Risingbd:
2025-05-28@22:58:54 GMT

ছাত্রদলে নতুন কমিটির গুঞ্জন

Published: 26th, May 2025 GMT

ছাত্রদলে নতুন কমিটির গুঞ্জন

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে অতিদ্রুত নতুন কমিটি গঠন করা হবে। সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে এ আলোচনা এখন তুঙ্গে। খোদ বিএনপি চেয়ারপার্সন তারেক রহমান ব্যক্তিগতভাবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ওপর নজরদারি রাখতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

কমিটির মেয়াদ পূর্ণ না করে দুই বছর মেয়াদী কমিটি কেন ভাঙা হবে, তা নিয়ে রয়েছে পক্ষে-বিপক্ষে মত। নতুন কমিটির রূপরেখাও দিচ্ছেন কেউ কেউ। তবে বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষনেতারা বলছেন, সংগঠনে এমন কোনো আলোচনা নেই। তারপরও দল চাইলে কমিটি ভাঙতেই পারে।

জানা গেছে, গত বছর ১ মার্চ বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে সভাপতি এবং নাসির উদ্দীন নাসিরকে সাধারণ সম্পাদক করে সাত সদস্যের আংশিক কমিটির নাম ঘোষণা করা হয়। পরে ১৫ জুন তিনটি পদ ফাঁকা রেখে ২৬০ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় দফায় কমিটি বর্ধিত করার কথা থাকলেও তা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।

আরো পড়ুন:

ছাত্রীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক: নোবিপ্রবির সেই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত

তিতুমীর কলেজে বৈষম্যবিরোধীসহ সাংবাদিকদের ওপর ছাত্রদলের হামলা

তারপর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মহানগর, জেলাসহ বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি গঠনে ছাত্রদলের এ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ওঠে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ। এ নিয়ে সংগঠনের একাংশের মধ্যে তৈরি হয় অসন্তোষ।

রাকিব-নাছিরের বর্তমান নেতৃত্ব দুঃসময়ের ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন, নিষ্ক্রিয়, ‘মাই ম্যান' ও অছাত্রদের পদায়নের অভিযোগে দুষ্ট। এমনকি বিভিন্ন ইউনিটে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও কখনোই ছাত্রদল না করা ব্যক্তিদের পদায়নের অভিযোগ রয়েছে‌। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি ইউনিটে কমিটি ঘোষণার পর ছাত্রদলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের একটি অংশ তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এছাড়া বিক্ষোভ, ককটেল বিস্ফোরণ, রাকিব-নাছিরের কুশপুত্তলিকা পোড়ানোসহ নানা কর্মসূচি পালন করে এই অংশটি।

এতে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলোতে পদপ্রাপ্তদের অনেকেই ঢুকতে পারেনি ক্যাম্পাসে। পরবর্তীতে বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের সরাসরি হস্তক্ষেপ ও পদবঞ্চিতদের সঙ্গে সমন্বয়ের ফলে বর্তমানে পরিস্থিতি বাহ্যত শান্ত। এ নিয়ে বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল সভাপতি-সম্পাদককে সঙ্গে নিয়ে পদবঞ্চিতদের সঙ্গে বৈঠক, দাপ্তরিকভাবে পদবঞ্চিতদের জীবনবৃত্তান্ত গ্রহণ করার পরও পদ পায়নি বঞ্চিতরা। ছাত্র সম্পাদকের বেশ কয়েকবারের আশ্বাস প্রদানও বিফলে গেছে। 

সম্প্রতি গণমাধ্যমে বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোচনায় আসেন রাকিব। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের পরও রাকিব-নাছিরের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বেশ কিছু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফাঁকা তিনটি পদের মধ্যে দুটিতে পদায়ন হলেও একজন সভাপতি আরেকজন সম্পাদকের ঘনিষ্ঠ বলেই অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদবঞ্চিত ঢাবি ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা অভিযোগ করে বলেন, “ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের বর্তমান কমিটিতে পদায়নের ক্ষেত্রে ন্যূনতম কোনো মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়নি। নির্দিষ্ট অঞ্চলের নেতা তৈরি করা হয়েছে, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের পদধারী নেতা, সরকারি চাকরিজীবী, ব্যাংকার ছাত্রদলের পদ পেয়েছে। ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদে এমন অনেকে নেতৃত্বে এসেছেন, যাদের প্রথম রাজনৈতিক পদ ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক।”

তিনি বলেন, “পূর্বে ওই নেতাদের কোনো রাজনৈতিক পদ ছিল না। তাদের পরিচয় তারা সভাপতি-সম্পাদকের লোক। কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সময় কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছিল, যেসব ছাত্রদল নেতাকর্মী ২৮ অক্টোবরের পরবর্তী সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেছে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। কিন্তু আমরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র কমিটিতে দেখলাম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের রাজপথে রক্ত,শ্রম, ঘাম দেওয়া কর্মীদের বঞ্চিত করে সভাপতি-সম্পাদকের নিজ এলাকার গ্রুপের অগ্রাধিকার দেওয়া হলো।”

তিনি আরো বলেন, “ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের কমিটির ক্ষেত্রে সুপার ইউনিট হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এবারই প্রথম সর্বোচ্চ সংখ্যক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা কেন্দ্রীয় সংসদে পদবঞ্চিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য সুপার ইউনিটের ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে যাকে-তাকে দিয়ে তারা পদ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। এতে ভবিষ্যতে ছাত্রদলের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি ও ছাত্রদলের রাজনীতি করতে নিরুৎসাহিত করবে।”

এই নেতা বলেন, “২৮ অক্টোবর থেকে ৭ জানুয়ারি আমি ব্যক্তিগতভাবে যতগুলো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছি, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের ২৬০ সদস্যের মধ্যে ৫০ জনও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা আমার সমান রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছে।”

নাম প্রকাশ না করা শর্তে বর্তমান কমিটির এক যুগ্ম-সম্পাদক বলেন, বর্তমান শীর্ষ দুই নেতৃত্ব কমিটির অনেকেরই ফোন ধরেন না। যাদের ফোন ধরেন না, তারা তো নির্দেশনামাফিক কাজ করতে পারেন না। তাহলে তারা কেনো বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখবে?”

ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জানায়, অভ্যুত্থান পরবর্তী অনুকূল পরিবেশেও ছাত্রদলের বর্তমান নেতৃত্ব শিক্ষার্থীবান্ধব ও ইতিবাচক কর্মসূচি দিতে না পারা, নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা, অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য, নিষ্ক্রিয় ও ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টদের পদায়ন এবং ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে দুঃসময়ের ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মীদের কৌশলে পদবঞ্চিত করার ব্যাপক অভিযোগ পেয়েছে নীতি-নির্ধারণী মহল।

জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে মূলধারার বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন বেশ কিছু শিক্ষার্থীবান্ধব ও সাড়া জাগানো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। সেই তুলনায় তেমন কোনো শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি নেই ছাত্রদলের। বরং দিনদিন ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদলের জনপ্রিয়তা ও নেতাকর্মী ক্রমশ কমছে। নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ঢাকতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এজন্যই কৌশলে ঠেকাতে চায় তারা। ফলে বর্তমান কমিটি ভেঙ্গে নতুন কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। 

যেকোন মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে ছাত্রদলের এই কমিটি- এমন গুঞ্জন নেতাকর্মীদের মধ্যে। সম্ভাব্য নতুন কমিটিতে কাঙ্ক্ষিত জায়গা পেতে পদপ্রত্যাশীরা বেশ দৌড়ঝাঁপও শুরু করেছেন।

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সম্ভাব্য কমিটির শীর্ষ পদের জন্য আলোচনায় থাকা ঢাবির নেতারা হলেন-২০০৭-০৮ সেশন থেকে নাসির উদ্দিন নাসির, শ্যামল মালুম এবং জহির রায়হান আহমেদ। ২০০৮-০৯ সেশন থেকে এইচ এম আবু জাফর, খোরশেদ আলম সোহেল, রিয়াদ রহমান, শাফি ইসলাম এবং সোহেল রানা।

২০০৯-১০ সেশনের আমানুল্লাহ আমান, এস এম মাহমুদুল হাসান রনি, মমিনুল ইসলাম জিসান, শরিফ প্রধান শুভ, ফারুক হোসেন, আরিফুল ইসলাম, শাহরিয়ার হক মজুমদার শিমুল এবং মাসুদুর রহমান মাসুদ। ২০১০-১১ সেশনের গণেশ চন্দ্র রায় সাহস, মাসুম বিল্লাহ (এফআর) এবং আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক।

২০১১-১২ সেশনের গাজী মো.

সাদ্দাম হোসেন, আব্দুর রহিম রনি, তারেক হাসান মামুন, মিনহাজ আহমেদ প্রিন্স, আব্দুল হান্নান তালুকদার, রাজু আহমদ, শামীম আকতার শুভ, সাইফুল আলম বাদশা, জাহিদ হাসান শাকিল এবং সোহেল রানা।

ঢাকা/মেহেদী

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ছ ত রদল ছ ত রদল ক ন দ র ন ত কর ম দ র ছ ত রদল র পদবঞ চ ত ল ইসল ম পরবর ত কম ট ত র জন ত পদ য ন কম ট র রহম ন ব এনপ গঠন ক ইউন ট স গঠন

এছাড়াও পড়ুন:

ভারত–পাকিস্তানের হাতে পারমাণবিক বোমার চেয়েও ভয়ংকর অস্ত্র

সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তানের সংঘাতটি আমাদের চোখে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র আসলে পারমাণবিক বোমা নয়, বরং বয়ান বা কাহিনি তৈরি করা।

ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করল এবং পাকিস্তান পাল্টা জবাব দিল ‘অপারেশন বুনিয়ান আল–মারসুস’-এর মাধ্যমে। কিন্তু আপনি যদি ভাবেন, এ ঘটনা কেবল পাল্টাপাল্টি সামরিক হামলার গল্প, তাহলে আসল কথাটা আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে।
এই যুদ্ধ আসলে শুধু ক্ষেপণাস্ত্রের নয়। এটা ছিল ‘বয়ানের যুদ্ধ’।

পত্রিকার শিরোনামে, হ্যাশট্যাগে এবং টেলিভিশনের রাতের নিউজরুমে পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত এক লড়াই। যুদ্ধের ময়দান ছিল গণমাধ্যম, গোলাবারুদ ছিল ভাষা, আর হতাহত হয়েছিল সত্য।

আমরা যা দেখলাম, তাকে আজকের দুনিয়ায় বলা হয় ‘বক্তৃতার যুদ্ধ’। অর্থাৎ ভাষার মাধ্যমে পরিচয়, বৈধতা ও ক্ষমতার পরিকল্পিত নির্মাণ। ভারত ও পাকিস্তানের গণমাধ্যমের হাতে প্রতিটি সহিংসতার ঘটনা যেন ছিল চিত্রনাট্য অনুযায়ী পরিচালিত। যুদ্ধের প্রতিটি ছবি ছিল কৌশলে নির্বাচিত। আর প্রতিটি প্রাণহানি ছিল নিছক রাজনৈতিক উপাদান। আর সংবাদগুলো ছিল অভিনয়।

আরও পড়ুনশক্তি দেখাতে গিয়ে ভারতের দুর্বলতা বেরিয়ে এল কি?১৩ মে ২০২৫দৃশ্য এক: ন্যায়সংগত আঘাত

৬ মে, প্রথম আঘাত হানে ভারত। তবে ভারতীয় গণমাধ্যম যেভাবে উপস্থাপন করল, তাতে মনে হলো—ভারত আসলে আত্মরক্ষার্থে প্রথম জবাব দিয়েছে।  
‘অপারেশন সিঁদুর’ ঘোষিত হলো নাটকীয় ভঙ্গিতে। ২৫ মিনিটে ২৪টি হামলা। ধ্বংস হলো ৯টি ‘সন্ত্রাসের ঘাঁটি’। কোনো বেসামরিক প্রাণহানি হয়নি—এমনটাই দাবি। দোষীদের নাম প্রকাশ করা হলো—জইশ-ই-মুহাম্মদ, লস্কর-ই-তইবা এবং বাহাওয়ালপুর ও মুজাফফরাবাদে ছড়িয়ে থাকা ‘সন্ত্রাসের কারখানা’। সবকিছুই নাকি মাটির সঙ্গে মিশে গেল।

শিরোনামগুলো ছিল জয়ের উল্লাসে ভরা—‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ২.০’, ‘ভারতীয় সেনার গর্জন পৌঁছাল রাওয়ালপিন্ডিতে’, ‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত’। সরকারিভাবে জানানো হলো এটি ছিল পেহেলগামে ২৬ জন ভারতীয় পর্যটকের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় ‘উপযুক্ত জবাব’। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বললেন, ‘তারা ভারতের কপালে আঘাত করেছিল, আমরা তাদের বুকে আঘাত করেছি।‘ শব্দচয়নটা যেন সিনেমার চিত্রনাট্য। আর তা খুব জেনেবুঝেই এমন করা হয়েছে।

আরও পড়ুনভারত হামলা চালিয়ে যেভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি বাড়িয়ে দিল২০ মে ২০২৫

ভারতীয় গণমাধ্যম নিজের এমন এক পরিচয় দাঁড় করাল, যেখানে সে নৈতিক শক্তির অধিকারী এক রাষ্ট্র, যাকে বাধ্য না করলে সে আঘাত করে না। সে প্রতিশোধ নেয় না। সংযম রক্ষা করে। তার যে শুধু ক্ষেপণাস্ত্র আছে, তা–ই নয়, তার বড় অস্ত্র—ন্যায়ধর্ম ও নৈতিকতা অস্ত্র। তার শত্রু পাকিস্তান নয়, বরং সন্ত্রাস।

এভাবেই বয়ান তৈরি হয়। এখানে সে নিজেকে আক্রমণকারী নয়, বরং ন্যায়ের পক্ষে এক যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল। আর তা করল ভাষার মাধ্যমে। ভারতের জন্য এই পরিচয় গড়ে তুলল গণমাধ্যম। একটি কাহিনি গড়ে তুলে। সামরিক শক্তির সঙ্গে এখানে মিশে আছে নৈতিকতা। হামলাগুলো আগ্রাসন ছিল না। ছিল ন্যায় প্রতিষ্ঠার কর্তব্য সম্পাদন।

দৃশ্য দুই: পবিত্র প্রতিরক্ষা

তিন দিন পর পাকিস্তান পাল্টা জবাব দেয়। চালু হয় ‘অপারেশন বুনিয়ান আল–মারসুস’—আরবিতে যার অর্থ ‘লোহার প্রাচীর’। এই নামই সব বলে দেয়। এটা কেবল প্রতিশোধ ছিল না, বরং এক ধর্মীয় ঘোষণা। একজাতীয় আহ্বান। শত্রু ঢুকে পড়ার দুঃসাহস করেছিল। এবার তার জবাব হবে মনে রাখার মতো।

পাকিস্তানি ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষিত হয় ভারতীয় সামরিক ঘাঁটিতে—ব্রিগেড সদর দপ্তর, এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা ও পাঞ্জাব ও জম্মুর সামরিক স্থাপনায়। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ঘোষণা দেন, পাকিস্তান ‘১৯৭১-এর যুদ্ধের প্রতিশোধ নিয়েছে’। সেই যুদ্ধে পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করেছিল এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। পাকিস্তানও তার কাহিনি তৈরি করা শুরু করল।

পাকিস্তানের গণমাধ্যম এই গল্প ছড়িয়ে দেয়। সারা দেশ দেশপ্রেমের উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। ভারতের হামলাকে দেখানো হয় যুদ্ধাপরাধ হিসেবে—মসজিদে হামলা, বেসামরিক মানুষ নিহত। ধ্বংসাবশেষ ও রক্তাক্ত ছবির সঙ্গে যুক্ত হয় ‘শহীদ’ শব্দটি।
পাকিস্তান নিজের জাতীয় পরিচয় গড়ে তোলে—আমার শান্তিপ্রিয়, কিন্তু প্ররোচিত; সংযত, কিন্তু দৃঢ়। আমরা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু ভয়ও পাই না।

ভারত–পাকিস্তান দুই দেশের হাজির করা গল্পের মধ্যে অবিশ্বাস্য মিল। উভয় রাষ্ট্রই নিজেকে ভাবছে আত্মরক্ষাকারী। তাদের কেউই আক্রমণকারী নয়। উভয়েরই দাবি—তারা নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ। উভয়েরই ভাষা—প্রথম গুলি চালিয়েছে শত্রু। জবাব দেওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না।

আরও পড়ুনমোদির ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধ’ ভারতকে আরও বিপদে ফেলবে১৫ মে ২০২৫কে জালিম আর কে মজলুম

দুই দেশই নিজেকে মজলুম হিসেবে জাহির করেছে। দুই দেশই বলছে, তাদের ওপর অন্যায় আক্রমণ হয়েছে। এই ক্ষেত্রেও দুই দেশের তৈরি করা গল্পে অদ্ভুত মিল।
ভারত উপস্থাপন করে পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসের কারখানা’ হিসেবে, যে কিনা প্রতারক, নিয়ন্ত্রণহীন, জিহাদের নেশায় মত্ত এক পারমাণবিক দানব। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে শান্তি অসম্ভব। কারণ ‘ওরা’ কোনো যুক্তিবুদ্ধির ধার ধারে না।

অন্যদিকে পাকিস্তান ভারতকে তুলে ধরে এক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে, যার নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী সরকার, যার উদ্দেশ্য ইতিহাস থেকে মুসলমানদের মুছে ফেলা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই আক্রমণকারী। ভারতই দখলদার। তাদের হামলা সন্ত্রাসবিরোধী নয়, বরং ধর্মযুদ্ধ।

ভারতীয় গণমাধ্যম যে ভাষায় কথা বলেছে, তার নাম ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’। পাকিস্তানে ঘাঁটি গাড়া জঙ্গিদের লক্ষ করে হামলা চালিয়ে ভারত নিজেকে তুলে ধরেছে বৈশ্বিক নিরাপত্তার অংশীদার হিসেবে। এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে, আর ইসরায়েল গাজায়।

উভয় ক্ষেত্রেই শত্রু কেবল হুমকি নয়, সে এক মতাদর্শ। আর মতাদর্শের সঙ্গে যুক্তি চলে না।

এটাই গণমাধ্যম-নির্ভর পরিচয় নির্মাণের বিপদ। একবার যদি ‘অন্যজন’কে আপনি তামাশার পাত্র করে দেন, নিজেকে নায়ক বানিয়ে ফেলেন, তাহলে আর সংলাপ সম্ভব নয়। তখন কূটনীতি হয়ে ওঠে দুর্বলতা। আপস হয় বিশ্বাসঘাতকতা। আর যুদ্ধ হয়ে পড়ে কাঙ্ক্ষিত।

ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। মানুষ মরেছে। দুই কাশ্মীরেই বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। সীমান্ত গ্রামের ওপর গোলাবর্ষণ হয়েছে। নিরপরাধ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। কিন্তু এই মানবিক গল্পগুলো চাপা পড়ে গেছে কৃত্রিম গল্পের ধ্বংসস্তূপে। কোনো দেশের গণমাধ্যম অন্য দেশের নিরীহ নিহত মানুষের জন্য কোনো শোক প্রকাশ করেনি। যারা ‘আমাদের’, তারা শহীদ। যারা ‘ওদের’? তারা হয় নেহাত ক্ষয়ক্ষতি, নয়তো ভুয়া মিথ্যা গল্প। যখন আমরা কেবল নিজেদের মৃতদের জন্য কাঁদি, তখন ন্যায়বিচার মরে যায়। আর সেই অসাড়তার মধ্যেই পরবর্তী সহিংসতা হয়ে ওঠে আরও সহজ।

বৈধতার জন্য লড়াই

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে কেবল ভূখণ্ড বা কৌশলগত সুবিধা নিয়ে ছিল না। সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল বৈধতা। উভয় রাষ্ট্রই নিজেদের জনগণ ও গোটা বিশ্বের কাছে নিজেকে তুলে ধরতে চেয়েছে ‘ইতিহাসের সঠিক পক্ষে’ অবস্থানকারী হিসেবে।

ভারতীয় গণমাধ্যম যে ভাষায় কথা বলেছে, তার নাম ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’। পাকিস্তানে ঘাঁটি গাড়া জঙ্গিদের লক্ষ করে হামলা চালিয়ে ভারত নিজেকে তুলে ধরেছে বৈশ্বিক নিরাপত্তার অংশীদার হিসেবে। এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে, আর ইসরায়েল গাজায়।

অন্যদিকে পাকিস্তানি গণমাধ্যম নির্ভর করেছে সার্বভৌমত্বের বয়ানের ওপর। ভারতের হামলা তাদের কাছে কেবল পাকিস্তানের মাটিতে হয়নি। এই আঘাত তাদের ইজ্জতের ওপর আঘাত। পাকিস্তান ধর্মীয় স্থান ও বেসামরিক মৃত্যুর ছবি ছড়িয়ে দিয়ে ভারতকে তুলে ধরেছে ধর্মদ্রোহী হিসেবে।

এই কথার যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত সত্যকে ঢেকে দিয়েছে। ভারত যখন দাবি করে ৮০ জঙ্গিকে হত্যা করেছে, পাকিস্তান বলে—সবই বানানো। পাকিস্তান দাবি করে, তারা ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, ভারত বলে—মিথ্যা প্রচার। উভয়ই একে অপরকে দোষ দেয় ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্য। তাদের প্রত্যেকের সংবাদমাধ্যম হয়ে ওঠে ‘আরশিনগর’— ‘আয়নার ঘর’। এখানে শুধু নিজের মুখই দেখা যায়।

নতুন করে শোনার ডাক

১৩ মে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় অস্ত্রবিরতি হয়। দুই দেশই বিজয় দাবি করে। কিন্তু থেকে যায় দুই পক্ষের তৈরি করা নিজেদের বয়ান—আমরা ঠিক ছিলাম। ওরা ভুল। আমরা শক্তি দেখিয়েছি। ওরা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।  

এই বয়ানই ভবিষ্যতের পাঠ্যপুস্তক, নির্বাচন, সেনাবাহিনীর বাজেট নির্ধারণ করবে। পরবর্তী সংঘাত, পরবর্তী গোলাগুলি, পরবর্তী যুদ্ধের ভিত্তি গড়ে দেবে।

এবং এই বয়ান বদল না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বদলাবে না। কিন্তু এই বয়ান বদলানো সম্ভব। বদলাতে হবে। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র পারমাণবিক বোমা নয়। সেই অস্ত্রের নাম কাহিনী বা বয়ান।

সাইয়িদা সানা বাতুল  যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাংবাদিক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইবিতে ছাত্র ইউনিয়নের মশাল মিছিল
  • উপকূলে ঝড়ের আশঙ্কা, সমুদ্র বন্দরে ৩ নম্বর সংকেত
  • রাবিতে সংঘর্ষ: ৩ ছাত্র সংগঠনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ-প্রতিবাদ
  • সাগরে লঘুচাপ, বন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত
  • ভারত–পাকিস্তানের হাতে পারমাণবিক বোমার চেয়েও ভয়ংকর অস্ত্র
  • অভ্যুত্থানবিরোধীদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইবি উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি
  • সিদ্ধিরগঞ্জে হোসিয়ারী শ্রমিক ফারুক হত্যায় গ্রেপ্তার ৫  
  • সাগরের লঘুচাপটি নিম্নচাপ হতে পারে, ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা কতটুকু
  • চাকরি ফেরত পেলেন নোবিপ্রবিতে ৭ শিক্ষক-কর্মকর্তা