গাজায় ত্রাণ বিতরণে ইসরায়েলের ওপরই ভরসা ট্রাম্পের
Published: 30th, July 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, গাজায় খাবার বিতরণকেন্দ্রগুলো ইসরায়েলই পরিচালনা করবে। গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এমন ইঙ্গিত দেন।
সমালোচকেরা বলছেন, এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলে গাজায় ইসরায়েলি দখলদারি আরও দৃঢ় হবে ও ত্রাণপ্রত্যাশীদের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হবে।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস গাজায় বিতরণ করা খাদ্যসহায়তা চুরি করে বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে ইসরায়েল। গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প এ অভিযোগকেই নতুন করে সামনে আনেন। বলেন, হামাস গাজায় বিতরণ করা খাদ্যসহায়তা চুরি করে।
তবে বিভিন্ন মানবিক সহায়তা সংস্থা ও জাতিসংঘ কর্মকর্তারা আগেই ইসরায়েলের এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এমনকি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ইসরায়েলি কর্মকর্তাও নিউইয়র্ক টাইমসের মতো সংবাদমাধ্যমগুলোকে বলেছেন, খাদ্যসহায়তা হামাসের কাছে পৌঁছাচ্ছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কোথায় ও কখন এ কেন্দ্রগুলো তৈরি হবে, সেটা নিশ্চিত নয়। ইসরায়েল সেগুলো সরাসরি চালাবে, নাকি জিএইচএফ নামের ত্রাণ সংস্থার মাধ্যমে পরিচালনা করবে, তা–ও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল–সমর্থিত বিতর্কিত সংস্থা জিএইচএফের বিরুদ্ধে গাজায় অনিরাপদ কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ আছে।গতকাল এয়ারফোর্স ওয়ানে বসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, অনেক কিছুই চুরি হয়ে গেছে। তারা টাকা পাঠায়, খাবার পাঠায়। আর হামাস সেগুলো চুরি করে। এ এক ছলচাতুরীর খেলা।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাণ বিতরণকে ইসরায়েল যেভাবে সামলাচ্ছে, সে ব্যাপারে তিনি আস্থা রাখেন। যদিও এ কার্যক্রম এতটা বিশৃঙ্খল যে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালিয়েছেন ইসরায়েলি সেনারা।
আরও পড়ুনগাজায় কেউ না খেয়ে নেই—দাবি নেতানিয়াহুর, দ্বিমত ট্রাম্পের১৮ ঘণ্টা আগেট্রাম্প বলেন, ‘আমরা (নতুন বিতরণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায়) ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করতে চলেছি। আমরা বিশ্বাস করি, তারা এটাকে ভালোভাবে সামাল দেবে। তারা খাবার বিতরণকেন্দ্রগুলো পরিচালনা করতে চায়, যেন খাবার যথাযথভাবে বিতরণ হয়।’
আমরা (নতুন বিতরণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায়) ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করতে চলেছি। আমরা বিশ্বাস করি, তারা এটাকে ভালোভাবে সামাল দেবে। তারা খাবার বিতরণকেন্দ্রগুলো পরিচালনা করতে চায়, যেন খাবার যথাযথভাবে বিতরণ হয়।ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন প্রেসিডেন্টকোথায় ও কখন এসব কেন্দ্র তৈরি হবে, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ইসরায়েল সেগুলো সরাসরি চালাবে, নাকি জিএইচএফ নামের বিতর্কিত ত্রাণ সংস্থার মাধ্যমে পরিচালনা করবে, তা–ও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল–সমর্থিত জিএইচএফের বিরুদ্ধে গাজায় অনিরাপদ কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ আছে।
ট্রাম্পের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, গাজায় জাতিসংঘ ও তাদের সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে আবারও ত্রাণসহায়তা বিতরণ শুরু করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখনো প্রস্তুত নয়।
আরও পড়ুনগাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল: বলছে ইসরায়েলভিত্তিক দুই মানবাধিকার সংস্থা২৮ জুলাই ২০২৫ইসরায়েল গত মে মাস থেকে গাজায় অবরোধ আরও কঠোর করেছে। এখন সেখানে শুধু জিএইচএফের মাধ্যমে কিছু খাদ্য ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। গাজার দক্ষিণাঞ্চলে সংস্থাটির চারটি বিতরণকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছাতে বা সেখান থেকে বের হতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে কয়েক শ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
আরও পড়ুনক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর মরিচের গুঁড়া ছুড়লেন ইসরায়েলি সেনারা২১ জুলাই ২০২৫এ অবরোধের কারণে গাজায় ইসরায়েল আরোপিত নজিরবিহীন খাদ্যসংকট তৈরি হয়েছে। ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ইতিমধ্যে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
সমালোচকেরা বলছেন, খাবার বিতরণের কাজ ইসরায়েলি সেনাদের হাতে দিলে ত্রাণপ্রত্যাশীরা আরও বেশি করে নৃশংসতার শিকার হতে পারেন।
ইসরায়েল গত মে মাস থেকে গাজায় অবরোধ আরও কঠোর করেছে। এখন সেখানে শুধু জিএইচএফের মাধ্যমে কিছু খাদ্য ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। গাজার দক্ষিণাঞ্চলে সংস্থাটির চারটি বিতরণকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছাতে বা সেখান থেকে বের হতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে কয়েক শ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।ইসরায়েল দাবি করছে, গাজায় আসলে কোনো অনাহার বা দুর্ভিক্ষ নেই। এসব কথা হামাসের মিথ্যা প্রচারণা। অথচ বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সেখানে মানুষ না খেয়ে আছে। গাজার কঙ্কালসার শিশুদের ছবিও এখন গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে।
গত সোমবার ট্রাম্প স্বীকার করেছেন যে গাজায় সত্যিই মানুষ না খেয়ে আছেন। তবে তিনি ইসরায়েলের কোনো সমালোচনা করেননি। বরং মঙ্গলবার তিনি আবারও বলেন, খাবার দেওয়ার দায়িত্ব ইসরায়েলের হাতেই থাকা উচিত।
আরও পড়ুনগাজায় অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ১ লাখ শিশু: ‘৯ মাসে একটিও ডিম খাইনি’২৭ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুনইসরায়েল যেসব শর্ত না মানলে সেপ্টেম্বরে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে যুক্তরাজ্য১০ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব তরণক ন দ র য ক তর ষ ট র খ ব র ব তরণ জ এইচএফ র ক ন দ রগ ল ইসর য় ল স ইসর য় ল র ন ইসর য় ল র কর ছ
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল
যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তখন তা শুধু ক্ষুধার নয়, বরং সমাজের ভাঙনেরও প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এ অবস্থায় মানুষ আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে আনে। কেউ গোপনে রান্না করে; কেউ আত্মীয়দের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে, কোনো পরিবার হয়তো খাবারের জন্য তাদের দাদিমার গয়না বিক্রি করে দেয়।
দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখে কোনো অনুভূতি থাকে না। তাদের চোখে থাকে ফাঁপা দৃষ্টি। মানুষ পশুর মতো খাবারের জন্য লড়াই করে। এটিই হলো সামাজিক অবক্ষয় ও অপমানের চরম রূপ। এটিই হলো মানবিক মর্যাদার বিলোপ। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজকের গাজাবাসী যাচ্ছে।
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ নামে একটি নতুন সংস্থা (যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে মে মাসে যাত্রা শুরু করে) নিজেদের কার্যক্রমকে একুশ শতকের আধুনিক ও সহানুভূতিশীল সংস্থা বলে দাবি করছে। তারা বলছে, তাদের চারটি ‘নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্র’ থেকে তারা প্রতিদিন ২০ লাখের বেশি প্যাকেট খাবার বিতরণ করছে। সেখানকার ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা।
আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি।ইসরায়েলি মুখপাত্ররা বলছেন, জাতিসংঘের ট্রাকগুলো গাজার সীমানার ভেতরে আছে কিন্তু জাতিসংঘ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বিতরণ করছে না। কিন্তু এ বক্তব্য খুব সহজ বিশ্লেষণেই ভেঙে পড়ে।
প্রথমত, সংখ্যা ঠিক মিলছে না। গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা হিসাব করে জানায়, ১৮ মাসের অবরোধ ও যুদ্ধের পর এবং দুই মাসের পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের ফলে মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গাজায় জীবন বাঁচানোর জন্য যে পরিমাণ খাবার দরকার, তার অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। অর্থাৎ গাজার সব মানুষের খাদ্যের পুরো চাহিদা পূরণ করতে হবে এই ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিদিনের ২০ লাখ প্যাকেট খাবার গাজার প্রয়োজনের অর্ধেকও নয়।
আরও পড়ুনইসরায়েল কেন গাজায় অস্ত্রধারী গুন্ডা পোষে ১১ জুন ২০২৫দ্বিতীয়ত, শুধু সংখ্যায় খাবার পৌঁছালেই দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয় না; দুর্ভিক্ষ আঘাত করে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোর ওপর। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, যখন ২০ শতাংশ পরিবার মারাত্মক খাদ্যসংকটে পড়ে, তখন সেটিকে ‘দুর্ভিক্ষ’ বলা যায়। এ অবস্থায় নারীরা, বিশেষ করে যাঁদের স্বামী নেই এবং যাঁদের অনেক শিশু বা বয়স্ক অভিভাবক আছেন, তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। সেসব পরিবারকে চিনে ত্রাণ পৌঁছানোই আসল কাজ।
জিএইচএফ গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র চালায়—তিনটি রাফার ধ্বংসস্তূপে, আরেকটি গাজার মাঝখানে। সব কটিই সামরিক এলাকায়। এরা খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খাবার বিতরণের খুব অল্প আগে সবাইকে জানিয়ে খোলে। মানুষ ধ্বংসস্তূপে শিবির করে বসে থাকে, কখন দরজা খুলবে সেই আশায়। তারা জানে, ইসরায়েলি সেনারা ভিড় সামলাতে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। যেসব দুর্বল মা, বয়স্ক মানুষ বা প্রতিবন্ধী এই দৌড়ে অংশ নিতে পারেন না, তাঁরা কীভাবে খাবার পাবেন?
আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫তৃতীয়ত, মানুষের বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া দরকার। যেমন অপুষ্ট শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ ধরনের খাবার (যেমন ‘প্লাম্পিনাট’, যা সাধারণ খাবার খেতে না পারা শিশুর জন্য তৈরি) দেওয়া দরকার। কিন্তু জিএইচএফের বক্সে থাকে ময়দা, পাস্তা, তেল, চাল, ডাল, তাহিনি (তিলবীজ থেকে তৈরি একধরনের মাখনবিশেষ)। জিএইচএফের ত্রাণের মধ্যে কোনো শিশুখাদ্য বা প্লাম্পিনাট নেই। কোনো প্রশিক্ষিত নার্স বা পুষ্টিবিদও নেই, যাঁরা অপুষ্ট শিশুদের সেবা দিতে পারেন।
আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি।
● অ্যালেক্স ডি ওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক
দ্য গার্ডিয়ান, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত