নজরদারি বৃদ্ধিসহ কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে
Published: 10th, June 2025 GMT
দীর্ঘদিন ধরে মৎস্যজীবীদের দাবি ছিল, সমুদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় কমিয়ে ভারতের নিষেধাজ্ঞার সময়সীমার সঙ্গে সামঞ্জস্য করা হোক। তা না হলে এই সুযোগে ভারতের জেলেরা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যান। অন্তর্বর্তী সরকার মৎস্যজীবীদের সে দাবি মেনে নিষেধাজ্ঞার সময় কমিয়ে এনেছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, মৎস্যজীবীরাই সেই নিষেধাজ্ঞা মানছেন না। এতে নিষেধাজ্ঞার সুফল পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
দেশের সমুদ্রসম্পদ রক্ষায় সরকার প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ওপর এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। উদ্দেশ্য একটাই—মাছের প্রজনন, বৃদ্ধি ও টেকসই আহরণ নিশ্চিত করা। এ বছরও সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে। ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিনের এ নিষেধাজ্ঞার সময় শেষ হওয়ার পথে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, মাঠপর্যায়ে এ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে নানা দুর্বলতা দেখা গেছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কুয়াকাটা, পাথরঘাটা, তালতলীসহ বরিশালের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলের অসাধু ব্যবসায়ী ও জেলেরা অভিনব কৌশলে সাগরে গিয়ে মাছ শিকার করছেন। এরপর এসব মাছ ছোট ট্রলারে করে বন্দরে এনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার করা হচ্ছে। এমনকি যাত্রীবাহী বাসে করেও ঢাকাসহ বিভিন্ন বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে নিষিদ্ধ সময়ে ধরা এসব মাছ।
এমন পরিস্থিতিতে প্রকৃত মৎস্যজীবী ও সচেতন ব্যবসায়ীরা নিষেধাজ্ঞার সুফল নিয়ে সন্দিহান। বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতির বক্তব্যে উঠে এসেছে হতাশা। তিনি বলেছেন, ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে আনার পেছনে তাঁরা অনেক শ্রম দিয়েছেন, আন্দোলন করেছেন। সরকার তাঁদের দাবি মেনে নিষেধাজ্ঞার সময় কয়েক দিন কমিয়ে দিলেও অনেক ট্রলারমালিক ও জেলে নিষেধাজ্ঞা মানছেন না।
বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাবি, নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের ব্যাপারে তাঁদের কোনো ঢিলেমি নেই। তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু জনবলসংকট থাকায় সব কাজ তাঁদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সড়কপথে মাছ পাচার রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তাঁরা জানান।
প্রজননের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এমন অবাধ শিকারে মৎস্যসম্পদ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ারই কথা। এ মৌসুমের নিষেধাজ্ঞা প্রায় শেষ হয়ে গেলেও আগামী বছরগুলো থেকে এ ব্যাপারে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ ও কঠোর নজরদারি জরুরি। নৌ ও সড়কপথে মাছ পাচার প্রতিরোধে আন্তবিভাগীয় সমন্বিত অভিযান চালাতে হবে। নজরদারিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সচেতনতা ও বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করে তাঁদের নিষেধাজ্ঞা মানতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নিষেধাজ্ঞার সময় সরকারি সহায়তা থেকে কোনো জেলে যেন বঞ্চিত না হন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যাঁরা নিষেধাজ্ঞা ভাঙবেন, তাঁদের সতর্কীকরণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধাপে শাস্তি দিতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ষ ধ জ ঞ র সময় মৎস য সরক র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনের বড় গেছো প্যাঁচা
শরতের সুন্দরবন দেখার প্রত্যয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে খুলনা থেকে ছোট্ট লঞ্চ গাংচিলযোগে শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা হলাম। কিন্তু ঢাংমারীতে লঞ্চে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় শেখেরটেক পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। কটকা ও কচিখালীর তুলনায় এখানে পর্যটকদের আনাগোনা কম। শেখেরটেকে একটি কালীমন্দির রয়েছে। মন্দিরের আশপাশে বাঘের আনাগোনা বেশি। কিন্তু আমরা এবার ‘মামা’র খোঁজে আসিনি, এসেছি দুটি বিরল পাখির সন্ধানে। তবে লঞ্চ থেকে নেমেই মামার পায়ের তাজা ছাপ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। সম্ভবত গত রাতে সে এখান দিয়ে হেঁটে গেছে।
একটি ছোট্ট বিরল পাখির খোঁজে টাওয়ারে যাওয়ার রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে আছি। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। কিন্তু মুহূর্তেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা। মাথায় দু-তিনটি বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই পাখি খোঁজা রেখে ক্যামেরা বাঁচাতে টাওয়ারের দিকে দৌড় দিলাম। বৃষ্টি থামলে মন্দিরের দিকে গেলাম। কিন্তু বহুক্ষণ খুঁজেও দেখা পেলাম না। অথচ এর আগে অনেকেই এই দুটি স্থানে পাখিটির দেখা পেয়েছেন। কিন্তু বারবার রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরির খেলায় আমরা পাখিটি দেখতে ব্যর্থ হয়ে লঞ্চে ফিরে এলাম।
কিছুক্ষণ পর চারদিক অন্ধকার হয়ে সন্ধ্যা নামল। ক্যামেরা হাতে লঞ্চের সামনে যে যার মতো পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম নিশাচর এক বিরল পাখির খোঁজে। চারদিক সুনসান। ছোট্ট একটি ডিভাইসে পাখিটির কল (ডাক) বাজছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর শেখেরটেক খালের অন্য পাড় থেকে ডাকের প্রতি–উত্তর পাওয়া গেল। ডাকের উৎসের দিকে টর্চ ফেলে পাখিটিকে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু খুঁজে পেলাম না।
প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টার পর পাখিটির অবস্থান শনাক্ত করা গেল পন্টুনের পাশে একটি বড় গাছে। খুব সাবধানে লঞ্চ থেকে পন্টুনে নামলাম। কিন্তু পাখিটি টের পেয়ে উড়ে গিয়ে অন্য একটি গাছে বসল। বুঝতে পারলাম সে বারবার গাছ বদল করবে। কাজেই নৌকা ছাড়া ওর কাছাকাছি যাওয়া যাবে না। লঞ্চের সঙ্গে নিয়ে আসা নৌকায় উঠে পাখিটি যে গাছে বসেছে, সেদিকে গেলাম। রাত ৯টা ২৮ মিনিট ১২ সেকেন্ডে পাখিটির প্রথম ছবি তুললাম। কিন্তু মাত্র ২৯ সেকেন্ড সময় দিয়ে পাখিটি উড়াল দিল। দ্বিতীয়বার পাখিটির ছবি তুললাম রাতের খাবার সেরে আরও দুই ঘণ্টা পর ঠিক রাত ১২টায়।
সুন্দরবনের শেখেরটেকে দেখা প্যাঁচাটি এ দেশের বিরল আবাসিক পাখি বড় গেছো প্যাঁচা। ইংরেজি নাম ব্রাউন উড আউল। স্ট্রিজিডি গোত্রের প্যাঁচাটির বৈজ্ঞানিক নাম Strix leptogrammica। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, চীনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই পাওয়া যায়।
বড় গেছো প্যাঁচা বড় মাথা-চোখ, খাটো ঘাড় ও চওড়া ডানার পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক প্যাঁচার দৈর্ঘ্য ৩৯ থেকে ৫৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৮০০ থেকে ১ হাজার ১০০ গ্রাম। কাঁধে চিকন সাদা ডোরাসহ দেহের ওপরটা ঘন বাদামি বা খয়েরি। দেহের নিচটা হলদে-সাদা ও তাতে থাকে সরু বাদামি ডোরা। মুখমণ্ডলের গোলক ডাম্বেল আকারের। গোলকের প্রান্ত কালো। এ দেশে পাখিটির যে উপপ্রজাতিটি দেখা যায়, তার মুখমণ্ডল গাঢ় বাদামি বা খয়েরি, ভ্রু সুস্পষ্ট ও সাদা এবং ঘাড়ের সামনের অংশে সুস্পষ্ট সাদা বন্ধনী দেখা যায়। চোখ হলদে। চঞ্চু ফ্যাকাশে নীলচে ও পা ফ্যাকাশে বাদামি। প্যাঁচা ও পেঁচীর চেহারা একই রকম।
সুন্দরবন ছাড়াও ওরা সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং ঢাকা বিভাগের পত্রঝরা বনের বাসিন্দা। অত্যন্ত লাজুক ও নিশাচর পাখিগুলোকে একাকী বা জোড়ায় দেখা যায়। দিনে বনের উঁচু কোনো গাছের ঘন পাতার আড়ালে বসে বিশ্রাম করে। ভোর ও সন্ধ্যায় উঁচু গাছ বা জায়গা থেকে মাটিতে বা পানিতে শিকার খোঁজে ও পায়ের তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে ইঁদুর, ছোট পাখি, সরীসৃপ ইত্যাদি শিকার করে খায়। নিচু কণ্ঠে ও গভীরভাবে ‘টু...হুও...’ বা ‘উ...হুও...’ শব্দে ডাকে।
জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে প্রজনন করে। সচরাচর গাছের গর্তে কাঠিকুটি ও ঝরা পালক বিছিয়ে বাসা বানায়। পেঁচী তাতে দুটি সাদা রঙের ডিম পাড়ে। প্রায় ৩০ দিন তা দিয়ে ছানা ফোটায়। সচরাচর পেঁচী ডিমে তা দেয় ও প্যাঁচা ডিমে তা–দানরত পেঁচী ও পরে ছানাদের খাওয়ায়। ছানারা প্রায় দেড় মাসে উড়তে শেখে। তবে এরপরও বেশ কয়েক মাস বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। আয়ুষ্কাল প্রায় ১০ বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়