টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এখন কার্যত নিজেই এক মুমূর্ষু রোগী।  এই হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে ছুটে আসেন শত শত মানুষ। কিন্তু চিকিৎসক, নার্স, এমনকি ল্যাব সহকারীর অভাবে সেবা পাওয়া তাঁদের সবার ভাগ্যে জোটে না। সরকারি কাগজে এটি ৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও বাস্তবে তা একটি বড় ভবনের ভেতরে থাকা ছোট্ট এক জরুরি বিভাগে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

এই হাসপাতালে ৩১ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও আছেন মাত্র ৮ জন। ২৯ নার্সের মধ্যে কর্মরত মাত্র ৫ জন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর অবস্থাও একই রকম; ৩৪ জনের স্থলে আছেন ৮ জন। ফলে অপারেশন থিয়েটার বন্ধ, সিজারিয়ান সেবা এক বছর ধরে বন্ধ, শিশু ও ডায়রিয়া ওয়ার্ড বন্ধ, ব্লাড ব্যাংক বন্ধ—অচলাবস্থার এই তালিকা দীর্ঘই হচ্ছে। হাসপাতালের অভ্যন্তরে কোনো শয্যা ফাঁকা থাকে না। এক শয্যায় দুই থেকে তিনজন রোগী গাদাগাদি করে শুয়ে থাকতে বাধ্য হন।

এটি বাংলাদেশের প্রান্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। সরকারের পরিকল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে যে বিশাল ফাঁক, টেকনাফ তার নগ্ন উদাহরণ। ২০১১ সালে হাসপাতালটিকে ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও জনবল বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং সময়ের সঙ্গে জনসংখ্যা বেড়েছে, রোগীর চাপ বেড়েছে, কিন্তু চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা কমেছে।

দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসক–সংকটের কারণে হাসপাতালটি এখন বেসরকারি ক্লিনিকগুলো দালাল চক্রের কবলে পড়েছে। রোগীরা সরকারি সেবা না পেয়ে বাধ্য হয়ে বেশি খরচে বেসরকারি ক্লিনিকে যাচ্ছেন। এটি শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, উপরন্তু মানবিক বিপর্যয়।

সরকার ২০২০ সালে এনজিওর সহযোগিতায় যখন ৯৩ জন অতিরিক্ত কর্মীকে নিয়োগ দিয়েছিল, তখনই প্রমাণিত হয়েছিল যে লোকবল ও ব্যবস্থাপনা থাকলে এ হাসপাতাল দক্ষভাবে চলতে পারে। কিন্তু সেই প্রকল্প শেষ হওয়ার পর সবকিছু আবার অচল হয়ে গেছে।

টেকনাফ একটি সীমান্ত উপজেলা। রোহিঙ্গা ক্যাম্প, মাদক ও দারিদ্র্য—সব মিলিয়ে এখানে চিকিৎসাসেবার প্রয়োজন আরও বেশি। এ অবস্থায় একটি সরকারি হাসপাতালের এমনভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া শুধু স্থানীয় লোকজনের নয়, বরং সমগ্র রাষ্ট্রের জন্যই লজ্জাজনক।

এ অবস্থায় এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এখানে দ্রুত চিকিৎসক, নার্স ও সহায়ক কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। স্থানীয়ভাবে স্থায়ী নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী এনজিও বা চুক্তিভিত্তিক জনবল পুনর্বহাল করা যেতে পারে। দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য রোধে প্রশাসনিক নজরদারি বাড়াতে হবে। হাসপাতালের অচল যন্ত্রপাতি চালু করতে প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেওয়া জরুরি। সিজারিয়ান ডেলিভারি আবার চালু করতে গাইনি ও অ্যানেসথেটিস্ট চিকিৎসক অবিলম্বে নিয়োগ দিতে হবে।

জনগণের চিকিৎসা কোনো দয়া নয়, এটি তাদের সাংবিধানিক অধিকার। সেই অধিকার রক্ষায় টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে অবিলম্বে সচল করতে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

তথ্য আপা, জয়িতা, ডে কেয়ারের কর্মীদের কী হবে

কর্মজীবী তানজিলা মোস্তাফিজের সন্তানের বয়স ১ বছর ১১ মাস। অনেক ছোটাছুটি করার পর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় গ্রন্থাগার ভবনে থাকা সরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্রে সন্তানের জন্য একটি আসন পান তিনি।

এ দিবাযত্ন কেন্দ্রটি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের ‘২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত হয়। আসন পেতে মা–বাবার করা ৫৫০টি আবেদন এখন অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছে।

এই প্রকল্পের মেয়াদ গত ৩০ জুন শেষ হয়ে গেছে। কেন্দ্রটির কর্মকর্তা–কর্মচারীরা বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। কাজেই মা–বাবারা কেন্দ্রে সন্তান রাখতে পারছেন। তবে কর্মীরা বেতন পাচ্ছেন না।

তানজিলা বলেন, তাঁর সন্তান এ দিবাযত্ন কেন্দ্রে থাকতে পছন্দ করে। কেন্দ্রটি বাসার কাছে, নিরাপদ, খরচও কম। বেসরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্রে খরচ অনেক বেশি। তাই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলে সন্তানকে কোথায় রাখবেন, এ নিয়ে তিনি বেশ দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।

তথ্য আপারা শিশু সন্তানদের নিয়েও আন্দোলন করেছে। রোদ-বৃষ্টি ছাপিয়ে রাত-দিন ফুটপাতে এসব নারীদের অবস্থান কর্মসূচি অনেককেই নাড়া দিয়েছে।

শুধু এই কেন্দ্রের কর্মীরাই নন।  মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কয়েকটি প্রকল্পের কর্মীরা বছরজুড়ে রয়েছে দুশ্চিন্তায়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ‘মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’ ও ‘তথ্য আপা: তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন’ প্রকল্প, জয়িতা ফাউন্ডেশন পরিচালিত রাপা প্লাজায় ‘জয়িতা বিপণনকেন্দ্র ও জয়িতা ফুডকোর্ট প্রকল্পে আড়াই হাজারের বেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি নারী। কাজ হারিয়ে, বেতন না পেয়ে তারা পড়েছেন বিপাকে।

মন্ত্রণালয় কী বলছে

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কীভাবে গ্রহণ করলে প্রকল্পগুলো টিকে থাকবে, প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ হবে, সেসব দিকে কোনো চিন্তা করা হয় না। ফলে হুটহাট প্রকল্প নেওয়া হয়। সেসব প্রকল্পে নতুন করে জনবল নেওয়া হয়। পুরোনো প্রকল্পের জনবল প্রশিক্ষণ ও কাজের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করলেও তাঁদের চাকরির নিশ্চয়তা তৈরি হয় না। কোনো ক্ষেত্রে দাতাগোষ্ঠী নিজেরাই একেকটা প্রকল্প প্রস্তাব করে। নিজেরাই পরামর্শক হিসেবে নিযুক্ত হয়। ফলে প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ে, কিন্তু নারী–শিশুর উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ হয় না।

নতুন জয়িতা টাওয়ারে যদি আমাদের পণ্যগুলো নেয়, তাহলে হয়তো চলতে পারব। এখন চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।শারমিন রহমান, রাপা প্লাজার জয়িতার উদ্যোক্তা।

কর্মকর্তাদের মতে, কোনো কোনো প্রকল্পের প্রস্তাবও ত্রুটিযুক্ত। যেমন তথ্য আপা প্রকল্পের মূল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) না থাকলেও প্রথম সংশোধনীতে চাকরি রাজস্ব খাতে নেওয়ার উল্লেখ ছিল। দ্বিতীয় সংশোধনীতে সেটা বাদ দেওয়া হয়। এর আগেই প্রায় দেড় হাজার নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে বেতন বন্ধ

‘২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। শুরুতে ১১টি কেন্দ্র স্থাপনের কথা ছিল। পরে ২০১৮ সালে তা বাড়িয়ে ২০টি করা হয়। এর মধ্যে ঢাকায় ১১টি, ঢাকার বাইরে ৯টি। এসব দিবাযত্ন কেন্দ্রে ১ হাজার ১০০টির বেশি শিশু রয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ৮৪ কোটি টাকা।

দুই দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়। ২০১৮–১৯ অর্থবছরে এসব কেন্দ্র থেকে বছরে আয় হয়েছিল প্রায় ৭ লাখ টাকা। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে আয় বেড়ে এক কোটি টাকা হয়েছে। জনবল রয়েছে ২৪৩ জন। তাঁদের মধ্যে নারী কমপক্ষে ১৭০ জন।

রাজধানীর রাপা প্লাজায় ১৪ বছর ধরে চলা জয়িতার কার্যক্রম গত ১৩ মে বন্ধ হয়ে যায়। কার্যক্রম চালিয়ে যেতে আবেদন উচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে গেলে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে রাপা প্লাজায় জয়িতা বিপণনকেন্দ্র ও ফুড কোর্ট বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়।

মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া এসব কেন্দ্রের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা এখন বেতন পাচ্ছেন না। তাঁদের একজন নাম প্রকাশ না করে বললেন, ‘আমরা বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাই। ওদের দেখভাল করি। কিন্তু চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে নিজেদেরই মানসিক অবস্থা ভালো না।’ তিনি আরও বলেন, ‘নতুন করে ৬০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। সেখানে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হবে। আমরা চাকরি পাব কিনা, এ কেন্দ্রগুলো থাকবে কি না, সে সম্পর্কে এখনো মন্ত্রণালয় কিছু জানায়নি।’

সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব শবনম মোস্তারী বলেন, ‘আশা করা যায়, এ প্রকল্পের শিশুসেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। প্রকল্পটি কর্মজীবী নারীদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তাই একই মডেলে সব সরকারি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনার পরামর্শ দেন তিনি।

আমরা বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাই। ওদের দেখভাল করি। কিন্তু চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে নিজেদেরই মানসিক অবস্থা ভালো না।কর্মী, দিবাযত্ন কেন্দ্র‘তথ্য আপা প্রকল্পের’ কর্মীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। গত ৩০ মে তোলা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চার বছর ধরে বন্ধ দৃষ্টিহীনদের শিক্ষালয়
  • বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি, চলছে আবেদন
  • তথ্য আপা, জয়িতা, ডে কেয়ারের কর্মীদের কী হবে