ভারতের প্রস্তাবিত ১১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ করিডোর প্রকল্প বাতিল করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভারতের পক্ষ থেকে চলতি বছর প্রকল্প শুরু করে ২০২৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য বলা হচ্ছে। তবে গ্রিড নিরাপত্তা, পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ প্রকল্পটি পুনর্বিবেচনা করছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের পার্বতীপুর হয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বোরানগর থেকে বিহারের কাটিহার পর্যন্ত বিদ্যুৎ ৭৬৫ কেভি (কিলোভোল্ট) সঞ্চালন লাইন যাবে। বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে অতিরিক্ত এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অর্থায়নের আশ্বাস দিয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য থেকে ভারতের অন্য অংশে বিদ্যুৎ নিতে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে দিল্লি। ২০২৩ সালের মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা-সংক্রান্ত যৌথ স্টিয়ারিং কমিটির সভায় এ বিষয়ে দুই দেশের সঞ্চালন সংস্থার অংশীদারিত্বে একটি সিদ্ধান্ত হয়। যৌথ কোম্পানি প্রস্তাবিত সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করবে। এ বিষয়ে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সমীক্ষাও সম্পন্ন করে। কয়েকটি প্রস্তাবিত রুটের মধ্যে বোরনগর-পার্বতীপুর-কাটিহার রুটটি চূড়ান্ত হয়। পিজিসিবিসহ বিদ্যুৎ বিভাগের অনেক প্রকৌশলী এই লাইনের বিষয়ে বিরোধিতা করলেও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ভারত-ঘেঁষা নীতি প্রকল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার প্রকল্পটি পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটির অন্যতম ঝুঁকি হচ্ছে গ্রিড সংযুক্তি। বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যুৎ ভিন্ন মানের দুই গ্রিড একীভূত হলে একটি দেশের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের প্রভাব অপর দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন প্রকৌশলীরা। ভারতে কোনো কারণে ‘ব্ল্যাকআউট’ হলে তার তাৎক্ষণিক প্রভাব বাংলাদেশে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

আবার আর্থিক দিক থেকেও এটি দেশের জন্য বাড়তি বোঝা তৈরি করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিদ্যমান ও নির্মাণাধীন বিভিন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিপরীতে বাংলাদেশকে ২.

১৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। নতুন এই প্রকল্প হাতে নিলে তাতে বৈদেশিক ঋণ আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করছে অর্থ ও পরিকল্পনা বিভাগ।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বর্তমানে প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট, যেখানে সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াট। এ বাস্তবতায় ২০৩০ সালের আগে অতিরিক্ত বিদ্যুতের প্রয়োজন নেই। তাই মাত্র এক হাজার বিদ্যুতের জন্য ঋণ নিয়ে আরেক দেশের জন্য সঞ্চালন লাইন নির্মাণের যৌক্তিকতা দেখছেন না তারা। 

সংশ্লিষ্টদের মতে, সবচেয়ে গুরুতর শঙ্কা হলো পরিবেশগত বিপর্যয়। প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনটি যে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ আনবে, তা নির্মিত হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদের ভারতীয় অংশে। এই নদীই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর উৎস ধারা। ভারতে বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া, নদীভাঙন বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশ্লেষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সমকালকে বলেন, মাত্র এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য বিপুল আর্থিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি নেওয়া অনুচিত। আমাদের আগের অনেক বিদ্যুৎ চুক্তিই হয়েছে গোপনীয়তার মধ্যে, সেখানে জনস্বার্থের দিকটি উপেক্ষিত হয়েছে। তাই বর্তমানে প্রকল্প অনুমোদনের আগে পূর্ণ স্বচ্ছতা ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, বিদ্যুৎ করিডোরের বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ও পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনা করেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সঞ্চালন লাইন স্থাপনের আগে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। 

বর্তমানে ভারত থেকে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৭০ মেগাওয়াট আসছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে। বাকি ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সরবরাহ করছে দেশটির আদানি গ্রুপ।

এ ছাড়া গত ১৫ জুন নেপাল থেকে বাংলাদেশে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করেছে। এই বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে। এ জন্য ঢাকা-দিল্লি-কাঠমান্ডু ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই করেছে। এখন বাংলাদেশ যদি ভারতের করিডোর প্রস্তাব নাকচ করে, তাহলে নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা– এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম সমকালকে বলেন, প্রতিটি চুক্তি ভিন্ন। নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তির সময় তো এমন কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি– এর বিনিময়ে ভারতকে বিদ্যুৎ করিডোর দিতে হবে। আর ভারতের করিডোর বিষয়ে তো এখনও চুক্তি হয়নি। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব দ য ৎ সরবর হ ব দ য ৎ কর ড র ব দ য ৎ আমদ ন প রস ত ব ত র প রকল প পর ব শ র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সরকারি লবণের তথ্য পৌঁছেনি বিতরণে কারসাজির অভিযোগ

মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ্‌ বোর্ডিং কর্তৃপক্ষকে কোরবানির চামড়া সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে বিনামূল্যে লবণ সরবরাহ করা হলেও এ থেকে বঞ্চিত হয়েছে কয়েকটি এতিমখানা ও মাদ্রসা। যার কারণে কোরবানির চামড়া সংরক্ষণে নিরুৎসাহিত হয়ে অপেক্ষাকৃত কম দামে ফড়িয়াদের হাতে পশুর চামড়া তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ।
বিভিন্ন মাদ্রাসার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, যে পরিমাণ লবণ সরকার সরবরাহ করেছে, তা হয়তো যথেষ্ট নয়। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনের চেয়ে প্রাপ্ত লবণের পরিমাণ কম হতে পারে। এতগুলো মাদ্রাসা লবণের তথ্যই জানল না, এক দানা লবণও কেউ পেল না। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাদের দাবি, স্বল্পতার জন্য নয়, কারসাজির কারণেই বঞ্চিত হয়েছেন তারা। 
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের রমজান আলী এতিমখানাটি উপজেলার অন্যতম প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচিত একটি প্রতিষ্ঠান। ওখানে ৫২ জন এতিম শিক্ষার্থীর সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এবার ঈদে ওই এতিমখানাটি ৩৬টি কোরবানির পশুর (গরু) চামড়া পেয়েছিল। সেই চামড়া সস্তার বাজারে আরও কম মূল্যে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।
এতিমখানার পরিচালক সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কাসেম আক্ষেপ করে বলেন, চামড়া সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন তারা। লবণের দামসহ অন্যান্য খরচের কথা চিন্তা করে পরে নামমাত্র দামে তা বিক্রি করে দেন পাইকারদের কাছে। সরকারিভাবে এসব প্রতিষ্ঠানে চামড়া সংরক্ষণে সহায়তা দিতে বিনামূল্যে লবণ সরবরাহ করা হলেও তারা সেটি পাননি। 
একই উপজেলার পৈলনপুর দারুল উলুম সাদিলুল রাশাদ মাদ্রাসার সুপার, উপজেলা কওমি মাদ্রাসা ঐক্য পরিষদের সভাপতি মাওলানা মঈনুদ্দিন বলেন, তাঁর মাদ্রাসায় ২৩২টি গরুর চামড়া এসেছিল। লবণের জন্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। এতগুলো চামড়ার জন্য অনেক লবণ দরকার ছিল। সেই খরচ পোষাতে পারতেন না তারা। এই উপজেলার ৭৩টি কওমি মাদ্রাসার কোনোটিতেই সরকারের দেওয়া বিনা মূল্যের লবণ সরবরাহ করা হয়নি।
উপজেলার বাদাঘাট এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী স্বপন মিয়া ঈদের পরদিন জনৈক ব্যক্তিকে ফোনে জানান, ৫০০ টাকা করে দিয়ে লবণ পেয়েছেন ৫০ বস্তা। তাঁর এ কথোপকথনের  রেকর্ড আছে।
রোববার বিকেলে স্বপন মিয়ার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁকে ৫০ বস্তা লবণ বিনামূল্যেই দিয়েছেন। লেবার ও নৌকা খরচসহ ৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে তাঁর।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাসেম বলেন, ১৫০ বস্তা লবণ তাঁর উপজেলার জন্য দেওয়া হয়েছিল। এই লবণ সব মাদ্রাসায় দেওয়া সম্ভব হয়নি। দোয়ারাবাজার ইউএনও অরূপ রতন সিংহ বলেন, সরকারের বিনামূল্যের লবণ পৌঁছে দিতে ইউনিয়ন পরিষদকে কাজে লাগানো হয়েছে। পরিবহন সুবিধার জন্য ইউনিয়ন পরিষদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। জেলা প্রশাসকের ব্যবসা বাণিজ্য শাখার একজন কর্মচারী জানান, লবণ প্রতিটি উপজেলায় সরবরাহ করা হয়েছে। পরিবহন খরচসহ হিসাব করে মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। 
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের সুনামগঞ্জের ডেপুটি ম্যানেজার মো. আফিক্স বলেন, সুনামগঞ্জে ৩০ হাজার ৪৮৯টি চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। এজন্য সরকার বিনামূল্যের ১২০ টন লবণ সরবরাহ করেছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানালেন, এই লবণ দিয়ে কমপক্ষে ১৫ দিন চামড়া সংরক্ষণে রাখা সম্ভব হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশকে ৬৪ কোটি ডলার ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক
  • দুই প্রকল্পে ৬৪০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক
  • সরবরাহ পর্যাপ্ত, দামও নাগালে
  • চট্টগ্রামে চার গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে মাস্ক
  • ধামরাইয়ে ৬টি ফিডারের বিদ্যুৎ সরবরাহ ৩ ঘণ্টা বন্ধ থাকবে
  • সিডনিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রদর্শনীতে ১০ বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান
  • ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: বিশ্ববাজারে বাড়ল জ্বালানি তেলের দাম
  • দোষ স্বীকারে রাজি চিকিৎসক
  • সরকারি লবণের তথ্য পৌঁছেনি বিতরণে কারসাজির অভিযোগ