শিক্ষা সংস্কারে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত কী করছে; আমরা কী করছি
Published: 18th, June 2025 GMT
সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই প্রযুক্তি ও নতুন উদ্ভাবন মানুষের সমাজকে সামনে এগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শিল্প-বাণিজ্য, জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিতে বিপুল পরিবর্তন এলেও বিশ্বজুড়ে শিক্ষাব্যবস্থা সেই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। বাংলাদেশে এই ব্যবধান বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আজ আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে তার আগে বুঝে নিতে হবে, এই বদলে যাওয়া দুনিয়ায় কী কী পরিবর্তনের শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠেছে? চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রযুক্তির অগ্রগতি ঘটছে দুর্বার গতিতে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংস, ক্লাউড কম্পিউটিং আর ব্লকচেইন—এগুলো আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন নয়, বাস্তবের অংশ। এই প্রযুক্তিগুলো একসঙ্গে কাজ করে পৃথিবীকে নতুনভাবে গড়ে তুলছে। বাংলাদেশের সামনে তাই বড় প্রশ্ন, এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা শিক্ষার্থীদের কেমন করে প্রস্তুত করব?
সমাজের বৈচিত্র্য স্বীকার করে নিয়েও আমাদের একটি একীভূত ও ভবিষ্যৎ-উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে হবে, যা হবে আমাদের নিজস্ব সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণবিশ্বজুড়ে শিক্ষা সংস্কার নানা বাধায় পিছিয়ে পড়ে—প্রথাগত ধ্যানধারণা, পরীক্ষানির্ভরতা, প্রতিষ্ঠানগত জড়তা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এর কিছু কারণ। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিকতার ছাপ, তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার অসামঞ্জস্যতা, অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষকদের শঙ্কা, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, সংস্কারের গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব। আমাদের শিক্ষায় সংস্কারপ্রক্রিয়া জটিল হলেও তা আজ অপরিহার্য।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে শিক্ষা সংস্কারে ধীরগতি আর চলবে না। ক্লাসরুমে যা শেখানো হচ্ছে, তার সঙ্গে বাস্তব জীবনের চাহিদার যে বড় ফারাক, তা দ্রুত কমাতে হবে। অনেক এশীয় দেশ, যারা একসময় পরিবর্তনের প্রতি অনাগ্রহী ছিল, এখন তারা সাহসী সংস্কার করে দেখিয়েছে। সিঙ্গাপুরে শিক্ষাব্যবস্থা একসময় পরীক্ষানির্ভর ছিল, এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে দক্ষতা, নমনীয়তা ও জীবনব্যাপী শেখার ওপর। পাঠকেন্দ্রিক শিক্ষা, বহুমাত্রিক সাফল্য ও সমন্বিত মানোন্নয়ন এখন তাদের মূল কৌশল।
মালয়েশিয়া জাতীয় পরিচয়কে অটুট রেখে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য শিক্ষায় পরিবর্তন এনেছে। মালয় ভাষার সঙ্গে ইংরেজিতে দক্ষতা, এসটিইএম শিক্ষা, ডিজিটাল জ্ঞান ও সৃজনশীলতা—সবকিছুর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ২০২১ সালে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয় এবং তার পরিবর্তে ধারাবাহিক ক্লাসরুমভিত্তিক মূল্যায়ন চালু করা হয়। জাপান শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমাতে এবং সৃজনশীলতা বাড়াতে পাঠ্যক্রমের ৩০ শতাংশ হ্রাস করেছে, তৃতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করেছে এবং ‘গিগা স্কুল প্রোগ্রাম’-এর মাধ্যমে ডিজিটাল শিক্ষা জোরদার করেছে।
ভারতের ২০২০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষাব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে, যেখানে নমনীয়তা, দক্ষতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে কারিগরি প্রশিক্ষণ, কোডিং ও এআই শেখানো শুরু হয়েছে। বোর্ড পরীক্ষাগুলোতে মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে ধারণাগত বোঝাপড়া যাচাইয়ের দিকে যাওয়া হচ্ছে। বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ থাকলেও দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যৎমুখী।
বাংলাদেশে শিক্ষার প্রসার ও ভর্তি বেড়েছে—এটা অবশ্যই অগ্রগতি। কিন্তু মুখস্থনির্ভর পাঠ্যক্রম, কঠোর মূল্যায়নকাঠামো ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার অভাব এখনো আমাদের বড় বাধা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তিনটি ভিন্ন ধারায় বিভক্ত—বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম ও ধর্মভিত্তিক শিক্ষা। প্রতিটি ধারার নিজস্ব সামাজিক ভিত্তি থাকলেও তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সমাজের বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে নিয়েও আমাদের একটি একীভূত ও ভবিষ্যৎ-উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে হবে, যা হবে আমাদের নিজস্ব সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষিত মানুষেরা বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও ব্যবস্থাপনায় দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে তাঁদের ভূমিকা আরও বদলেছে—তাঁরা শুধু চাকরিজীবী নন, উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক ও ডিজিটাল পরিবর্তনের চালক। এমন ভবিষ্যৎ-প্রস্তুত প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে আমাদের উচ্চশিক্ষা নয়, গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই নতুনভাবে ভাবতে হবে। মুখস্থ আর পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা নয়, এখন দরকার নমনীয়, দক্ষতাভিত্তিক ও শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা। পাঠ্যক্রমে থাকতে হবে সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের চর্চা। পরীক্ষার চাপ কমিয়ে শেখার গভীরতা ও বাস্তব প্রয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রাথমিক স্তর থেকেই আধুনিক প্রযুক্তি—কোডিং, এআই, মেশিন লার্নিং ও ইংরেজিতে কার্যকর যোগাযোগ–দক্ষতা শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে। এসব এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার পূর্বশর্ত। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে পৃথক কারিগরি ধারার সূচনা হলে শিক্ষার্থীরা ১২ বছরের ধারাবাহিক কারিগরি শিক্ষা শেষে উচ্চশিক্ষায় যেতে পারবে। এতে শ্রমবাজারে তাদের প্রস্তুতি বাড়বে, পাশাপাশি ডিপ্লোমাধারীদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ—স্বীকৃতি ও অগ্রগতির অভাব লাঘব হবে। এমন সাহসী সংস্কার বাস্তবায়নে প্রয়োজন শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক, শিল্পপতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্মিলিত প্রয়াস।
শিক্ষা সংস্কার যেন কেবল আলোচনার বিষয় হয়েই না থাকে, বরং তা যেন জাতীয় অগ্রাধিকারে পরিণত হয়—এই উপলব্ধি এখন অত্যন্ত জরুরি। আর দেরির সুযোগ নেই। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আমাদের তরুণদের প্রস্তুত করার সময় এখনই। তবে এ সংস্কারে জাতীয় পরিচয় অটুট রাখা এবং ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ন রেখে বিচক্ষণ ও সুপরিকল্পিত অবস্থান গ্রহণই জাতির জন্য কাম্য।
● এম এম শহিদুল হাসান ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ক ষ ব যবস থ প রস ত ত পর ক ষ আম দ র ন র ভর
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।