হাইওয়ের রাস্তা ধরে মিনিট বিশেকের পথ সীতাপুর। সীতাপুর বাস স্টপেজ। বাস স্টপেজে নেমে সোজা পশ্চিমের লাল ইটের পথ। ইটের ফাঁকে ফাঁকে দূর্বাদল চোখ মেলে তাকায় সূর্যের দিকে।
আরও একটু পথ এগিয়ে যেতেই উত্তাল সমুদ্র। ম্যানগ্রোভ আর হিজলের ভিড়ে সমুদ্রের নীল জল দৃশ্যমান।
শোনা যায় গাঙচিলের উৎসব। মনে হয় ওরা ডাকছে, বলছে আরও আরও কাছে এগিয়ে যেতে। ছুঁয়ে দেখতে বলছে জলরাশি।
সাগরতীরে জেলেদের আবাস। জোয়ারের তোড়ে জেলেদের ঝুপড়িতে হুহু করে জল ঢোকে। জলের তাণ্ডবে বাঁশের মাচায় বাঁধে ওরা রাতের সংসার। কেরোসিনের গন্ধে আলোরা মিশে যায় অন্ধকারে।
হরিহর দাস হরি নাম করতে করতে রাত কাবার করে। জোয়ারের জল কমে আসতেই হরিহর চিৎকার করে জানান দেয়, ‘ওরে বেণু, দেখ সমুদ্রের জল কমছে। চল মাছ ধরতে যাই।’
ওরা সবাই জানে ভাটার টানে ইলিশের মহোৎসব নামে সাগরের জলে।
‘হইহই’ করে পাড়ার সবাই হাজির হয় হরিহরের ভিটায়। ওরা সবাই সার বেঁধে বসে। হরিহর কেরোসিনের কুপিতে আগুন দেয়, নিয়ে আসে মনসামঙ্গল। সুর করে পড়ে হরিহর।
রাতের তিন প্রহর যেতেই ওরা সবাই বদর বদর করে ডিঙি ভাসায় সমুদ্রের জলে। ভোরের আলোয় ওদের কেরোসিনের আলো নিভে যায়। ধীরে ধীরে ওরা মাছ ধরা শুরু করে। দুপুর হতেই ওরা সবাই ফিরে আসে। ইলিশের মহোৎসব হয় না কারও ভিটেয়। মহাজন দাদনে কেনে ইলিশ।
ওদের সানকিতে সামুদ্রিক পুঁটির ঝোল আর বেগুনে সয়লাব হয় সেদ্ধ চাল।
সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু পাহাড়।
ঘন শ্যামল পাহাড়ের কোল ঘেঁষেই এঁকেবেঁকে চলে গেছে পথ। একেবারে পাহাড়ের চূড়ায়। আবার সেই পথটাই– পাহাড়ের চূড়া হয়ে নেমে গেছে ঝরনার হয়ে অন্য প্রান্তে।
পাহাড়ি পথের কোল ঘেঁষে লজ্জাবতী আর বুনোফুলের সবুজ আস্তিন। মানুষের আলতো বাতাসে লজ্জাবতী লতারা নুয়ে পড়ে স্বমহিমায়। বুনোফুলের সারে সারে হাজার রঙিন প্রজাপতি ওড়ে। ঘাসফড়িং ঘাসফুলে লেপ্টে থাকে।
মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যেতেই দেখা মেলে শালপাতার ছোট্ট খুপরি। আরও একটু যেতেই পাহাড়ের চূড়া। চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে হাজার বছরের একটা পোড়া শিবমন্দির।
পাহাড়ের ওপাশেই সুনসান নিস্তব্ধতা। একেবারেই জনবসতিহীন। পাহাড়ের উত্তর পাশ হয়ে নেমে গেছে ঝরনা। ঝরনাটা এখন মৃতপ্রায়। টুপটাপ বৃষ্টির মতো জল পড়ে নদীর মুখে। নদীটির নাম চন্দনা।
কাঠুরিয়ারা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে গল্প ফাঁদে। ইনিয়ে বিনিয়ে বলে ডাহা মিথ্যে গল্প। কোনো এক বর্ষায় নাকি ঝরনার তোড়ে ভেসে গেছে একটি মেয়ে। দীঘল চুল। সোনার বরণ। মেয়েটি নাকি কাঠের গুঁড়ি খুঁজতে এসেছিল। আর কখনও ফিরে যায়নি। সেই থেকে মেয়েটির নামেই নদীটির নাম।
চন্দনার জলে এখনও মেয়েটি নাকি হাঁটুজলে নামে, করপুটে জল তোলে। একেলা হাসে আবার মা-মা বলে চিৎকার করে। কখনও কাঁদে আবার হাসে। এসব দৃশ্য কেউ স্বচক্ষে দেখেনি। শুধু গল্প শুনেছে। মেয়েটি নাকি প্রতিমার ছায়ায় হরিণীর শাবক। চোখগুলো টানা টানা অনেকটা হরিণের আদল। ঠোঁটে স্থির হয় রাজহাঁসের গান।
চন্দনার তীরে উল্টো কালীর মূর্তি। কে কখন কালীর মূর্তি উল্টো করে রেখেছিল, কেউ জানে না। সবাই বলে এমনটাই দেখেছিলাম। বাপ-ঠাকুরদার মুখেও এমন কথা– কোনো এক সন্ধ্যায় কাপালিকের মন্ত্রে উল্টে গেছে কালী। সেই থেকে অমাবস্যাতে উল্টো কালীমূর্তির আশপাশে হাজার প্রদীপ জ্বলে। বেদমন্ত্র উচ্চারণের শব্দ ভেসে আসে। ঢোল বাজে। শঙ্খসুরে মোহিত হয় পাহাড়ের চূড়া। পাহাড়ের চূড়ার শাল তমালের শাখায় দাঁড়িয়ে ঈশ্বর দেখে সব। দেখে পোড়া মন্দিরের চুন সুরকি ক্ষয়ে পড়ার যন্ত্রণা।
রামচরণরা দুই ভাই। রামচরণ আর হরিহর। সেই হরিহর কাকার কাছে শুনেছি, এই মন্দির নাকি গড়েছেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। তিনিও শুনেছেন তার বাবার কাছ থেকে। বাবাও শুনেছেন তার বাবার কাছ থেকে। এভাবেই বংশপরম্পরায় শোনা কথা। কোনো এক পূর্ণ চন্দ্রিমায় অমরা হতে দেবরাজ ইন্দ্র আসেন মর্ত্যে। তখন মর্ত্যের পাঠশালায় জমে উঠে বিবিধ উপনিষদ। এই স্থান ভালো লাগে ইন্দ্রের এবং সেই রাতেই বিশ্বকর্মাকে নির্দেশ দেন মন্দির নির্মাণ করতে।
যেমন আজ্ঞা তেমন কর্ম। চতুষ্প্রহরেই নির্মিত হলো মন্দির। ভোরের আলো ফুটতেই হইহই ব্যাপার। জনস্রোত আসে পাহাড়ের চূড়ায়। জেলেপাড়া থেকে আসে রমা বউঠান। মানতের লাল সুতোয় ভরে উঠে মন্দিরের থম। লোকারণ্যে ভাসে হাজার গুঞ্জন। মরা ছেলে বেঁচে ওঠার গল্প ফাঁদে কেউ কেউ। কেউ কেউ বলে, বন্ধ্যা স্ত্রীও পোয়াতি হবে।
হরিহর চিৎকার করে বলে, দেবতা ছিলেন। আছেন। থাকবেন নিরন্তর সত্যের মাঝারে।
হরিহরের কান্তি মাসি বলে, দ্বাপর যুগে এই খানে সীতা এসেছিল বনবাসে। কিংবা তারও আগের ঘটনা পরশুরামের কুঠারে পাহাড়ের সিঁড়িগুলো নেমে গেছে নিচে।
পোড়া মন্দিরে একেলা থাকে ঈশ্বর। ঈশ্বর রামচরণের একমাত্র ছেলে। ঈশ্বর কোনো একদিন জেলেপাড়ায় থাকত। মাছের মতো নেচে বেড়াত মাঝসমুদ্রে। এখন এই পাহাড়েই থাকে। বয়স তেমন নয়– চল্লিশের ঘরে স্থির এ বছর। মন্দিরে যেতে হলে, তাকেই বলে যেতে হয়। নচেৎ কারও যাওয়া হবে না।
ঈশ্বর সারাদিন কাঠ কাটে খটখট শব্দে। গভীর রাতে কাঠে আগুন জ্বালিয়ে গুনগুন করে গায় রামপ্রসাদি। শীত-গ্রীষ্মে রোদ বৃষ্টি কুয়াশায় ধাঙড়ের মতো শক্ত বাহু নিয়ে শুয়ে পড়ে ঈশ্বর।
রামচরণের ছেলে ঈশ্বর একদিন ভূতের ভয়ে তটস্থ থাকত। সে সন্ধ্যা হতে হতে বাড়ি ফিরত বাপের হাত ধরে। একেলা কোথাও যেত না। আজ ঈশ্বর একেলা। রাতবিরাতে পাহাড়ে জাগে স্বপ্নের মতো।
গ্রাম থেকে রোজ মুনিয়া আসত, কাঠ কুড়াত, শালপাতায় মোড়ানো খুপরি ওপাশে কেউ যেতেই একটা ভারী কণ্ঠ ভেসে আসে, কে যাস?
মুনিয়া বলে, আমি গো ঠাকুর আমি রাই।
ঈশ্বর বলে, ও তুই! কই যাস এত্ত সকাল সকাল?
মুনিয়া বলে, কাঠ কুড়াতে গো .
আবার ঈশ্বর বলে, ফেরার পথে একটু বসে যাস্
মুনিয়া বলে, যাব ক্ষণ।
মুনিয়ার চিকন কণ্ঠ মিলিয়ে যেতেই ... দূর হতে বাতাসে ভাসে পাখি ও ঝিঁঝির তান।
অনেকেই বলে, নদীর জলে হাঁটু ডুবিয়ে ঈশ্বর নাকি দু’বেলা জলকেলি করে মুনিয়ার সাথে। মুনিয়ার বয়স তেমন নয়। একুশের যুবতী। ফিরতি পথে ঈশ্বরের ঘরে বসে মুনিয়া। সুখের বাতাস বহে যায় ইথারে ওথারে। মেঘলা দিনের টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ শোনে ওরা সারাটা রাত। ওরা মুখোমুখি বসে থাকে রাতভর।
মুনিয়া আর ঈশ্বর পাহাড়ের চূড়ায় বসে বসে দেখত আন্তঃনগর ট্রেন। কাছাকাছি বসে দেখত শেষ বিকেলের আবির খেলা। চুপচাপ হয়ে কান পেতে শুনত শেষ ট্রেন চলে যাওয়ার ধ্বনি।
মুনিয়ার ঠাকুর ঈশ্বর। মুনিয়ার শরীরের নোনা গন্ধ ভালো লাগত ঈশ্বরের। কিন্তু মুনিয়া বলত রোহিতের কথা। রোহিত মুনিয়ার হাতে হাত ধরে দেখত সমুদ্র। মুনিয়ার মন রোহিতকে টানত ভীষণভাবে।
ঈশ্বর পাহাড়ের শালপাতার ভাঁজে কবে আশ্রয় নিয়েছিল, সেই ইতিহাস কেউ জানে না। শুধু এইটুকু জানে সমতল তার ভালো লাগে না। মাঝসমুদ্রের মাছের কোলাহল আর ভালো লাগে না। যেটুকু তার ভালো লাগে– এই পাহাড়, শালপাতা। ওই ঝরনা, উল্টো কালীর মূর্তি। আর মুনিয়া।
মাঝে মাঝে ঈশ্বরের মনে পড়ে যুদ্ধের কথা। যেবার এই মুলুকে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই বছরে, পরের বছর ঈশ্বরের মা-বাপও গেছে স্বর্গে। সেই থেকে একেলা ঈশ্বর এই পাহাড়ে।
ঈশ্বরের বেড়ে ওঠা যদিও সমতলে। কেন জানি না নিচে নামতে প্রচণ্ড ভয় করে ঈশ্বরের। মুনিয়ারও কেউ নেই। ঠাকুরমার কোলে পিঠে মানুষ। খিদের জ্বালায় রোজ একা একা পাহাড়ে আসে। কাঠ কুড়িয়ে বিকেলে ফিরে যেতে ঈশ্বরের সাথে গল্প হয়। আবার শেষ বিকেলে মেয়ে হয়ে ফিরে যায়।
রোহিতের হাতে পড়ে কতবারই যে গতর বাড়িয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বারবার শুধুই স্বপ্ন দেখেছে মুনিয়া। একটা ঘর। ছোট্ট সংসার। ছেলেমেয়ে। কিন্তু স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকেছে। এখন রোহিত নেই, পাহাড়ে এলে একেলা লাগে মুনিয়ার। তাই ঈশ্বরের সাথে গল্প হয়।
এখন বসন্ত। বনফুলের ভিড়ে হাজার ভ্রমর ওড়ে। মাঝে মাঝে হেসে মুনিয়া বলে– ও ঠাকুর, নদীটির নাম ক্যান এমন হলো?
ঈশ্বর হেসে বলত, মুনিয়া তোর পাখির নামে নাম। তুই ক্যান পাখি হলি না?
মুনিয়া বলত, দেখো ঠাকুর, মুই একদিন সত্যিকারের পাখি হবো। সেদিন আর নাগাল পাবে না ঠাকুর।
ঈশ্বর বলত, সে তো এখনও পাচ্ছি না। কবে যে পাব, হেই কথাও জানি না।
মুনিয়া বলত, তুমি ঠাকুর বেশ আছো। পাহাড়ে বসে বসে রাতের চাঁদ দেখো। শিয়ালের হাঁক শুনো ... বনমোরগের লাফালাফি দেখো। এবার মোরে চন্দনা নদীর কথা কহ।
চন্দনা নামের ইতিহাস কেউ জানে না। এমনকি আমার বাপ-ঠাকুরদার কাছেও কখনও শোনেনি। চন্দনার স্বচ্ছ জলে হাঁটু ডুবিয়ে রোজ কাঠ কুড়িয়ে আনত মুনিয়া। তারপর বাজারে হাজার পুরুষের ভিড়ে উৎকট সংলাপ।
গাঁয়ের জোতদার রহমান। নব্য পয়সাওয়ালা। বিদেশ করে করে আজ ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। তারই ছেলে রহিম। মুনিয়াকে বাজারে হাজার লোকের সামনে থুতু ছিটিয়ে মজা লুটে নিয়েছে বহুবার। একদিন ওড়না টান দিয়ে বুক দেখেছে বেজন্মার মতো।
শ্রাবণ ফিরে গেছে সপ্তা দুই আগে। এখন ভাদ্রের মাঝামাঝি সময়। কদমের শাখায় শাখায় হলুদ ফুল। দাঁড়কাকের বাচ্চাগুলো সবেমাত্র উড়তে শিখছে। আগামীকাল কিংবা হয়তো আরও দুই-এক দিন পরে ওরা আকাশ ছুঁয়ে বলবে, আমি বড় হয়েছি।
বড় হতে হতে যেমন আমরা ছুঁয়েছি চাঁদ মঙ্গল কিংবা অন্য জীবন। শাল-পিয়ালের মগডালে হুতোম প্যাঁচার ক্রন্দন ভেসে আসে। প্যাঁচার কান্না জানান দিচ্ছে আকাশের বিরূপ অবস্থা। মেঘের ঘনঘটা। পাহাড়ের শেষ প্রান্তের গ্রামের কেরোসিনের আলোগুলো নিভুনিভু।
রাত্তি গহিন। চুপচাপ ধরণি। মেঘলা চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত বনভূমি। শালপাতারা আছন্ন নিদ্রায়। পোড়া মন্দির এবং অধিষ্ঠিত দেবতাও আজ বেসামাল। হঠাৎ একটা বিদঘুটে কান্নার কোলাহলে ঘুম ভেঙে যায় ঈশ্বরের।
আধো আধো স্বর ভাঙা কণ্ঠে বলে, কে?
খুপরির ওপর প্রান্ত থেকে বলে, আমি।
কথার সমাপ্তি রেখা না টেনে হুহু করে শ্রাবণের ধারা বিলাপে শোনা যায়। যেন ঠুংরি তালে তাল ঠেকে দিয়েছে মহাকাল।
হকচকিয়ে উঠে ঈশ্বর। বুকের কোণের ব্যথা চিনচিনিয়ে ওঠে। কপাট খুলেই বলে, এত রাতে তুই! কী হয়েছে? কানছিস ক্যান?
মুনিয়া বলে, ঈশ্বর, জোতদার আমার ভিটেবাড়ি দখল করে নিয়েছে। ঠাকুরমা মৃতপ্রায়। এইসব করে যদি হে ক্ষান্ত হতো তবে শান্তি পেতাম। কিন্তু গত রাতের আন্ধারে জোতদারের জোয়ান মরদ মোর গতর নিল। ঠাকুর, কহ এবে মোর কী হবে?
ঈশ্বরের বুকের দীর্ঘশ্বাস আরও দীর্ঘ হয়। সমুদ্রের মতো ফুঁসে ওঠে বুক। চোখে আজ সমুদ্রের তরঙ্গ। শালপাতার ভাঁজ থেকে খড়্গটা হাতে নেয়।
একাত্তরের কথা। তখন তার বয়স কত, হয়তো বারো-তেরো। বাপের হাতে সেদিন অন্য অস্ত্র ছিল না। এই খড়্গে শান দিয়ে পাকিস্তানি সেনার দোসর রহমতকে কতল করেছিল। সেই রামচরণের ছেলে ঈশ্বর। পিতার মতোই দ্রোহী হয়ে ওঠে।
কালবৈশাখীর রুদ্রবীণায় যেমন একদিন মহাকাল নেচে উঠেছিল পৃথিবীতে, ঠিক তেমনি আজ ঈশ্বর। তার দু’চোখে নেচে ওঠে আগুন, দাউদাউ করে জ্বলে মানসের শস্য। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভালোবাসার আসল রূপটাই যেন ছিলেন আব্বা’
এবারের বাবা দিবস আমার কাছে একটু অন্যরকম। চারপাশ যেন কিছুটা বেশি নিস্তব্ধ, হৃদয়ের ভেতর যেন একটু বেশি শূন্যতা। কারণ এবার প্রথমবারের মতো আমার আব্বাকে ছাড়াই কাটছে দিনটি। আব্বা চলে গেছেন গত জানুয়ারিতে। ফলে বাবা দিবস এখন আর কেবল উদযাপনের দিন নয়– এটি হয়ে উঠেছে স্মরণ, অনুধাবন ও আমার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উপলক্ষ। আব্বা না থেকেও আছেন, তবে এক ভিন্ন অনুভবে– আমার নীরব নিঃশব্দ অভিভাবক হয়ে।
আমাদের সমাজে কিংবা বলা যায় পারিবারিক সংস্কৃতির বাবারা সবসময় প্রকাশের ভাষায় ভালোবাসা বোঝান না। তাদের স্নেহ, দায়িত্ববোধ ও নিবেদন অনেক সময়েই নীরব থাকে, তবে গভীরভাবে অনুভব করা যায়। আমার আব্বাও ছিলেন তেমনই একজন। আব্বা ছিলেন আমার দিকনির্দেশক, আমার রক্ষাকবচ, আমার জীবনপথের চুপচাপ ভরসা।
আব্বার অ্যাজমা ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিতেন, আমাদের প্রতিও ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। আমি কিংবা আমার মেয়ে সামান্য অসুস্থ হলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। তাঁর যখন ৭৯ বছর বয়স, তখনও আমি ডাক্তারের কাছে একা যেতে গেলে বলতেন, ‘তুমি একা যাবে কেন? আমি যাচ্ছি।’ এই কথা বলার মানুষটাকে প্রতি পদে পদে আমার মনে পড়ে, যেন দূর থেকে দেখছেন সবই। আর আমিও তাঁর কনুই-আঙুল ধরে হেঁটে যাচ্ছি জীবনের পথে।
আব্বা ছিলেন একজন পুরোদস্তুর ধার্মিক মানুষ। শৈশব থেকে নামাজের গুরুত্ব তিনি আমার মধ্যে গভীরভাবে বপন করার চেষ্টা করে গেছেন। কখনও নরম সুরে, আবার কখনও খুব জোর গলায়। তখন মনে হতো তিনি চাপ দিচ্ছেন; কিন্তু এখন তাঁর অনুপস্থিতির নিস্তব্ধতায় আমি সেই কণ্ঠস্বরের জন্য আকুল হই।
অফিস থেকে ফিরতে দেরি করলে কিংবা আত্মীয়ের বা বন্ধুর বাসায় গেলে বাবার ফোন আসত, ‘কোথায়? কখন ফিরবি?’ সেসব ফোন একসময় মনে হতো আব্বার বাড়াবাড়ি। এখন মনে হয়, একটাবার হলেও যদি ফোনে তাঁর নামটা দেখতাম! ছোট ছোট এসব প্রশ্ন– এই উদ্বেগই তো ছিল নিঃশব্দ ভালোবাসা। এগুলোই ছিল বাবার নিজের মতো করে যত্ন নেওয়ার ভাষা। সেই ভাষাটাই আজ আর শোনা যায় না। আব্বা নেই, এখন জীবনযাপনে এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে থাকে।
আব্বা ছিলেন একজন ব্যাংকার। হয়তো চেয়েছিলেন আমি তাঁর পেশার ধারাবাহিকতা বজায় রাখি। কিন্তু কোনোদিন চাপ দেননি। বরং নিজের ইচ্ছেমতো পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন; ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। আব্বাই আমাকে নিজের ওপর আস্থা রাখতে শিখিয়েছেন। বিয়ে করেছি, বাবা হয়েছি, নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়েছি– তবুও বাবার সেই গাইডেন্স কখনও ফুরায়নি। আব্বা কখনও অর্থ বা অন্য কোনো সহায়তার কথা বলেননি; বরং সবসময় নিজে থেকেই পাশে থেকেছেন। মনে পড়ে, একবার মেয়ের অসুস্থতার সময় আমি অর্থকষ্টে ছিলাম, কিছু বলিনি তাঁকে। কিন্তু তিনি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন, পাশে থেকেছেন।
এখন অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে হয়, ‘বাবা হলে কী করতেন?’ তাঁর শিক্ষা, অভ্যাস, স্নেহ– সবকিছু এখন আমার আচরণে, আমার সিদ্ধান্তে, আমার ভালোবাসায় প্রতিফলিত হয়। তাঁকে ছুঁতে না পারলেও আমি প্রতিদিন তাঁর উপস্থিতি অনুভব করি– স্মৃতিতে, নৈঃশব্দ্যে, নানা রকম ছোট ছোট মুহূর্তে।
এই বাবা দিবসে আব্বার কোনো ফোন আসবে না, থাকবে না কোনো উপহার বা আলিঙ্গনের মুহূর্ত; যা আছে সেটি হলো আব্বার প্রতি একরাশ কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর অপার ভালোবাসা। যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সন্তানদের শুধু দিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু চাননি কখনোই। তাঁর জীবনদর্শন আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি– এগুলোই নিজের জীবনে ধারণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, হয়তো পুরোপুরি পারছি না; কিন্তু আমার মনে হয় এ চেষ্টাটাই আমার জীবনে শৃঙ্খলা এনেছে।
বাবাকে হারানোর শোক যেমন গভীর, তেমনি গভীর তাঁর রেখে যাওয়া ভালোবাসা। নিজের অনুভবকে চাপা না দিয়ে, বরং বাবাকে নিজের ভেতরে জায়গা দিন। বাবার কথা বলুন, তাঁর শেখানো পথে হাঁটুন। কারণ প্রিয় মানুষরা চলে যান বটে, কিন্তু তাঁদের ভালোবাসা থেকে যায় সবসময়।
লেখক: কমিউনিকেশনস প্রফেশনাল