কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে সিলেটসহ উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জনজীবন যখন চরম দুর্ভোগে পতিত, তখন সিলেট হইতে আসিল গভীরতর বেদনাদায়ক দুঃসংবাদ। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা যাইতেছে, শনিবার গভীর রাত্রিতে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বখতিয়ারঘাট এলাকায় টিলা ধসিয়া এক পরিবারের চারজন ঘুমন্ত অবস্থাতেই প্রাণ হারাইয়াছেন। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জানাইয়াছেন, কয়েকদিন ধরিয়া টিলাধসের আশঙ্কায় উক্ত এলাকায় মাইকিংযোগে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক করা হইতেছিল। স্পষ্টত, সেই সতর্কবার্তা কাহারও কর্ণকুহরে প্রবেশ করে নাই। আমরা মনে করি, স্থানীয় প্রশাসনও দায়িত্ব উপেক্ষা করিতে পারে না। ভঙ্গুর পাহাড়ের পাদদেশ যে বসবাসের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ– তাহা কাহারও অজানা নহে। কিন্তু ইহাও সত্য, এহেন ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাসকারীরা প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে দরিদ্র ও অসহায়। প্রাণ হারানো গৃহকর্তারও বিকল্প বাসস্থান ছিল না। নিতান্ত নিয়তির উপর ভরসা করিয়াই যে তিনি সপরিবার প্রশাসনের সতর্কবার্তা সত্ত্বেও পাহাড়ের পাদদেশে থাকিয়া গিয়াছিলেন, তাহা বুঝিতে বিশেষজ্ঞ হইতে হয় না। আমরা মনে করি, এইখানেই স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতা নিহিত। একদিকে তাহারা বিপন্ন মানুষদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল গড়িয়া তুলিতে পারে নাই, অন্যদিকে অন্তত দুর্যোগকালেও এই সকল মানুষকে কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরের তাগিদ অনুভব করে নাই।
দেশে পাহাড়ধসের ঘটনাও নূতন নহে; বিশেষত টানা বৃষ্টিপাতে কয়েক দশক ধরিয়াই বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে কোনো না কোনো ধসের ঘটনা ঘটিয়াছে। সেই সকল ঘটনায় প্রাণহানিও কম ঘটে নাই। ২০২৪ সালের ১০ জুন সিলেটেই মেজরটিলা চামেলীবাগ এলাকায় টিলা ধসিয়া শিশুসহ একই পরিবারের তিনজন প্রাণ হারাইয়াছিলেন। ২০২২ সালের ৬ জুন জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার পূর্ব সাতজনি গ্রামে টিলা ধসিয়া একই পরিবারের চারজনের প্রাণহানি ঘটিয়াছিল। আগের দিন সংঘটিত কক্সবাজার সদর উপজেলা এবং উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৃথক পাহাড়ধসের ঘটনায় ছয়জনের মৃত্যুসংবাদ দিতে গিয়া গত বৎসরের ১৩ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানাইয়াছিল, ঐ দিন অবধি উক্ত বৎসরের বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসে এই এলাকায় রোহিঙ্গাসহ মোট ২৭ জনের প্রাণহানি ঘটিয়াছিল। এই সকল প্রাণঘাতী পাহাড়ধসের পরও অসহায় মানুষের সুরক্ষায় অগ্রগতি হইয়াছে, বলা যাইবে না।
আমরা দেখিতেছি, ২০১৭ সালের জুনের মধ্যভাগ অবধি চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও বান্দরবানে পাহাড়ধসে ১২৬ জনের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে ঐ বৎসরের ১২ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করিয়াছিল। সেই কমিটি পাহাড়ধসের ১৩টি কারণ চিহ্নিত করিয়াছিল, যেইগুলির আটটি ছিল মানবসৃষ্ট এবং পাঁচটি প্রাকৃতিক। মানবসৃষ্ট কারণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নির্বিচারে বন ও গাছপালা ধ্বংস, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটিয়া বসতি স্থাপন, সড়ক নির্মাণ, অন্যান্য উন্নয়নমূলক স্থাপনা নির্মাণে ইমারত বিধিমালা মান্য না করা ইত্যাদি।
বলা বাহুল্য, উক্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রধানত দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলবিষয়ক হইলেও উহা সিলেট অঞ্চলের জন্যও প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু ঐ প্রতিবেদনে সমাধান হিসাবে যেই সকল সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল, সেইগুলির কোনোটাই অদ্যাবধি আলোর মুখ দেখে নাই। আমাদের প্রত্যাশা, অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টা লইয়া কার্যকর কিছু করিবে। শুধু কমিটি করিয়া প্রাণ রক্ষা হইবে না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প হ ড়ধস র পর ব র এল ক য় ই সকল
এছাড়াও পড়ুন:
অনুগ্রহ করিয়া তৎপর হউন
বর্ষা মৌসুম যতই নিকটবর্তী হইতেছে ততই প্রাণঘাতী ডেঙ্গু বিস্তারের শঙ্কা বৃদ্ধি পাইতেছে। রবিবার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, মে মাসে এই বৎসরের সর্বোচ্চ আক্রান্ত দেড় সহস্রাধিক মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হইয়াছেন। ঋতুচক্রের নিয়ম অনুসারে বর্ষা আসিবার পূর্বে গ্রীষ্মেও বৃষ্টিপাত বিরল নহে। এইবার নিম্নচাপের কারণে ঢাকাসহ সমগ্র দেশেই বর্ষণ চলিতেছে। রহিয়াছে ভ্যাপসা গরমও। বিশেষজ্ঞগণের অভিমত, এইরূপ আবহাওয়া এডিস মশার বংশবৃদ্ধির জন্য খুবই অনুকূল। উপরন্তু ঈদুল আজহার দীর্ঘ বন্ধে বাসাবাড়ি তালাবদ্ধ করিয়া অনেকেই অন্যত্র অবস্থানকারী প্রিয়জনের সান্নিধ্যে যাইবেন বলিয়া নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের অভাবে সেইগুলিও ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার বংশবিস্তারের নিরাপদ ক্ষেত্র হইয়া উঠিতে পারে। ফলে ঈদের পর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করিবার আশঙ্কা প্রবল। কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশারের নেতৃত্বাধীন গবেষক দল ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা জরিপ করিয়া দেখিয়াছে, গত বৎসরের মে মাস অপেক্ষা এইবারের মে মাসে মশার ঘনত্ব যদ্রূপ অধিক, তদ্রূপ রোগীও অধিক। তাই তাহাদেরও আশঙ্কা, এই বৎসর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ঢাকায় তো বটেই, ঢাকার বাহিরের কিছু জেলায় পরিস্থিতির অবনতি হইতে পারে।
উদ্বেগটা হয়তো এই পর্যায়ে যাইত না যদি বিশেষত সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সময় থাকিতে তৎপর হইত। প্রতিবেদন বলিতেছে, ডেঙ্গু বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকিলেও অনেকাংশেই উপেক্ষিত সেই নির্দেশনা। ঢাকার কোনো হাসপাতালে পৃথক ডেঙ্গু ইউনিট স্থাপিত হয় নাই। অদ্যাবধি এডিস মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও বৃহদাকারে কর্মসূচি গ্রহণ করে নাই। চট্টগ্রাম ও অন্যান্য সিটি করপোরেশনও অনুরূপ ঔদাসীন্য প্রদর্শন করিতেছে। আর পৌরসভা বা অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানেরও নিদ্রাভঙ্গ হয় নাই। অথচ যেই পাড়া-মহল্লা পরিষ্কার রাখা ডেঙ্গুবিরোধী অভিযানের প্রধান অংশ, সেই দায়িত্ব মূলত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানেরই পালন করিবার কথা। সত্য, গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কায় অন্য সকল প্রতিষ্ঠানের ন্যায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলিও নানাবিধ অস্থিরতার শিকার। কিন্তু ৯ মাসেও সেই অস্থিরতা হইতে প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাহির করিতে না পারা শুভ লক্ষণ নহে। সর্বোপরি নগর দগ্ধ হইলে যদ্রূপ দেবালয় রক্ষা পায় না, তদ্রূপ ডেঙ্গু মহামারির রূপ লইলে কেবল সাধারণ মানুষই আক্রান্ত হইবে না।
অস্বীকার করা যাইবে না, পরিবর্তনের বিপুল প্রতিশ্রুতি লইয়া অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করিলেও প্রায় সর্বত্র এক প্রকার স্থবিরতা পরিলক্ষিত হইতেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হইতে কতদিন লাগিবে, তাহা অজ্ঞাত। তদুপরি মব সন্ত্রাস চলমান। বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটের সহিত উহা যুক্ত হইয়া ব্যবসায় কর্মকাণ্ডও গতি হারাইয়াছে। প্রতিদিন নানা পেশাজীবী গোষ্ঠী তাহাদের দাবিদাওয়া লইয়া রাজপথে উচ্চকণ্ঠ। ফলে যানজট পরিস্থিতি প্রকট হইতে প্রকটতর রূপ গ্রহণ করিতেছে। কিন্তু সরকারের যেন এই বিষয়ে কিছুই করণীয় নাই। সরকারের এহেন নিষ্ক্রিয়তা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমেও প্রতিফলিত হইলে নাগরিকগণ যাইবে কোথায়?
বিপদের বিষয়, এই নিশ্চয়তা নাই– কেহ একবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হইলে অবশিষ্ট জীবন সংক্রমণমুক্ত থাকিবে। উপরন্তু এডিস মশা উহার আচরণ পরিবর্তন করে বলিয়া পর্যবেক্ষণে নিশ্চিত হইয়াছেন বিশেষজ্ঞগণ। উদাহরণস্বরূপ, একদা বলা হইত, এডিস স্বচ্ছ পানিতে জন্মায় এবং সাধারণত রজনীকালে দংশনকার্যে অংশগ্রহণে অনীহ। কিন্তু এখন সকলেই পরিজ্ঞাত, এডিস অস্বচ্ছ পানিতেও জন্মায় এবং কোনো ব্যক্তিকে দংশনে উহার দিবা-রাত্রিভেদে অরুচি নাই। ফলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ পূর্বাপেক্ষা জটিল হইয়া পড়িয়াছে। যথাযথ আন্তরিকতা ও ব্যাপ্তি লইয়া কার্যক্রম পরিচালনা না করিলে ফল শূন্য হইতে বাধ্য। একই কারণে জনস্বাস্থ্যগত এই সমস্যা জনগণকে যুক্ত না করিয়া সফলভাবে মোকাবিলাও অসম্ভব। তাই সরকারের প্রতি আহ্বান, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অনুগ্রহ করিয়া দ্রুত তৎপর হউন, প্রস্তুতি লউন। সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকলকে সঙ্গে লইয়া উহা বাস্তবায়ন করুন।