ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের সাম্প্রতিক হামলাগুলো কেবল সামরিক পরিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং রূপ নিয়েছিল কৌশলগত আক্রমণে।

এর লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলি রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভিত্তি অর্থনৈতিক ও আর্থিক অবকাঠামোগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া। প্রতিশোধমূলক আক্রমণ দিয়ে শুরু হলেও এটি বহুমাত্রিক আক্রমণ অভিযানে পরিণত হয়েছিল। শুধু তাৎক্ষণিক ক্ষতি করাই এর লক্ষ্য ছিল না, বরং ইসরায়েলের যুদ্ধ-অর্থনীতির আর্থিক ও লজিস্টিক কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে দিয়েছিল।

ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ফর ইসরায়েলের (ইসরায়েলি বন্ডস নামে পরিচিত) প্রধান নির্বাহী দানি নাভেহের বাড়ি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলাটি সে কারণে মোটেই কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। নাভেহ শুধু ইসরায়েলের আমলাতন্ত্রের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব নন, দেশটির বৈশ্বিক বন্ড বিক্রি ব্যবস্থার একজন স্থপতিও।

২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে তাঁর নেতৃত্বে প্রবাসী ইহুদি এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ৫ বিলিয়নের বেশি ডলারের মূলধন ইসরায়েলে এসেছে। এর মধ্যে ১.

৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে। এই বন্ডগুলো যুদ্ধরত ইসরায়েলের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নাভেহর বাড়িতে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে তেহরান মূলত ইসরায়েলের ঋণ সংগ্রহব্যবস্থার সবচেয়ে নাজুক জায়গাটিতে আঘাত করেছে। সেটি হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা।

আরও পড়ুনইরানে ইসরায়েল যেভাবে ধরা খেল২৫ জুন ২০২৫

এই আক্রমণের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাজারের প্রতি ইরান একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। সেটি হলো ইসরায়েলের কোনো অর্থনৈতিক বা আর্থিক কেন্দ্রই নিরাপদ নয়। এটি শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ের আক্রমণ নয়। ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন আর্থিক কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টাও। একই সঙ্গে তেহরানের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল তেল আবিবের অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইফার কৌশলগত বন্দর ও তেল পরিশোধনাগার। ইসরায়েলের আর্থিক অবকাঠামো ক্ষতি করার এটা ইরানের পরিকল্পিত নীতি। জ্বালানি পরিশোধনাগারে সাইবার ও ক্ষেপণাস্ত্র—দুই ধরনের আক্রমণ করেই শিল্প ও বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত জ্বালানি সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে ইরান।

গাজা যুদ্ধের ব্যয়ের কারণে ইসরায়েল এরই মধ্যে চাপে আছে। এখন জ্বালানির উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইসরায়েলকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ইসরায়েলের অর্থনীতির ওপর সবচেয়ে বড় আঘাতটি এসেছিল বৈশ্বিক সমুদ্র পরিবহন খাত থেকে। গত ২০ জুন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম কনটেইনার শিপিং কোম্পানি মের্কস ইসরায়েলের হাইফা বন্দরে সব ধরনের জাহাজ ভেড়া স্থগিত করে দিয়েছিল।

হাইফা হলো ইসরায়েলের ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের প্রধান বন্দর। এটি শিল্প যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও কৌশলগত জিনিসপত্র আমদানির কেন্দ্র। এই বন্দর বন্ধ হলে ইসরায়েলি অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়ে এবং মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বেড়ে যায়। এরই মধ্যে দেশটিতে আমদানি খরচ বেড়ে যায় এবং পণ্য মজুতের ঘাটতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়।

ইরানের সম্ভাব্য প্রতিশোধের ঝুঁকির মুখে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কোম্পানিটি। বাস্তবে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ক্ষেত্রে ইসরায়েলের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছিল। কোনো আনুষ্ঠানিক নৌ অবরোধ ঘোষিত না হলেও, এর প্রভাব ছিল কার্যত অবরোধের সমান। ইরানের আক্রমণের কারণে ইসরায়েলের বাণিজ্যে যে বিঘ্ন তৈরি হয়েছিল, সেটা লোহিত সাগরে হুতিদের অবরোধের কারণে সৃষ্ট সংকটের চেয়ে বহুগুণ বেশি। বাব আল-মান্দাব শুধু কার্গোর রুট বদলে দিয়েছিল। মের্কসের হাইফা ত্যাগ নৌ–বাণিজ্যের সব পথই বন্ধ করে দিয়েছিল।

হাইফা হলো ইসরায়েলের ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের প্রধান বন্দর। এটি শিল্প যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও কৌশলগত জিনিসপত্র আমদানির কেন্দ্র। এই বন্দর বন্ধ হলে ইসরায়েলি অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়ে এবং মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বেড়ে যায়। এরই মধ্যে দেশটিতে আমদানি খরচ বেড়ে যায় এবং পণ্য মজুতের ঘাটতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়।

আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫

ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হওয়ার পর মের্কস আবারও হাইফা বন্দর দিয়ে কনটেইনারবাহী জাহাজ চলাচলে রাজি হয়। তথাপি সংঘাতের সময় ইসরায়েলের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা অনেক বড়।

এর বিপরীতে, ইরান ন্যূনতম খরচ করে সর্বোচ্চ ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ইরান ক্ষেপণাস্ত্র খাতে আনুমানিক ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এটি মূলত কৌশলগত বিনিয়োগ। এর বাইরে মুদ্রাবাজারে কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ, অপ্রচলিত বাজারে তেল বিক্রির কূটনীতি এবং বিভিন্ন খাতে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইরান অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে চলেছে। ইরান বহু বছর ধরেই নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের মধ্যে বাস করছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে দশকের পর দশক টিকে থাকার সক্ষমতা দেশটি গড়ে তুলেছে।

দীর্ঘদিন ধরে ব্যাঘাত ঘটতে থাকলে ইসরায়েলের অর্থনীতি ও রাজনীতি ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু ইরান এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যেটা সংঘাতের মধ্যেও টিকে থাকবে। ইরানের কৌশলগত ধৈর্য কয়েক দশকের চাপের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। এটা ইরানকে গভীর জাতীয় সংকল্প দিয়েছে। আর এটিই ইসরায়েলি রাষ্ট্রের যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য ও যুক্তিকে পরাভূত করার হুমকি তৈরি করছে। ইসরায়েলের অর্থনৈতিক সংকট শুধু ব্যয়ের কারণে নয়, বরং আস্থার সংকটে তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন২৫০০ বছরের পুরোনো দুশমনি: ইসরায়েল কি ‘মরদখাই’? ইরান কি ‘হামান’?১৭ জুন ২০২৫

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি মুদ্রার মান ধারাবাহিকভাবে অবমূল্যায়িত হয়েছে। বন্ডের সুদের হার বেড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। ছোট ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঋণের মানেও অবনমন ঘটেছে।

শহরগুলোতে কাজের ঘণ্টা কমে যাওয়ায় সেই ধাক্কা উৎপাদনে এবং রাজস্ব আহরণে এসে লেগেছে। বেকারত্ব বেড়েছে। বেড়েছে জন–অসন্তোষ। অন্যদিকে সরকার মূল্য সংযোজন কর বাড়িয়েছে, সামাজিক ব্যয় কাটছাঁট করেছে। দেশীয় উৎস থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে। সরকারের এসব পদক্ষেপ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচি নয়, এটি অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় জরুরি ব্যবস্থা।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ ব্যয় কমিয়ে সামরিক খাতে ব্যয়ের জোগান দেওয়া হচ্ছে। মানব পুঁজির ক্ষয় হচ্ছে। পুঁজি ও মানবসম্পদের দেশান্তর দ্রুততর হচ্ছে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রতি আস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে।  অর্ধশতকের বেশি বছরের মধ্যে এই প্রথম ইসরায়েল অস্ত্রের জন্য নয়, বরং নগদ অর্থের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে আবেদন জানিয়েছে। এটি দেশটির অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার প্রতিচ্ছবি।

আহমেদ আলকারউত রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ ক শলগত লক ষ য আর থ ক সরক র অবর ধ আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

সাইপ্রাসে কি ‘মিনি ইসরায়েল’ গড়ে উঠছে

গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি বিনিয়োগকারীরা যেভাবে বাড়ি-জমি কিনছেন, তা নিয়ে সে দেশের জনমনে এবং রাজনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে লারনাকা ও লিমাসল এলাকায় ইসরায়েলিদের জায়গা–জমি কেনার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে।

বিরোধী দলের নেতারা বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইসরায়েল যেন ধীরে ধীরে সাইপ্রাসে তাদের একধরনের ‘অঘোষিত উপস্থিতি’ তৈরি করে ফেলছে।

এখন গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। ফলে জনসংখ্যাগত ভারসাম্য ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাসের স্বঘোষিত তুর্কি প্রজাতন্ত্রের (টিআরএনসি) দৃষ্টিকোণ থেকে এটিকে হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

‘নতুন ইসরায়েল’—এ কথা এখন গ্রিক সাইপ্রাসের রাজনীতিতে জোরালোভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। দেশটির প্রধান বিরোধী দল একেলের নেতা স্টেফানোস স্টেফানু এই পরিস্থিতিকে ‘পরিকল্পিত বসতি স্থাপন কৌশল’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি সতর্ক করেছেন, গ্রিক সাইপ্রাস যেন ধীরে ধীরে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

জনসভায় দেওয়া বক্তৃতা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একেলের নেতারা গ্রিক সাইপ্রাসকে এখন ‘ইসরায়েলের দখলে নতুন দেশ’ বলেও আখ্যায়িত করছেন। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ইসরায়েলি উপস্থিতি নিয়ে সেখানে একটি গুরুতর রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে।

স্টেফানু দাবি করেছেন, ইসরায়েলি নাগরিকেরা সেখানে যে বসতি গড়ে তুলছেন, তা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত নয়। এর মধ্যে রয়েছে শুধু ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য আবাসন প্রকল্প, তাঁদের নিজস্ব শিক্ষা, খাবার, উপাসনালয় ও নিরাপত্তাব্যবস্থা। স্থানীয় সমাজের সঙ্গে মেলামেশার পরিবর্তে নিজেদের আলাদা করে রাখার মতো জায়গা বানাচ্ছেন তাঁরা। এর ফলে এই বসতির বাসিন্দারা স্থানীয় সংস্কৃতি বা সমাজে মিশে যাচ্ছেন না, বরং নিজেদের আলাদা একটি ‘মিনি ইসরায়েল’ বানিয়ে নিচ্ছেন।

এই বসতি স্থাপনের পেছনে সক্রিয় সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘ছাবাদ’। এটি একটি আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় অতিরক্ষণশীল ইহুদি ধর্মীয় আন্দোলন। ছাবাদ ইতিমধ্যে গ্রিক সাইপ্রাসে সিনাগগ (ইহুদি উপাসনালয়), কিন্ডারগার্টেন (শিশু শিক্ষাকেন্দ্র), কোশার খাবারের দোকান এবং কবরস্থানের মতো কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে।

বিশ্লেষকদের মত হলো, ইসরায়েলি সম্প্রদায় শুধু পর্যটক বা অস্থায়ী বাসিন্দা নন, তাঁরা গ্রিক সাইপ্রাসে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত উপস্থিতি গড়ে তুলছেন। তাঁরা বলছেন, সিনাগগ, কবরস্থান, কোশার খাবারের দোকান, কিন্ডারগার্টেন ইত্যাদি অবকাঠামো স্থাপন আসলে একটি স্থায়ী প্রভাব বিস্তারের অংশ, যা ভবিষ্যতের কোনো সংকটকালে সামাজিক প্রভাব বা গোপন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে।

তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাস এই পরিস্থিতিকে বহুস্তরবিশিষ্ট ঝুঁকি হিসেবে দেখছে। তুরস্কের দৈনিক পত্রিকা মিল্লিয়েত-এর এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষকেরা বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে কেবল জনসংখ্যাগত পরিবর্তন নয়, বরং একটি জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবেও দেখা উচিত।

আঙ্কারার সোশ্যাল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এমেতে গোজুগোজেল্লি সেখানকার সংবাদমাধ্যম মিল্লিয়েত-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এটি কেবল জমি কেনাবেচার বিষয় নয়—এটি নিরাপত্তা, গোয়েন্দা এবং কূটনৈতিক উদ্বেগের বিষয়।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, এমন ধর্মীয় গোষ্ঠী, যারা শক্তিশালী মতাদর্শিক নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করে, তারা নজরদারি, প্রচার এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মতো কাজও করতে পারে।

তিনি বিশেষভাবে ছাবাদ সংগঠনের কার্যক্রমের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কারণ, এই সংগঠনের প্রভাব এরই মধ্যে তুর্কি সাইপ্রাস পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বাহ্যিকভাবে নিরীহ দেখালেও এই ধরনের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে অনেকে বৃহত্তর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। এর মধ্যে অনেকে ইসরায়েলের ডায়াসপোরা ডিপ্লোম্যাসি, গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম বা সমাজে মতাদর্শগত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা আছে বলে মনে করছেন।

গোজুগোজেল্লি সতর্ক করে বলেন, এই গোষ্ঠীগুলো ‘সফট পাওয়ার’ (নরম কৌশলগত শক্তি) হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তারা এমন বিকল্প জনসমষ্টি তৈরি করতে পারে, যারা ইসরায়েলের নীতির প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। এর ফলে গ্রিক ও তুর্কি সাইপ্রাস উভয়ের রাজনৈতিক অখণ্ডতা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ভূরাজনৈতিক প্রভাব

এ ঘটনাগুলো এমন সময়ে ঘটছে, যখন তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সামুদ্রিক সীমা নিয়ে নানা জটিল বিরোধের মুখে রয়েছে। ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাস নিয়ে গঠিত একটি কৌশলগত জোটকে বিশ্লেষকেরা তুরস্কের আঞ্চলিক প্রভাব প্রতিরোধে গঠিত প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে দেখছেন। এই জোট মূলত গ্যাস অনুসন্ধান, যৌথ সামরিক মহড়া ও প্রতিরক্ষা সমন্বয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি তুরস্ককে সামুদ্রিকভাবে কার্যত ঘিরে ফেলেছে।

অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাসে নতুন ইসরায়েলি বসতিগুলো এই বৃহত্তর কৌশলগত নেটওয়ার্কের অংশ হতে পারে। যদি লারনাকা ও লিমাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে সামরিক পর্যায়ের নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়, তাহলে তা তুরস্কের নৌ ও বিমান কার্যক্রম নজরদারির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

নাগরিক নাকি গোয়েন্দা

পর্যবেক্ষকদের মতে, গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলিদের আগমনকে শুধু সাধারণ অভিবাসন ভেবে ভুল করা যাবে না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো গোপনে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, মানচিত্রভিত্তিক পর্যবেক্ষণ বা ভবিষ্যতের সংঘাতকালীন তৎপরতার জন্য প্রস্তুত আছেন।

আইনবিশেষজ্ঞ এমেতে গোজুগোজেল্লি বলেন, ‘এটি নিরীহ অভিবাসনের ঢেউ নয়।’ তিনি নীতিনির্ধারকদের সতর্ক করে বলেছেন, এ ধরনের আদর্শিকভাবে সংযুক্ত ও সংগঠিত জনসংখ্যা শুধু নিরাপত্তাজনিত ভারসাম্যই নয়, দ্বীপের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিঘ্নিত করতে পারে।

ইসরায়েলিদের জমি কেনা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগ

ইসরায়েলিদের জমি কেনার পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে তা এখন মালিকানা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে যদি কোনো শান্তিচুক্তি হয়, তাহলে এসব জনসংখ্যাগত ও অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ব্যবহার করে নতুন সীমানা দাবি বা রাজনৈতিক শর্ত হাজির করা হতে পারে।

তাঁরা এটিও বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যেসব একতরফা প্রতিরক্ষা ও বসতি স্থাপন চুক্তি হচ্ছে, সেগুলো ১৯৬০ সালের ‘ট্রিটি অব গ্যারান্টি’ বা ‘গ্যারান্টি চুক্তি’ লঙ্ঘন করতে পারে। এই চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক, গ্রিস ও যুক্তরাজ্য সাইপ্রাসের নিরাপত্তার গ্যারান্টর (নিশ্চয়তাদানকারী) দেশ। ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে এই একতরফা চুক্তিগুলো দ্বীপের শক্তির ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।

তুরস্কের জন্য নজরদারি ও প্রতিরোধ বাড়ানোর আহ্বান

গোজুগোজেল্লি পরামর্শ দিয়েছেন, তুরস্ক এবং উত্তর সাইপ্রাসকে পূর্ব উপকূল বরাবর নজরদারি এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সীমান্তের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে ড্রোন দিয়ে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি চালানো উচিত। ছাবাদের মতো সংগঠনের উপস্থিতি কূটনৈতিক পর্যায়ে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতিকে দক্ষিণে দখল হয়ে থাকা তুর্কি সম্পত্তির অনিরসনকৃত ইস্যুর সঙ্গে যুক্ত করে দেখতে হবে। এতে আইনি ও রাজনৈতিক বৈপরীত্যগুলোও স্পষ্ট হবে।

*তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টার্কি টুডে থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সাইপ্রাসে কি ‘মিনি ইসরায়েল’ গড়ে উঠছে