অনুবাদের দুটি আলাদা পথ রয়েছে: ফজল হাসান
Published: 13th, February 2025 GMT
ফজল হাসান মূলত একজন অনুবাদক। তার অনুদিত বইয়ের তালিকায় রয়েছে দুইজন নোবেল বিজয়ীর দুইটি উপন্যাস, ২৩টি ছোটোগল্প সংকলন এবং দুইটি সম্পাদিত ও অনূদিত ছোটোগল্প সংকলন। এছাড়া তার দুইটি মৌলিক ছোটোগল্প সংকলন এবং দুটি ভ্রমণ গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ বছর বইমেলায় ফজল হাসানের তিনটি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ সাহিত্যের নানাদিক নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন ফজল হাসান। সাক্ষাৎকার গ্রহণে স্বরলিপি।
রাইজিংবিডি: অনুবাদ সাহিত্য নতুন করে নির্মাণ ও সাহিত্যরস যুক্ত করার জন্য একজন অনুবাদকের প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?
ফজল হাসান: যে কোনো কাজের পেছনে যেমন প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে, তেমনই অনুবাদ সাহিত্য নতুন করে নির্মাণ ও সাহিত্যরস যুক্ত করার জন্য একজন অনুবাদকের রীতিমতো আঁটসাট বেঁধে প্রস্তুতি নিতে হয়। প্রথমে আমি গল্প কিংবা উপন্যাস খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি এবং অনুবাদের যোগ্য কি না – সেটা যাচাই করি। কেননা উইলিয়াম রাদিচের ভাষায় বলতে হয়, সব গল্পই অনুবাদ করা যায় না। তিনি আরও বলেছেন, যেসব গল্প অনুবাদ যোগ্য এবং অনুবাদে মূল সৌন্দর্য্য হারাবে না, শুধু সেগুলোই অনুবাদ করা উচিত। আমি তার কথাগুলো মনে রেখে গল্প বাছাই করি। আমার প্রকাশিত গ্রন্থ দেখলেই বোঝা যাবে।
গল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমি বিভিন্ন তথ্যসূত্রের মাধ্যমে প্রথমে গবেষণা করি কোন লেখকের উপন্যাস বা ছোটোগল্প কিংবা কোন দেশের বা কোন বিষয়ের ওপর ছোটগল্প অনুবাদ হয়নি, হোক না সেগুলো আধুনিক কিংবা সমকালীন লেখকদের রচনা। আমি সেসব লেখা সংগ্রহ এবং একটা ধারণা নিই। আমি যা অনুবাদ করি, সংক্ষেপে বলতে হয়, যখন আমি সিদ্ধান্ত নিই যে একটা ভালো গল্প অনুবাদ করব (আগেই উল্লেখ করেছি যে, সব গল্প অনুবাদ করা যায় না), আমি গল্প লেখকদের জীবন সম্পর্কে, তার লেখার ধরন বা স্টাইল এবং কোন ‘টোন’-এ সাধারনত তিনি লেখেন, গবেষণার মাধ্যমে এসব বিষয় সম্পর্কে ধারনা নিই এবং লেখককে বোঝার চেষ্টা করি। তারপর গল্প অনুবাদ করার সময় সেই জ্ঞানটুকু কাজে লাগাই। এ ভাবেই আমি মূল লেখার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করি। তবে এ কথা সত্যি যে, অনুবাদকে পাঠকের কাছে মনোগ্রাহী এবং পাঠ যোগ্য করার জন্য অনুবাদককে মাঝে মধ্যে কিছুটা স্বাধীনতা নিতে হয়। আমিও তাই করি।
রাইজিংবিডি: ২০২৫ বইমেলায় আপনার নতুন অনুবাদ গ্রন্থ নাগিব মাহফুজের ‘অ্যাড্রিফ্ট অন দ্য নাইল’ এবং হান কাংয়ের ‘দ্য হোয়াইট বুক’ এবং ‘ইতালির নোবেল বিজয়ী ও অন্যান্য লেখকদের নির্বাচিত গল্প’ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর প্রেক্ষাপট জানতে চাই।
ফজল হাসান: ২০২৫ বইমেলায় আমার তিনটি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে দুটি উপন্যাস এবং একটি ছোটোগল্প সংকলন। উপন্যাস দুটি যথাক্রমে ১৯৮৮ সালে নোবেল বিজয়ী মিশরীয় কথাসাহিত্যিক নাগিব মাহফুজের ‘অ্যাড্রিফ্ট অন দ্য নাইল’ এবং ১৯২৪ সালে নোবেল ও ২০১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল বুকার বিজয়ী ‘কোরিয়ান কাফকা’ খ্যাত লেখিকা হান কাংয়ের ‘দ্য হোয়াইট বুক’। এ দুটি উপন্যাসের প্রকাশক বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রকাশনা সংস্থা ‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ’ এবং বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে (ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, প্যাভিলিয়ন ১৯)।
‘অ্যাড্রিফ্ট অন দ্য নাইল’ নাগিব মাহফুজের অন্যতম জনপ্রিয় এবং পাঠক নন্দিত উপন্যাস। এই উপন্যাসে নাগিব মাহফুজ মিশরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মূলহীনতাকে তুলে ধরেছেন। নীল নদের ওপর ভাসমান একটি হাউসবোটে একদল লোকের উম্মাদনা এবং আনন্দ-ফূর্তির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সেই হাউসবোটে তারা কিফ বা হাশিশ, মাদক এবং যৌনতার পরিবেশে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়ে সুখ-আনন্দ লাভ করার চেষ্টা করতেন। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আনিস জাকি। তিনি একজন হতাশাগ্রস্ত ও মাদকাসক্ত সরকারি কর্মচারী এবং তার খারাপ অভ্যাসের কারণে তিনি চাকুরীতে পুরোপুরি থিতু হতে পারেননি। প্রতি সন্ধ্যায় তিনি নীল নদের ভাসমান হাউসবোটে সমাবেশের আয়োজন করতেন। সেখানে তিনি ও তার মতো অন্যান্য বন্ধুরা মিলিত হতেন এবং অসামাজিক কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখতেন। সেই তাদের সমাবেশে একজন তরুণী সাংবাদিক যোগ দেন এবং গোপনে তাদের ক্রিয়াকলাপ নথিভুক্ত করতে শুরু করেন। একসময় তাদের সম্প্রীতি ভেঙে যেতে শুরু করে এবং শেষপর্যন্ত মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় শেষ হয়। উল্লেখ্য, এই গ্রন্থে আরও রয়েছে লেখকের জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
‘দ্য হোয়াইট বুক’ হান কাংয়ের কল্পকাহিনী এবং আত্মজীবনীমূলক কাব্যিক উপন্যাস, যা আঙ্গিকের দিক থেকে ব্যতিক্রম। উপন্যাসটি তিনটি অধ্যায়ে (আমি অর্থাৎ ‘আই’, সে অর্থাৎ ‘শি’ এবং সব শুভ্রতা অর্থাৎ ‘অল হোয়াইটনেস’) বিভক্ত, যেখানে তিন ধরনের বর্ণনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা অণুগল্পের মতো, কখনো মনে হয় কবিতার মতো, ছোটো ছোটো কাহিনীর সমাহার। এসব কাহিনীতে সাদা রঙের বস্তুর বর্ণনার ভেতর দিয়ে লেখিকা মানুষের দুঃখ, শোক, ক্ষত এবং মানবজাতির নশ্বর শরীর ও আত্মার অন্তর্নিহিত রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি অধিবক্তার বোনের শোকগাথা ঘিরে রচিত। সেই বোন জন্মের কিছুক্ষণ পরেই মারা যায়। দুঃখের বাইরেও মানুষের ভাগ্যের অনুমানমূলক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে। উল্লেখ্য, সম্পূর্ণ উপন্যাস ছাড়াও এই গ্রন্থে রয়েছে উপন্যাস সম্পর্কে হান কাংয়ের সাক্ষাৎকার এবং লেখিকার জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
অন্যদিকে ছোটোগল্প সংকলন ‘ইতালির নোবেল বিজয়ী ও অন্যান্য লেখকদের নির্বাচিত গল্প’ সংকলনে রয়েছে আঠারো জন লেখকের আঠারোটি গল্প রয়েছে, যা দুটি পর্বে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। প্রথম পর্বে রয়েছে তিনজন নোবেল বিজয়ী লেখকের তিনটি গল্প। তারা হলেন: লুইজি পিরান্দেলো, গ্রাৎসিয়া দেলেদ্দা ও ইউজেনিও মন্তেল। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে পনেরজন লেখকের পনেরটি গল্প এবং লেখক তালিকায় রয়েছেন আলবার্তো মোরাভিয়া, ইতালো ক্যালভিনো, এলসা মোরান্তে, কার্লো এমিলিও গাদ্দা, এলিও ভিত্তোরিনি, দিনো বুজ্জাতি, কার্লো ক্যাসোলা, নাতালিয়া গিনজবুর্গ, আন্না মারিয়া ওরতেসে, গফরেদো প্যারিসি এবং ডোমেনিকো স্টারনোন। অনুবাদ গ্রন্থটি বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে (অক্ষরবৃত্ত, স্টল ৪২৪-৪২৫)।
আরো পড়ুন:
বইমেলায় মুজাহিদ উদ্দীনের দুই বই
বুক মার্কেটিং লেখক-প্রকাশক উভয়েরই দায়িত্ব: জসিম উদ্দিন
রাইজিংবিডি: বিশ্ব সাহিত্যের অনেক বই নিশ্চয় পড়া হয়, একটি বইকে কখন অনুবাদ যোগ্য মনে করেন?
ফজল হাসান: অবশ্যই বিশ্ব সাহিত্যের অনেক বইপড়া হয়, তবে কোনো বইকে কখন অনুবাদ যোগ্য মনে করি, তা নির্ভর করে আমার নিজস্ব পছন্দ ও রুচির সঙ্গে পাঠকদের রুচিবোধ এবং আগ্রহ। এই দীর্ঘ সময় অনুবাদের সঙ্গে জড়িত থেকে মোটামুটি বুঝতে পরি পাঠকরা কোন ধরনের বিদেশি সাহিত্য পড়তে চায় বা জানতে আগ্রহী। সাধারণত আমি এমন সব আলাদা এবং বিচিত্র ধরনের বিষয় বা দেশ ভিত্তিক গল্প নির্বাচন করি, যার সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় নেই। উল্লেখ্য, আমার অনূদিত গ্রন্থের তালিকা দেখলেই তা সহজে বোঝা যায়। এছাড়া কোনো আন্তর্জাতিক পুরষ্কার (যেমন নোবেল, বুকার এবং আন্তর্জাতিক বুকার) পাওয়ার পর যখন পুরষ্কারপ্রাপ্ত লেখকদের সাহিত্য কর্ম সম্পর্কে বাংলাদেশের পাঠকদের মনে জানার আগ্রহ দেখা দেয়, তখন তাদের লেখা অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নিই। তবে অনেক সময় সাহিত্য সম্পাদকদের অনুরোধে বিশেষ বিষয়ের ওপর গল্প কিংবা বিখ্যাত লেখকদের নির্দিষ্ট কোনো গল্প অনুবাদ করতে হয়।
রাইজিংবিডি: অনুবাদ সাহিত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে আপনি কোন পন্থা অবলম্বন করেন?
ফজল হাসান: অবশ্যই অনুবাদ সাহিত্য প্রথমে মূল লেখাকে আত্মস্থ করতে হয় এবং তারপর পাঠকের কথা মাথায় রেখে নিজের মতো করে তা সহজ ও সাবলীল ভাবে নির্মাণ করতে হয়। এ কথা সত্যি যে, অনুবাদের দুটি আলাদা ধারা বা পথ রয়েছে, যা আমরা মেটাফ্রেস্টিক বা মূলানুগ অনুবাদ এবং প্যারাফ্রেস্টিক বা স্বাধীন অনুবাদ বুঝি। যেহেতু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমি অন্য ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়ার পর বাংলায় অনুবাদ করি, তাই ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষার রস আচ্ছাদন করার সুযোগ আমার নেই। সুতরাং আমি সবসময় ইংরেজি ভাষায় অনূদিত মূলানুগ অনুবাদ করার প্রতি সচেষ্ট থাকি। কেননা স্বাধীন অনুবাদে আসল ভাব কতটুকু বজায় রাখা সম্ভব, সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। আমরা জানি, অনুবাদ হচ্ছে একধরনের সৃষ্টিশীল কর্ম। তাই অনেক সময় মূলানুগ অনুবাদের সঙ্গে নিজের সৃষ্টিশীলতারও খানিক স্পর্শ লেগে থাকা অস্বাভাবিক নয়।
এ কথা সত্যি যে, কোনো লেখা যদি সরাসরি মূল ভাষা থেকে অনুবাদ না হয়ে অন্য আরেক ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয়, তাতে কিছু সমস্যা তো থাকবেই। এ বিষয়ে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার মতামত আছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, ইংরেজি ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা থেকে সরাসরি অনূদিত না হলে, অর্থাৎ অনুবাদ থেকে অনুবাদ হলে, শেষের অনুবাদে হয়তো কিছুটা খামতি দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে ভাবের। তবে বলা হয় যে, অনুবাদকের দুটি আলাদা ভাষার দক্ষতা অনেক সময় সেই খামতি পূরণ করতে পারে। অন্যদিকে ইংরেজিতে অনুবাদ সাহিত্যের জন্য বৃটেনের পেন ক্লাব পদক এবং বানিপাল ট্রাস্ট পুরস্কার প্রাপ্ত সমকালীন আধুনিক আরবী সাহিত্যের সেরা অনুবাদক হামফ্রে ডেভিসের মতে, সাহিত্যের অনুবাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে ভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে, শুরুতেই সেই ভাষাভাষি পাঠকের কাছে পরিচিত একটা গল্প বলার স্টাইল খুঁজে বের করা। তিনি বলেছেন, এই স্টাইল হবে এমন, যা মূল গল্প বলার স্টাইলের সঙ্গে ‘ম্যাচ’ করে অর্থাৎ খাপ খায়। এটা একমাত্র সম্ভব, যখন কোনো অনুবাদক মূল গল্পের ব্যাকরণ ও ভাষার বাইরেও প্রতিটি শব্দ এবং বাক্যের ব্যবহারের বিষয়গুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন।
রাইজিংবিডি: অনুবাদ সাহিত্যের পাঠক অনেক বেশি, একজন অনুবাদক হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা কি একই সমান্তরালে তৈরি হয়, নাকি সময় লাগে?
ফজল হাসান: বর্তমানে বাংলাদেশে অনুবাদ সাহিত্যের অনেক বেশি পাঠক দেখা যায়। নিঃসন্দেহে বিষয়টি ইতিবাচক। আমি মনে করি, একজন অনুবাদক হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা একই সমান্তরালে তৈরি হয় না, এবং বেশ সময় লাগে। আমার কথাই ধরা যাক। আমি অনুবাদ কর্মে প্রবেশ করি ২০১০ সালে এবং প্রথম গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। তারপর ধীরে ধীরে আমার অনুবাদ কাজের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং পাঠক মহলে পরিচিত হতে থাকি। অনেক পাঠক এবং সম্পাদকের কাছে আমার অনুবাদ কাজ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে এবং তাঁরা আমার নাম জানেন। বর্তমানের এই অবস্থানে আসতে আমার অনেক সময় লেগেছে। তার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায় আমার পরবাসী অবস্থান।
রাইজিংবিডি: একজন অনুবাদকের প্রচারণা কৌশল কেমন হওয়া উচিত?
ফজল হাসান: প্রথমেই প্রশ্ন করা যেতে পারে, বইয়ের প্রচারের দায়িত্ব কার, লেখকের নাকি প্রকাশকের, নাকি তৃতীয় কোনো পক্ষের? এ বিষয়ে একাধিক মতবাদ চালু আছে। যেমন একশ্রেণি মানুষের সোজাসাপটা মত হলো লেখকের কাজ কেবল সাহিত্য রচনা করা এবং তারা বই বিক্রির প্রচারক নয়। বরং বই বিক্রির কাজ পুরোপুরিই প্রকাশকের। অন্যদিকে আরেক দল মনে করেন যে, প্রযুক্তির নির্ভর সমাজে নিজের লেখা প্রচারের দায়িত্ব সামান্য হলেও লেখকদের বহন করা উচিত। তৃতীয় পক্ষ (আমার ভাষায়) আরেকটু এগিয়ে বলেন যে, বই প্রচারণার বিষয়ে দৈনিক খবরের কাগজের সাহিত্য সম্পাদক, এমনকি সাপ্তাহিক, পাক্ষিক কিংবা মাসিক পত্রিকা এবং অনলাইন ম্যাগাজিনের সম্পাদকের দায়িত্ব রয়েছে। কেননা তারা সাহিত্য কর্মকে পুস্তাকারে প্রকাশিত হওয়ার আগেই পাঠকের সঙ্গে লেখকদের পরিচয় করিয়ে দেন। তারা প্রকাশিত ভালো বইয়ের খবর ছেপে পাঠককে উৎসাহিত করতে পারেন। যদিও বইমেলার সময় এ বিষয়টি দেখা যায়, তবে সারা বছরই করা যেতে পারে। তাই বলা যেতে পারে যে, একজন অনুবাদকের, এমনকি যে কোনো লেখকের, প্রচারণা কৌশল হওয়া উচিত লেখক, প্রকাশক এবং সাহিত্য সম্পাদকদের ত্রিমুখী সমন্বয়।
রাইজিংবিডি: প্রকাশনীগুলোর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন, সঠিক সময়ে রয়্যালিটি পান কি?
ফজল হাসান: অনুবাদক হিসেবে আমার অনূদিত গ্রন্থের ঝুড়িতে রয়েছে দুজন নোবেল বিজয়ীর দুটি উপন্যাস, ২৩টি ছোটোগল্প সংকলন এবং দুটি সম্পাদিত ও ছোটোগল্প সংকলন। এছাড়া আমার দুটি মৌলিক ছোটোগল্প সংকলন এবং দুটি ভ্রমণ গল্প গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩১টি, যা ১৩টি প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রকাশনা সংস্থার মধ্যে মাত্র তিন বা চারটি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ভালো। তারা প্রুফ পাঠান, প্রচ্ছদ সম্পর্কে মতামত চান এবং চুক্তি করেন। মাত্র একটি প্রকাশনা সংস্থা ছাড়া কোনো প্রকাশনা সংস্থা আমাকে কখনই বিভিন্ন তথ্য জানায়নি, যেমন কতগুলো বই তারা ছেপেছেন, পাঠক প্রিয়তা কতটুকু, বিক্রি কেমন হচ্ছে বা হয়েছে, ইত্যাদি। অবশ্য এসব বিষয়গুলো আমাকে জানালে আমি নিঃসন্দেহে আনন্দিত হতাম এবং উৎসাহ পেতাম। মাত্র দুটি প্রকাশনা সংস্থা (একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পরেও এক প্রকাশনা থেকে একবার) রয়্যালিটি পেয়েছি। বাকিদের সম্পর্কে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
ঢাকা/লিপি
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ন ব ল ব জয় ফজল হ স ন ন ক সময় উপন য স ল খকদ র বইম ল য় র জন য প রথম ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ