২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান বাংলাদেশের জন্য জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তানীতিতে একটি স্থায়ী ঐকমত্য গড়ে তোলার ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে হাজির হয়েছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, রাষ্ট্রের এই মৌলিক ইস্যু আমাদের আলোচনায় আজও প্রান্তে পড়ে আছে। বিশ্ব ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় এ বিষয়ে ঐকমত্য খুবই জরুরি। বিশ্বের সব সফল রাষ্ট্রই তার টেকসই উন্নয়ন ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য কৌশলগত সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশে এই সংস্কৃতির অভাব আমাদের উন্নয়ন পথপরিক্রমায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।  

স্বাধীনতার পর থেকে কমপক্ষে দুবার এ সুযোগ আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। প্রথমবার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠনের সময়। তখন আমরা সার্বভৌমত্ব, সমতা ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু সংহত জাতীয় নিরাপত্তা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কোনো স্থায়ী রূপ পায়নি। দ্বিতীয়বার ১৯৯১ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর। তখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সময়েও আমরা এই অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে পারিনি। 

সৌভাগ্যবশত এই ঐতিহাসিক ঘাটতি শুধরে নেওয়ার তৃতীয় একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জনরাষ্ট্রের অগ্রযাত্রার জন্য দুটি ব্যাপার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা (স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি), আরেকটি উন্নয়নধর্মী নিবারণব্যবস্থা (ডেভেলপমেন্টাল ডেটারেন্স)। এগুলোকে মৌলিক ভিত্তি হিসেবে ধারণ করে সর্বজনগ্রাহ্য জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত জরুরি।

এ কারণেই জুলাই সনদে জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ এবং জাতীয় নিরাপত্তানীতি, কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ঐকমত্যবিষয়ক একটি প্রস্তাবনা আবশ্যক। রাজনৈতিক দলগুলোর এই অঙ্গীকার রূপান্তরের সূচনাবিন্দু হতে পারে। নির্বাচিত সংসদ এই এজেন্ডার বাস্তবায়ন করবে। জাতীয় স্বার্থের ওপর ঐকমত্য কেবল একটি বিমূর্ত ধারণা হিসেবে থাকলে চলবে না; গড়ে তুলতে হবে কৌশলগত সংস্কৃতির (স্ট্র্যাটেজিক কালচার) মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো।  

আরও পড়ুনজাতীয় ঐকমত্য সমঝোতা স্মারকে যা থাকতে পারে ১১ মার্চ ২০২৫কৌশলগত সংস্কৃতি

কৌশলগত সংস্কৃতি ও সংহতি আপনা-আপনি গড়ে ওঠে না। প্রায়ই তা তৈরি হয় সংঘাত বা রূপান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে। উদাহরণস্বরূপ ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের পর ভারত তার প্রতিরক্ষাকাঠামোয় মৌলিক সংস্কার আনে। গান্ধীবাদী কূটনীতির পরিবর্তে প্রতিরোধমূলক সক্ষমতা ও আত্মনির্ভরশীলতার ভিত্তিতে কৌশলগত সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। চীনও পদ্ধতিগতভাবে দলীয় নিয়ন্ত্রণ, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে ‘মৌলিক স্বার্থ’ সংজ্ঞায়িত করেছে।

মনরো (যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো) থেকে ট্রুমান (যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুমান) ডকট্রিনসহ একাধিক কৌশলগত নীতিমালার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কৌশলগত প্রাধান্যের সঙ্গে যুক্ত করে সময়ের প্রেক্ষাপটে আমূল পরিবর্তন এনেছে তারা। 

১৯৪০ সালের লজ্জাজনক পরাজয়ের পর চার্লস ডি গল কৌশলগত স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে ফরাসি জাতীয় স্বার্থ পুনর্গঠন করেন। ১৯৬৬ সালে ন্যাটোর সামরিক কমান্ড থেকে প্রত্যাহার ও পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে এটি বাস্তবায়িত হয়।

মেইজি (জাপানের সম্রাট) পুনরুদ্ধারের পর জাপান একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করে। শিল্পায়ন, ভূখণ্ড সংহতকরণ এবং পরবর্তীকালে সাম্রাজ্য বিস্তার ছিল তাদের জাতীয় স্বার্থের ভিত্তি। দীর্ঘ উপনিবেশ ও যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম পুনরেকত্রীকরণ, সার্বভৌমত্ব ও সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকে জাতীয় স্বার্থ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। একইভাবে ইন্দোনেশিয়ার ‘পঞ্চশীল’ দার্শনিক ভিত্তি তার জাতীয় নিরাপত্তার মূল নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। বর্ণবাদের পতনের পর দক্ষিণ আফ্রিকা গণতান্ত্রিক বৈধতার ভিত্তিতে পুনর্মিলন, মর্যাদা ও মহাদেশীয় নেতৃত্বের ওপর জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করেছে। 

এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে, পরিবর্তনের সময়গুলোয় জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা স্পষ্ট হয়। আর কৌশলগত সংস্কৃতি শুধু সামরিক নীতিতেই নয়, শিক্ষানীতি, কূটনীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনাতেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও উন্নয়নধর্মী নিবারণব্যবস্থা 

বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকাঠামো নির্মাণে কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা (অর্থাৎ স্বাধীন ও দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা) এবং উন্নয়নধর্মী নিবারণব্যবস্থার (যথা শান্তি ও অধিকার নিশ্চিত করা) মাধ্যমে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি—এ দুই ধারণাই একটি সুসংহত নিরাপত্তাকাঠামোর ভিত্তি হতে পারে।

উন্নয়নধর্মী নিবারণব্যবস্থা প্রথাগত নিবারণব্যবস্থার চেয়ে ভিন্ন। এটি শুধু সামরিক নয়, বরং কৌশলগত। এর মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র তার উন্নয়নকাঠামোকে নির্বিঘ্ন রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ সিঙ্গাপুর দ্রুত সামরিক আধুনিকীকরণ করেছে আগ্রাসনের জন্য নয়, বরং উন্নয়ন–নিরাপত্তার জন্য। বাংলাদেশকেও একইভাবে তার জনমিতিক সম্পদ ও বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে থাকবে। প্রতিরক্ষানীতিতে থাকতে হবে দৃঢ় নিবারণ সক্ষমতা। 

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। প্রতিবেশী মিয়ানমারে চলছে জাতিগত সংঘাত। এসবের প্রেক্ষাপটে কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতার ভিত্তিতে যদি আমরা জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল গ্রহণ করতে পারি, তাহলে তা বাংলাদেশকে ভূকৌশলগত সক্ষমতা ও ভূরাজনৈতিক প্রাধান্য প্রদান করতে পারে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সরকার, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ বিশেষজ্ঞ এবং গণমাধ্যমের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি।

সম্পর্কের চারটি দৃশ্যপট 

সম্পর্কের চারটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট কল্পনা করা যেতে পারে। প্রতিবেশীর দিকে ঝুঁকে পড়া, কোনো এক পরাশক্তির দিকে ঝোঁক, ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা এবং স্বাধীন, পারস্পরিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কূটনীতি। এর মধ্যে চতুর্থ সম্ভাব্য দৃশ্যপট তথা স্বাধীন ও পারস্পরিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশলই কেবল দীর্ঘস্থায়ী টেকসই অগ্রসর হওয়ার পথ উন্মুক্ত করতে পারে। এই পথে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া যাত্রা সম্ভব নয়। জাতীয় অগ্রাধিকার, নৈতিক বৈধতা এবং কৌশলগত স্বচ্ছতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তানীতি শুধু সামরিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি সমন্বিত কাঠামো। সেখানে অর্থনীতি, কূটনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশগত নিরাপত্তা একসঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। একটি কার্যকর জাতীয় নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে তুলতে হলে এ সব দিকই বিবেচনায় নিতে হবে। 

নিরাপত্তানীতি উদ্ভূত হতে হবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষা থেকে। বিশেষ করে নিরাপত্তানীতিতে বহুপক্ষীয়তায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ, উন্নয়ন অর্থায়ন, বাণিজ্য ও জলবায়ু–কূটনীতিবিষয়ক দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। তাহলেই বিশ্বকে জানান দেওয়া যাবে যে বাংলাদেশ কেবল প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে না। সেই সঙ্গে বৈধ, সার্বভৌম কৌশলগত পরিচয় ঘোষণা করছে। নিরাপত্তানীতি সশস্ত্র বাহিনী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ নানা সংস্থার কাজ সম্পর্কে জনগণের কাছে স্পষ্ট ও আত্মবিশ্বাস প্রদান করবে। জনগণের কাছ থেকে নৈতিক বৈধতা অর্জনের মাধ্যমে কৌশলগত সংস্কৃতি জাতীয় সংহতি গড়বে। জাতীয় সংহতিই প্রধানতম কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও নিবারণব্যবস্থা। 

কৌশলগত ভবিষ্যৎ

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান জাতির ক্ষমতায়নের প্রতীক। জনগণ তার সক্ষমতার কথা জানান দিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানকে ধারণ করতে হলে সব রাজনৈতিক দলকে জুলাই চার্টারে একটি অঙ্গীকার নিশ্চিত করতে হবে। এই অঙ্গীকার হবে একটি সর্বব্যাপী জাতীয় নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ সংজ্ঞায়িত করা ও জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অঙ্গীকার। জাতীয় স্বার্থবিষয়ক ঐকমত্য গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এই ব্যাপারে পথনকশা জরুরি ও অপরিহার্য। ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অতীতকে সমন্বিত করতে, বর্তমানকে স্থিতিশীল করতে এবং ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করতে পারবে।

ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যে রাষ্ট্র কাজ করে নির্ধারিত জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে, তারা টিকে থাকে। যারা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করে, তারা বিকশিত হয়। গণ–অভ্যুত্থান শুধু কণ্ঠের পুনরুদ্ধার নয়, দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল বদলের ভিত্তিতে সুসংহত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামো গঠনের অঙ্গীকারও। 

ড.

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক শলগত স স ক ত ক শলগত স ব র জন ত ক ব যবস থ ঐকমত য র জন য ক টন ত ক ষমত ত করত

এছাড়াও পড়ুন:

সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের সুপারিশ, একমত নয় দলগুলো

জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান–সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতার মধ্যে বিশেষজ্ঞদের নতুন পরামর্শ প্রস্তাব সামনে এনেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তাতে বলা হয়েছে, মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারি করতে পারে। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। এরপর আদেশটি নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করা যেতে পারে।

গতকাল বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় প্রস্তাবটি উপস্থাপন করা হয়। তবে এটি নিয়েও কোনো ঐকমত্য হয়নি। বিএনপিসহ কিছু দল প্রস্তাবটির সঙ্গে দ্বিমত করেছে। প্রস্তাবটি জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তাবের কাছাকাছি, তারা এটি সমর্থন করেছে। আর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, প্রস্তাবটি নিয়ে তাদের দলে আলোচনা করতে হবে।

এর বাইরে সংবিধানের সংশোধন বা সংবিধান আদেশ অন্তর্বর্তী সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ করতে পারবে কি না বা অন্য কোনো উপায়ে এটা করা যায় কি না, এ বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। আরও কয়েকটি দলও সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়ার কথা বলেছে। তবে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে।

রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গতকাল সকাল থেকে শুরু হওয়া আলোচনা বিকেল পাঁচটায় মুলতবি করা হয়। এ বিষয়ে আগামী অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে আবার আনুষ্ঠানিক আলোচনা হতে পারে। আলোচনার তারিখ পরে জানাবে ঐকমত্য কমিশন।

সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার থেকে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করছে ঐকমত্য কমিশন। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে দুই পর্বে দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। এতে ৮৪টি প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। যদিও গতকাল পর্যন্ত সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

নতুন প্রস্তাবে যা আছে

সংবিধান–সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে একাধিকবার বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। গতকালের বৈঠকে ‘বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মত চূড়ান্ত অভিমত’ শিরোনামে একটি প্রস্তাব তুলে ধরে কমিশন।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আইনবিশেষজ্ঞদের প্যানেল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে কিছু পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকারকে সুপারিশ করার পরামর্শ দিয়েছে। সেগুলো হলো:

১. অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণার ২২ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীনে একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারি করতে পারে; যেখানে জুলাই সনদে উল্লিখিত মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই আদেশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে।

২. পরবর্তীতে এই সংবিধান আদেশ নিয়ে গণভোটে করা যেতে পারে। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট হবে। সংবিধান আদেশে গণভোটের বিধান রাখা যেতে পারে।

৩. যদি গণভোটের মাধ্যমে জনগণ সংবিধান আদেশের প্রতি সম্মতি দেয়, তবে তা কার্যকর হওয়ার তারিখ থেকেই অনুমোদিত বলে গণ্য হবে।

প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়। ওই ঘোষণাপত্রের ২২ দফায় বলা আছে, ‘...বাংলাদেশের জনগণ সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধান ও সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।’

দলগুলোর অবস্থান

গতকালের আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই ঘোষণার ২২ নম্বর দফার ভিত্তিতে সংবিধান আদেশ জারির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জুলাই ঘোষণার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও এখনো এর আইনি ভিত্তি নেই। আর ঘোষণাপত্র বলা হয়েছে, এসব বাস্তবায়ন করা হবে। করা হয়েছে, তা নয়। সুতরাং এটার ভিত্তিতে সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়া যায় কি না, তিনি সে প্রশ্ন তোলেন।

বিএনপির এই নেতা বলেন, জুলাই ঘোষণায় সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, সময় ও ফোরাম কোনটা হবে, তা বলা আছে। এ সময় তিনি জুলাই ঘোষণাপত্রের ২৫ ও ২৭ নম্বর দফার উল্লেখ করেন, যেখানে আগামী সংসদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের কথা বলা হয়েছে।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, অবিলম্বে যদি জুলাই সনদ কার্যকর হয়, তাহলে সংবিধান সংশোধন হয়ে গেল। কিন্তু এর বৈধতা কে দেবে, তিনি সেই প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, সংবিধানের ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুপ্রিম কোটের মতামত চাওয়া যায় যে, সংবিধান আদেশ বা অন্য কোনোভাবে সংবিধানে পরিবর্তন আনা যায় কি না।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটের প্রস্তাব ভালো। কিন্তু সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে সংসদে সংশোধনী পাস হওয়ার পর গণভোট করতেই হবে। এখন আগে একবার এবং পরে একবার, কয়বার গণভোট করা হবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে।

বাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এনডিএম, ১২–দলীয় জোটসহ আরও কয়েকটি দল ও জোটের পক্ষ থেকেও সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার কথা বলা হয়। তবে কোন কোন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়া হবে, আলোচনায় তা সবাই পরিষ্কার করেননি।

আলোচনায় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, তাঁরা মনে করেন ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়াটাই সবচেয়ে ভালো বিকল্প। আদালতের মতামত নিশ্চয় সবাই মানবে। সন্দেহ নেই, একটা অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এখান থেকে বের হতে হবে। তবে যেনতেনভাবে বের হলে হবে না। এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে সবার ‘উইন উইন’ অবস্থা থাকে।

জামায়াত ও এনসিপি যা বলেছে

গতকাল আনা প্রস্তাবটি সমর্থন করেছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ আলোচনায় বলেন, ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ সমাধান নয়। সংবিধান আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি দেওয়া হোক, তার ভিত্তিতে নির্বাচন হতে হবে। আর গণভোট সবচেয়ে শক্তিশালী। সংসদ মৌলিক সংস্কার বা সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তন করতে পারবে না।

হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়া হলে পরে জটিলতা তৈরি হবে কি না, তা দেখতে হবে। এখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন হচ্ছে, সেখানে থাকবেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। আবার কেউ কেউ রাষ্ট্রপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন। সুতরাং এখান থেকে নিরপেক্ষ সমাধান আসবে কি না, তা নিয়ে ঝুঁকি আছে। তাঁরা আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান না।

নতুন প্রস্তাবটি নিয়ে তাদের দলে আলোচনা করতে হবে বলে জানান এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন। তিনি বলেন, পরবর্তী সংসদে গিয়ে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হবে, এমন একটা ইঙ্গিত আলোচনা থেকে পাওয়া যাচ্ছে। সেটা একটু ঘুরিয়ে, ১০৬ অনুচ্ছেদকে সামনে এনে। যদি আদালত বলেন, এটা করা যাবে না। তখন কী হবে?

জাবেদ রাসিন বলেন, তাঁরা এই সরকারের অধীনে সনদের বাস্তবায়ন চান। এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পথ হলো গণপরিষদ, যা একই সঙ্গে নিয়মিত সংসদ হিসেবেও কাজ করতে পারে।

একাধিক বিকল্প সুপারিশ থাকবে

গতকালের আলোচনা শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধান–সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পূর্ণাঙ্গ মতামত দলগুলোর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। অনেকে এটা সমর্থন করেছেন, অনেকেই এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। আগের যেসব প্রস্তাব ছিল, সেগুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে সংবিধানের ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে সুপ্রিম কোর্টের কাছে মতামত চাওয়া যেতে পারে—এ রকম মত এসেছে।

বৈঠক মুলতবি করা হয়েছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, তাঁরা দলগুলোকে কিছুটা সময় দিতে চান। যাতে দলগুলো পরস্পর আলোচনা করতে পারে। সরকারকে একাধিক বিকল্প পদ্ধতি সুপারিশ করতে চায় কমিশন। এখন দলগুলোর কাছ থেকে ছয়টির মতো এবং বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে একটি মতামত আছে। কমিশন বিকল্প আরও কমিয়ে আনতে চায়। অক্টোবরের শুরুর দিকে আবার আলোচনায় বসে দ্রুত কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তৈরি করে সরকারকে দেওয়া যাবে বলে তাঁরা আশা করছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কারও ওপর আক্রমণ হলে যৌথভাবে জবাব দেবে পাকিস্তান ও সৌদি আরব
  • সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের সুপারিশ, একমত নয় দলগুলো
  • ‘সংবিধান আদেশ’ জারির সুপারিশ করতে পারে কমিশন: আলী রীয়াজ
  • কমিটি গঠন, প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত 
  • বর্ধিত মেয়াদের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন: আলী রীয়াজ
  • বিএনপি নির্বাচনমুখী কর্মসূচিতে যাবে
  • দলগুলোর সঙ্গে বুধবার আবার আলোচনায় বসছে ঐকমত্য কমিশন
  • ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হতে হবে
  • জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ফের এক মাস বাড়ল
  • কলকাতায় সম্মিলিত সেনা সম্মেলনের উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী মোদির