চার বছর ধরে বন্ধ দৃষ্টিহীনদের শিক্ষালয়
Published: 6th, October 2025 GMT
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ‘সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম’ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় আধুনিক অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও, কেবলমাত্র জনবলের অভাবে দৃষ্টিহীনদের জন্য নির্মিত শিক্ষালয় অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে। ফলে জেলার দৃষ্টিহীন শিশুরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রশিক্ষিত জনবলের সঙ্কট নিরসন করা গেলেই আবারো শুরু হবে জেলার একমাত্র সরকারি দৃষ্টিহীনদের শিক্ষালয়টির কার্যক্রম এমনই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক।
আরো পড়ুন:
কুষ্টিয়ায় জাল সনদে শিক্ষকতা, নেওয়া হলো ব্যবস্থা
বান্দরবানে ১৭৯ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই প্রধান শিক্ষক
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমটি দীর্ঘদিন ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরএলাকার পুরাতন বাজারের কামাল উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি ভবনে চলছিল। প্রয়োজনীয় আধুনিক অবকাঠামো উন্নয়নের পর জেলা শহরের স্বরুপনগর অর্থ্যাৎ সরকারি শিশু পরিবার সংলগ্ন এলাকায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষালয় স্থানান্তরিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানে ১০ জন দৃষ্টিহীন শিশু ব্রেইল পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল।
সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমে দৃষ্টিহীন শিশু প্রথম শ্রেণি থেকে এসএসসি (মাধ্যমিক) স্তর পর্যন্ত পাঠদান করার সুযোগ পায়। জেলা পর্যায়ে এসব কার্যক্রমের দেখভাল করে সমাজসেবা অধিদপ্তর। সরকারি তরফ থেকে দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের ব্রেইল বই এবং অন্যান্য সহায়ক শিক্ষা উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। তাদের শিক্ষাদানের তদারকি করেন বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রিসোর্স শিক্ষক। দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়াসহ সম্পূর্ণ হোস্টেল সুবিধা বিনামূল্যে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাদের চিকিৎসা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করা হয় সরকারিভাবেই।
শিক্ষার পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যাতে তারা সমাজে স্বাবলম্বী হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অথচ প্রায় চার বছর ধরে জনবলের অভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একমাত্র সরকারি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষালয়টির কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেখতে না পাওয়া শিশুরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সমাজসেবা অফিস সূত্রে জানা গেছে, সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষালয়টিতে মঞ্জুরী পদের সংখ্যা চারটি। একজন রিসোর্ট শিক্ষক থাকলেও বাকি হাউজ প্যারেন্ট কাম টিচার, অফিস সহায়ক ও নৈশ্য প্রহরির পদ শূন্য। শিক্ষালয়টিতে আউট সোর্সিংয়ে একজন রাধুনী আছেন। ছাত্র-ছাত্রী না থাকায় তিনি এখন সরকারি শিশু পরিবারে কর্মরত।
সূত্রটি জানান, ২০১৯ সালের জুন মাসে তিনজন দৃষ্টিহীন শিশু ভর্তি হয়েছিলেন সেখানে। প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে অভিভাবকরা ২০২১ সালের ২১ নভেম্ববর সন্তানদের বাড়ি নিয়ে যান। এরপর থেকেই সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষালয়টিতে তালা ঝুলছে।
দৃষ্টিহীন মুশফিকুল হাসনাত সিয়ামের নানি সায়েমা খাতুন বলেন, “সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পটি দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সহায়তা কর্মসূচি। এটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে কাজ করে, যা দেখতে না পাওয়া শিশুদের অন্ধকার জীবনের পথ থেকে আলোর পথে আনতে সাহায্য করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এই কার্যক্রমে বড় বাধা হলো- প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব। জনবল না থাকার কারণে নাতিকে সেখান থেকে বাড়িতে এনেছি। লোকবল নিয়োগ হলে আমার নানিতে পাঠিয়ে দেব।”
তিনি আরো বলেন, “এই শিক্ষালয়টির কার্যক্রম চালুর জন্য আমি অনেকের দারস্ত হয়েছি। কোন সুফল পাইনি। এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চালু হলে দৃষ্টিহীন শিশুরা পড়ালেখা করে তাদের জীবনের আলো ফিরে পাবে। তাদের আর কেউ সমাজের বোঝা মনে করবে না। কাজেই দ্রুত জনবল নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু করা খুবই প্রয়োজন।”
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে কুলসুম বলেন, “সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমটি বন্ধ হয়ে গেছে দক্ষ জনবলের অভাবে। এখানে তিনজন শিক্ষার্থী ছিল, তবে তাদের দেখভালের জন্য কেউ ছিল না। সেজন্য অভিভাবকরা তাদের বাড়িতে নিয়ে গেছেন।”
তিনি আরো বলেন, “এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। কয়েক দফায় প্রতিষ্ঠানটির জনবলের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে তথ্যও চেয়েছে। যখন এখানে জনবল নিয়োগ হবে, তখন থেকে আবারও শুরু হবে জেলার একমাত্র সরকারি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষালয়টির কার্যক্রম।”
ঢাকা/মেহেদী/মাসুদ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প ইনব বগঞ জ র দ র শ ক ষ লয়ট সমন ব ত দ ষ ট ত জনবল র জন য বন ধ দ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
তথ্য আপা, জয়িতা, ডে কেয়ারের কর্মীদের কী হবে
কর্মজীবী তানজিলা মোস্তাফিজের সন্তানের বয়স ১ বছর ১১ মাস। অনেক ছোটাছুটি করার পর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় গ্রন্থাগার ভবনে থাকা সরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্রে সন্তানের জন্য একটি আসন পান তিনি।
এ দিবাযত্ন কেন্দ্রটি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের ‘২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত হয়। আসন পেতে মা–বাবার করা ৫৫০টি আবেদন এখন অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছে।
এই প্রকল্পের মেয়াদ গত ৩০ জুন শেষ হয়ে গেছে। কেন্দ্রটির কর্মকর্তা–কর্মচারীরা বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। কাজেই মা–বাবারা কেন্দ্রে সন্তান রাখতে পারছেন। তবে কর্মীরা বেতন পাচ্ছেন না।
তানজিলা বলেন, তাঁর সন্তান এ দিবাযত্ন কেন্দ্রে থাকতে পছন্দ করে। কেন্দ্রটি বাসার কাছে, নিরাপদ, খরচও কম। বেসরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্রে খরচ অনেক বেশি। তাই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলে সন্তানকে কোথায় রাখবেন, এ নিয়ে তিনি বেশ দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।
তথ্য আপারা শিশু সন্তানদের নিয়েও আন্দোলন করেছে। রোদ-বৃষ্টি ছাপিয়ে রাত-দিন ফুটপাতে এসব নারীদের অবস্থান কর্মসূচি অনেককেই নাড়া দিয়েছে।শুধু এই কেন্দ্রের কর্মীরাই নন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কয়েকটি প্রকল্পের কর্মীরা বছরজুড়ে রয়েছে দুশ্চিন্তায়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ‘মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’ ও ‘তথ্য আপা: তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন’ প্রকল্প, জয়িতা ফাউন্ডেশন পরিচালিত রাপা প্লাজায় ‘জয়িতা বিপণনকেন্দ্র ও জয়িতা ফুডকোর্ট প্রকল্পে আড়াই হাজারের বেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি নারী। কাজ হারিয়ে, বেতন না পেয়ে তারা পড়েছেন বিপাকে।
মন্ত্রণালয় কী বলছে
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কীভাবে গ্রহণ করলে প্রকল্পগুলো টিকে থাকবে, প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ হবে, সেসব দিকে কোনো চিন্তা করা হয় না। ফলে হুটহাট প্রকল্প নেওয়া হয়। সেসব প্রকল্পে নতুন করে জনবল নেওয়া হয়। পুরোনো প্রকল্পের জনবল প্রশিক্ষণ ও কাজের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করলেও তাঁদের চাকরির নিশ্চয়তা তৈরি হয় না। কোনো ক্ষেত্রে দাতাগোষ্ঠী নিজেরাই একেকটা প্রকল্প প্রস্তাব করে। নিজেরাই পরামর্শক হিসেবে নিযুক্ত হয়। ফলে প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ে, কিন্তু নারী–শিশুর উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ হয় না।
নতুন জয়িতা টাওয়ারে যদি আমাদের পণ্যগুলো নেয়, তাহলে হয়তো চলতে পারব। এখন চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।শারমিন রহমান, রাপা প্লাজার জয়িতার উদ্যোক্তা।কর্মকর্তাদের মতে, কোনো কোনো প্রকল্পের প্রস্তাবও ত্রুটিযুক্ত। যেমন তথ্য আপা প্রকল্পের মূল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) না থাকলেও প্রথম সংশোধনীতে চাকরি রাজস্ব খাতে নেওয়ার উল্লেখ ছিল। দ্বিতীয় সংশোধনীতে সেটা বাদ দেওয়া হয়। এর আগেই প্রায় দেড় হাজার নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে বেতন বন্ধ
‘২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। শুরুতে ১১টি কেন্দ্র স্থাপনের কথা ছিল। পরে ২০১৮ সালে তা বাড়িয়ে ২০টি করা হয়। এর মধ্যে ঢাকায় ১১টি, ঢাকার বাইরে ৯টি। এসব দিবাযত্ন কেন্দ্রে ১ হাজার ১০০টির বেশি শিশু রয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ৮৪ কোটি টাকা।
দুই দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়। ২০১৮–১৯ অর্থবছরে এসব কেন্দ্র থেকে বছরে আয় হয়েছিল প্রায় ৭ লাখ টাকা। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে আয় বেড়ে এক কোটি টাকা হয়েছে। জনবল রয়েছে ২৪৩ জন। তাঁদের মধ্যে নারী কমপক্ষে ১৭০ জন।
রাজধানীর রাপা প্লাজায় ১৪ বছর ধরে চলা জয়িতার কার্যক্রম গত ১৩ মে বন্ধ হয়ে যায়। কার্যক্রম চালিয়ে যেতে আবেদন উচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে গেলে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে রাপা প্লাজায় জয়িতা বিপণনকেন্দ্র ও ফুড কোর্ট বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়।মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া এসব কেন্দ্রের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা এখন বেতন পাচ্ছেন না। তাঁদের একজন নাম প্রকাশ না করে বললেন, ‘আমরা বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাই। ওদের দেখভাল করি। কিন্তু চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে নিজেদেরই মানসিক অবস্থা ভালো না।’ তিনি আরও বলেন, ‘নতুন করে ৬০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। সেখানে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হবে। আমরা চাকরি পাব কিনা, এ কেন্দ্রগুলো থাকবে কি না, সে সম্পর্কে এখনো মন্ত্রণালয় কিছু জানায়নি।’
সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব শবনম মোস্তারী বলেন, ‘আশা করা যায়, এ প্রকল্পের শিশুসেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। প্রকল্পটি কর্মজীবী নারীদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তাই একই মডেলে সব সরকারি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনার পরামর্শ দেন তিনি।
আমরা বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাই। ওদের দেখভাল করি। কিন্তু চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে নিজেদেরই মানসিক অবস্থা ভালো না।কর্মী, দিবাযত্ন কেন্দ্র‘তথ্য আপা প্রকল্পের’ কর্মীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। গত ৩০ মে তোলা