজেট বিলের তীব্র সমালোচনা করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প মাস্ককে তুলোধুনা করলে তাদের মধ্যে প্রকাশ্যেই কাদা ছোঁড়াছুড়ি শুরু হয়। খবর বিবিসির।
বৃহস্পতিবার (৫ জুন) ট্রাম্প বলেছেন, মাস্কের কার্যকলাপে তিনি খুবই হতাশ এবং ভবিষ্যতে তার সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকবে কি না- সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।
বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রেডরিশ মের্জের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। বৈঠকের আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এক প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেন, “দেখুন, ইলনের সঙ্গে আমার চমৎকার সম্পর্ক ছিল; কিন্তু আমি জানি না ভবিষ্যতে তা থাকবে কি না।”
আরো পড়ুন:
অনুমোদিত ভ্রমণকাল শেষে থাকলে ফেরত পাঠাবে যুক্তরাষ্ট্র
১২ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা
তিনি বলেন, “আমি তার ওপর খুবই হতাশ। কারণ যে বিলটি নিয়ে ইলন আলোচনা-সমালোচনা করছেন- এখানে বসে থাকা যে কোনো ব্যক্তির চেয়ে তিনি এই বিলের কার্যকারিতা সম্পর্কে বেশি অবগত। এতে তার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। কী কারণে সমস্যা হলো আমি বুঝতে পারছি না।”
এদিকে ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পর স্যোশাল মিডিয়া এক্সে একের পর এক পোস্টে ট্রাম্পকে পাল্টা তুলোধুনো করছেন মাস্ক। ট্রাম্পকে ‘অকৃতজ্ঞ’ অ্যাখ্যা দিয়ে মাস্ক বলেন, “আমি না থাকলে ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে যেতেন।”
এরপর ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট করে ফের মাস্কের সমালোচনা করেন। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে দুজনের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় তর্ক-বিতর্কের পর, ট্রাম্প পরিস্থিতিকে হালকা করার চেষ্টা করেন। মাস্কের সঙ্গে বাকযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকোকো ট্রাম্প বলেন, “ওহ, ঠিক আছে। এটা খুব ভালো চলছে, এর চেয়ে ভালো আর কখনো হয়নি।”
মার্কিন একটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ট্রাম্পের সহযোগীরা আজ শুক্রবার মাস্কের সঙ্গে একটি ফোনালাপের সময়সূচি নির্ধারণ করেছেন। মাস্কও বিশ্বাস করেন যে, পরিস্থিতি ঠিক করার প্রয়োজন।
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় ধনকুবের টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রধান ইলন মাস্ক জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি নির্বাচনে সবচেয়ে বড় অনুদানদাতাও ছিলেন। সেইসূত্রে ট্রাম্পের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল মাস্কের। ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ের পর মাস্কের জন্য আলাদা একটি দপ্তর তৈরি করেছিলেন। সেই সরকারি দক্ষতা বিষয়ক দপ্তর (ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা ডিওজিই)-এর কাজ ছিল প্রশাসনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাঁট করে অর্থনৈতিক সাশ্রয় করা। গত মাসে কর ও ব্যয় সংক্রান্ত একটি বিল অনুমোদন করার পর ট্রাম্প এটিকে ‘বড় ও সুন্দর’ বিল অভিহিত করেন। কিন্তু মাস্ক বিলটির বিপক্ষে অবস্থান নিলে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে ভাঙন দেখা দেয়। বিলটি গত মাসে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে পাস হয়েছে এবং সিনেটে ভোটের অপেক্ষায় রয়েছে।
মাস্ক গত সপ্তাহে ডিওজিই দপ্তর প্রধানের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। এর কিছুক্ষণ পরেই তিনি এক্স-এ একটি পোস্ট করে ট্রাম্পের ‘সুন্দর’ বিলটিকে ‘জঘন্য’ বলে অভিহিত করেন। পোস্টে মাস্ক বলেন, “যারা এই বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন তাদের জন্য লজ্জা: আপনারা জানেন যে আপনারা ভুল করেছেন।”
তিনি যুক্তি দেন, বিলটি দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে মার্কিন জাতীয় ঋণ বৃদ্ধি করবে। মাস্ক তার ঘনিষ্ঠদের ফোন করে বিলটির বিরোধিতা করার জন্য উৎসাহিত করেন।
নির্দলীয় কংগ্রেসনাল বাজেট অফিসের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ অনুসারে, ট্রাম্পের নতুন বাজেট বিলটির ফলে ১০ বছরে মার্কিন জাতীয় ঋণ ২.
হোয়াইট হাউজ এই পরিসংখ্যানের বিরোধিতা করে বলেছে, তারা বর্ধিত শুল্কের মাধ্যমে আনা রাজস্বের হিসাব রাখে না।
বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় ট্রাম্প বিলটির পক্ষে ফের কথা বলেন। তিনি বলেন, “আমি খুবই হতাশ কারণ মাস্ক এই বিলের ভেতরের কাজকর্ম এখানে বসে থাকা প্রায় সবার চেয়ে ভালোভাবে জানতেন। হঠাৎ করেই তার একটা সমস্যা দেখা দেয়।”
ট্রাম্প আরো বলেন, “বিলটিতে বৈদ্যুতিক যানবাহনের জন্য ভর্তুকি ও আদেশ বাতিল করায় মাস্ক বিরক্ত, যা তার টেসলা ব্যবসাকে প্রভাবিত করতে পারে।”
তবে মাস্ক এই অভিযোগ অস্বীকার করে এক্স পোস্টে লিখেন, “বিলে ইভি/সৌর প্রণোদনা কাটছাঁট রাখুন, যদিও তেল ও গ্যাসের ভর্তুকি স্পর্শ করা হয়নি (খুবই অন্যায্য!!), তবে বিলের মধ্যে ঘৃণ্য শুয়োরের মাংসের পর্বত বাদ দিন।”
“শুয়োরের মাংস” শব্দটি মার্কিন রাজনীতিতে ব্যবহৃত একটি শব্দ যা অপব্যয়মূলক সরকারি ব্যয়কে বর্ণনা করে, বিশেষ করে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা স্থানীয় এলাকার অনুগ্রহ অর্জনের উদ্দেশ্যে।
এরপর মাস্ক এক্সে আরেকটি পোস্ট করে ট্রাম্পের পদত্যাগ দাবি করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যালে একটি পোস্টে করে ‘মাস্ক পাগল হয়ে গেছেন’ বলে মন্তব্য করেন। পোস্টে ট্রাম্প আরো বলেন, “আমাদের বাজেটে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্থ সাশ্রয়ের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো মাস্কের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সরকারি ভর্তুকি ও চুক্তি বাতিল করা। আমি সবসময় অবাক হয়েছি যে, বাইডেন এটি করেননি!”
টেসলা, স্পেসএক্স এবং স্টারলিংকসহ মাস্কের কোম্পানিগুলোর মার্কিন সরকারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে এবং অন্যান্য অনেক ব্যবসার মতো, ভর্তুকি ও কর ছাড় থেকে উপকৃত হয়।
মাস্ক ট্রাম্পের পোস্টের স্ক্রিনশট শেয়ার করে পালটা হুমকি দেন, “প্রেসিডেন্ট যদি চুক্তি বাতিল করেন, তাহলে স্পেসএক্স এখনই ড্রাগন স্পেসক্রাফট সরিয়ে নেবে।” ড্রাগন স্পেসক্রাফট আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নভোচারী এবং সরবরাহ পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
তবে পাঁচ ঘণ্টা পর এক ব্যবহারকারীর আহ্বানে মাস্ক কিছুটা নমনীয় হন। ওই ব্যবহারকারী লিখেছিলেন, “প্রকাশ্যে একে অপরকে আক্রমণ করা লজ্জাজনক। ভালো হয় যদি দু-একদিন এ নিয়ে চুপ থাকা যায়।” জবাবে মাস্ক জানান, আপাতত ড্রাগন স্পেসক্রাফট সরানো হচ্ছে না। পরে তিনি ড্রাগন স্পেসক্রাফটের ছবি ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পোস্ট করে লেখেন, “আমি এখনো টিম আমেরিকার সদস্য।”
তবে বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি সাময়িকভাবে শান্ত হলেও ট্রাম্প-মাস্ক সম্পর্ক যে ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে, সেটি আর অস্বীকারের সুযোগ নেই।
বৃহস্পতিবার ট্রাম্পের সঙ্গে মাস্কের বাকযুদ্ধ প্রকাশ্যে আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই টেসলার শেয়ারের দাম ১৪ শতাংশ কমেছে, যার ফলে মাস্কের ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিটির বাজারমূল্য একদিনেই ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি নেমে গেছে।
ঢাকা/ফিরোজ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর য ক তর ষ ট র য ক তর ষ ট র র প রক শ য প স ট কর ভর ত ক র জন য সরক র ব যবহ
এছাড়াও পড়ুন:
রোজার আগেই নির্বাচন, এরপর আগের কাজে ফিরে যাবেন
অন্তর্বর্তী সরকার সময়মতো ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে পবিত্র রমজানের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পর তিনি তাঁর আগের কাজে ফিরে যাবেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাকে এসব কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন থেকে ভিডিও ফোনকলে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেন জর্জিয়েভা।
এ সময় তাঁরা বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কার, আঞ্চলিক পরিস্থিতি এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনের পূর্ববর্তী চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন।
আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং এই কৃতিত্ব তাঁর নিজের।
অর্থনীতির সংকটকালীন পরিস্থিতি স্মরণ করে আইএমএফ প্রধান বলেন, ‘আপনার অর্জন আমাকে মুগ্ধ করেছে। অল্প সময়ে আপনি অনেক কিছু করেছেন। যখন অবনতির ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি ছিল, তখন আপনি দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক ব্যক্তি।’
ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বিশেষভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা এবং রিজার্ভ পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের সাহসী পদক্ষেপ, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রবর্তনের প্রশংসা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের এক সংকটময় সময়ে আইএমএফ প্রধানের অবিচল সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘চমৎকার সহায়তার জন্য ধন্যবাদ।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, গত বছর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ সুগম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
কথোপকথনে আইএমএফ প্রধান অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতে গভীর সংস্কার বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘শক্ত অবস্থানে থাকতে হলে সংস্কার অনিবার্য। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমূল্য মুহূর্ত।’
অধ্যাপক ইউনূস জানান, তাঁর সরকার ইতিমধ্যে ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠন এবং রাজস্ব সংগ্রহ জোরদারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এক বিধ্বস্ত ও সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া অর্থনীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। কিছু ব্যক্তি আক্ষরিক অর্থে ব্যাগভর্তি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
এ ছাড়া আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। এর মধ্যে ছিল নেপালে চলমান যুব আন্দোলন এবং আসিয়ানভুক্তির জন্য বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। অধ্যাপক ইউনূস আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি জোরদারের লক্ষ্যে ঢাকার বৃহৎ অবকাঠামো উদ্যোগ—যেমন নতুন বন্দর ও টার্মিনাল প্রকল্প—সম্পর্কেও অবহিত করেন।
আলোচনাকালে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং অর্থসচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।