Samakal:
2025-07-13@09:52:46 GMT

শহীদ পরিবারে বিড়ম্বনাই সম্বল

Published: 13th, July 2025 GMT

শহীদ পরিবারে বিড়ম্বনাই সম্বল

গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পার হচ্ছে। প্রায় সাড়ে ৮০০ তরতাজা মানুষের শহীদের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটে, যাদের অনেকে নিচের তলার মানুষ। সরকার শহীদ ও আহতদের আর্থিক এবং অন্যান্য সহযোগিতা দিলেও এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীরা একাধিকবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের অনেকে এখনও হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। দু-একবার হাসপাতাল থেকে রাস্তায় নেমেও তারা আন্দোলন করেছেন। 

এরই মধ্যে শহীদের পরিবারে দেওয়া আর্থিক সহযোগিতা নিয়েও বিড়ম্বনা দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো পরিবারে ভাঙন পর্যন্ত গড়িয়েছে। ৫ আগস্ট সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার সামনে গুলিতে নিহত হন তারেক আহমদ, যিনি ছিলেন তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। জুলাই ফাউন্ডেশন তারেকের মাকে ২০ ভাগ এবং স্ত্রীকে ৮০ ভাগ আর্থিক সহায়তা বণ্টন করে দেন। এরই মধ্যে তারেকের স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছেন। গতকাল সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ রকমই চিত্রই উঠে এসেছে। শুধু শহীদ তারেকের পরিবার নয়, বহু পরিবারে বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়েছে।  

এই বিড়ম্বনা যে দেখা দেবে তা জানাই ছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে বহুবিধ উদ্যোগ নেওয়াও সম্ভব ছিল। যেমন– আন্দোলনের মাঠে যারা শরিক ছিলেন, তাদের অনেকে মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত হয়েছেন। তা ছাড়া যেসব পরিবার তাদের সন্তান হারিয়েছে, তাদেরও অনেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যেসব পরিবার এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাদের সবার জন্য যেমন যথাযথ পুনর্বাসন কর্মসূচি গৃহীত হয়নি, তেমনি কোনো মানসিক চিকিৎসারও ব্যবস্থা হয়নি তাদের জন্য।

প্রাণের বিনিময়ে অর্থ দিয়ে কখনও কারও যথাযথ ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব নয়। ঘরবাড়ি নির্মাণ করে দিলেও ঘাটতি পূরণ হয় না। বিশেষত কোনো মানসিক ধকল ভুক্তভোগী সারাজীবনই কাটিয়ে উঠতে পারে না। তার জন্য দরকার পড়ে যথাযথ মানসিক চিকিৎসা। গণঅভ্যুত্থানে সন্তান হারিয়ে যেসব পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়েছে, তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা জরুরি ছিল। 

এর বাইরে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব এবং সরকারের পক্ষ থেকে ভুক্তভোগী পরিবারের খোঁজ নেওয়াটাও দরকার। জুলাই ফাউন্ডেশন এ দায়িত্বটুকু যথাযথভাবে পালন করতে পারে। পরিবারগুলোর আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি স্থানীয় হাসপাতালে তাদের যুক্ত করে দেওয়া এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা জরুরি। সরকার ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। 

সরকারের বাইরে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে এমন যে কোনো রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের এই ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর খোঁজ রাখা নৈতিক দায়িত্ব। কারণ, তাদের রক্তের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যবিষয়ক যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোও শহীদের পরিবারের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে। এর বাইরে ব্যক্তি ও প্রতিবেশী হিসেবে স্থানীয় লোকজনও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের পাশে থেকে কিছুটা হলেও শক্তি ও মনোবল জোগাতে পারে। 

গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষায় দেশ নতুনভাবে গড়ে উঠবে বলে বিপুল মানুষের প্রত্যাশা ছিল। অভ্যুত্থানের পর যে ধরনের সরকার গঠিত হয়েছে, তাতে পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে জাতি বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না। গত দু-এক দিনের ঘটনায় দেশের মানুষ আরও বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। অথচ এক বছর আগে প্রায় সাড়ে ৮০০ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে, কিন্তু এক বছর না পেরোতেই দেশ পুরোনো পথে ধাবিত হচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, রাজনৈতিক দল ও ক্ষমতার বলয় এ দেশের আমূল পরিবর্তন চায় না। তাদের এসব তৎপরতা শহীদের রক্তের সঙ্গে প্রতারণা। আশা করি, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনে মৌলিক কিছু বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হবে। 

ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন র র জন ত ক র পর ব র পর ব র র সরক র র আর থ ক র জন য য সব প ত হয় ছ

এছাড়াও পড়ুন:

মব সন্ত্রাস নিয়ে সমাজের আতঙ্ক ও রাষ্ট্রের নীরবতা

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে গত প্রায় এক বছরে ক্রমবর্ধমান মব ভায়োলেন্স বা মব সন্ত্রাসের ঘটনা গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি করছে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, অকার্যকর সুশাসন এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা আইনহীন ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির’ জন্ম দিয়েছে, যার সুযোগ নিচ্ছে উগ্রবাদী বিভিন্ন সংঘবদ্ধ উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠী। বিগত আমলের বিচারহীনতার সংস্কৃতিরই যেন ধারাবাহিকতা এই মব সন্ত্রাস। 

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংস মব হামলায় ১৭৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর বাইরেও নাটক, সিনেমা, বইমেলা, পত্রিকা, ক্রীড়াক্ষেত্র, মাজার ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হয়েছে সংঘবদ্ধ আক্রমণ। এসব মব সন্ত্রাসের লক্ষ্য একটাই, তা হচ্ছে সমাজের প্রগতিশীল ও বহুত্ববাদী মূল্যবোধকে দমন করা, গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ ব্যাহত করা।

সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে এক নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া যেমন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি, তেমনি ঢাকায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে জুতার মালা পরিয়ে অপমান করার ঘটনাও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও আইনের প্রতি চূড়ান্ত অবজ্ঞার ইঙ্গিত দেয়। 

এসব ঘটনার পেছনে শুধু জনরোষ নয়; আছে সংগঠিত উস্কানি ও উদ্দেশ্যমূলক সহিংসতা। পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে যখন অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিজেরাই মব সন্ত্রাসকে কার্যত স্বীকৃতি দিয়ে বসেন। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ‘মব’কে বলেছেন ‘প্রেশার গ্রুপ’, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম মবের কর্মকাণ্ডকে ‘জনতার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। 

এসব বক্তব্য শুধু দায় এড়ানোর পথ তৈরি করে না, বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিক সহিংসতাকে অনুমোদন দেওয়ার ইঙ্গিত দেয়– যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য গভীর উদ্বেগজনক। মবের ‘ন্যায়বিচার’ যদি মেনে নেওয়া হয়, তবে সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা ও আইনের শাসনের প্রয়োজনই-বা থাকে কোথায়?

সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা হচ্ছে ধর্মের দোহাই দিয়ে মব সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো। অসংগত, অসত্য বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগের ভিত্তিতে ধর্মকে অস্ত্র বানিয়ে গণআক্রমণের যে সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে, তা শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য নয়; গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক বড় হুমকি।

আরও একটি বিপজ্জনক প্রবণতা হচ্ছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হুমকি দেওয়া। নাটক-সিনেমা-গান-নৃত্যকে যারা ‘ইসলামবিরোধী’ বলে চিহ্নিত করছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বিভিন্ন হলেও কৌশল প্রায় একই। গত ফেব্রুয়ারিতে খুলনার এক নাট্যোৎসব বন্ধ করে দেওয়া হয় ধর্মীয় সংগঠনের চাপে। একই মাসে মৌলভীবাজারে এক বইমেলায় হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় কয়েকজন তরুণ লেখকের বই। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর এই আক্রমণ একটি পরিকল্পিত ‘নীরব দমন নীতি’র অংশ, যেখানে রাষ্ট্র সক্রিয় না হয়ে মৌন সম্মতি জানিয়ে যাচ্ছে।

নারীর প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, নারীকে অসম্মান করার প্রবণতাও বাড়ছে। তা ছাড়া নারী ক্রীড়াবিদদের ওপর হামলা আরও বেশি প্রকাশ্য ও হিংস্র হয়েছে। লেখক, সাংবাদিক ও ব্লগারদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও আজ সংকটের মুখোমুখি। লেখক, অনুবাদক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের নানা হুমকি দেওয়া হচ্ছে। 

অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসন ঘটনা ঘটার পর আসে, কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত হয় না, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তা অচল পড়ে থাকে। এমনকি মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা প্রায়ই বলেন, ‘ধর্মীয় আবেগে উত্তেজিত হয়ে কিছু লোক এ কাজ করেছে।’ এটি আসলে অপরাধকে আড়াল করা এবং ভবিষ্যতের জন্য আরও বড় সহিংসতার জায়গা তৈরি করা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি একদিকে অপরাধীদের উৎসাহিত করে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে করে নিরুপায় ও আতঙ্কিত।

এই প্রশ্ন এখন ঘুরেফিরে আসছে, সরকার কি নিজেই এই উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আছে? নাকি কোনো রাজনৈতিক স্বার্থে, যেমন নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কৌশল হিসেবে, এই নীরবতা বজায় রাখছে? 

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে নারী অধিকারের প্রশ্নে এই সহিংসতা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপি সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে বাংলাদেশে সামাজিক সহনশীলতা হ্রাস ও ‘পাবলিক ফিয়ার’ বৃদ্ধির তথ্য এসেছে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতারও জন্য হুমকি।

এই সংকট মোকাবিলায় নাগরিক সমাজ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, সংস্কৃতিকর্মী, নারী সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মব সন্ত্রাস, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তা মিলে বাংলাদেশ এক নীরব দুর্যোগের দিকে এগোচ্ছে। আজ যদি আমরা চুপ থাকি, আগামীকাল আমাদের সন্তানদের জন্য একটি ভয়ংকর সমাজ রেখে যাব– যেখানে মতপ্রকাশ নেই, নারীর স্বাধীনতা নেই, সংস্কৃতির চর্চা নেই। রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয়, তবে নাগরিকদের দায়িত্ব সেই শূন্যতা পূরণ করা। কথা বলতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে। কারণ নীরবতা মানেই সম্মতি, আর সম্মতি মানেই সহিংসতার অংশীদার হওয়া। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র গঠন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা মুখ থুবড়ে পড়বে। 

আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কবি ও মানবাধিকারকর্মী 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রতিবাদের অবিস্মরণীয় কণ্ঠস্বর
  • মব সন্ত্রাস নিয়ে সমাজের আতঙ্ক ও রাষ্ট্রের নীরবতা
  • ‘সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশের’ শর্তে রাজসাক্ষী মামুনকে ক্ষমা, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
  • ‘সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশের’ শর্তে রাজসাক্ষী মামুনকে ক্ষমার আদেশ ট্রাইব্যুনালের
  • ১১ জুলাইকে ‘প্রথম প্রতিরোধ দিবস’ ঘোষণা উপদেষ্টা আসিফের
  • গণঅভ্যুত্থানে কুবি শিক্ষার্থীদের অবদানের স্বীকৃতি, ১১ জুলাইকে ‘প্রথম প্রতিরোধ দিবস’ ঘোষণা
  • দেশে যেন নতুন স্বৈরাচারের জন্ম না হয় : নাহিদ 
  • আমাদের নতুন সংবিধান প্রয়োজন: নাহিদ ইসলাম
  • নওগাঁয় ‘জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণকাজ উদ্বোধন