ঈদুল আজহার ছুটির আমেজ কাটতে না কাটতেই দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। রাজধানী ঢাকায় এখনো ঈদের কিছুটা রেশ থাকলেও বরিশাল বিভাগে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২৮৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ২৬১ জনই বরিশাল বিভাগের। অর্থাৎ, দেশের মোট আক্রান্তের প্রায় ৯০ শতাংশই এখন এই একটি অঞ্চলে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং ভয়াবহ এক প্রবণতার ইঙ্গিত। ডেঙ্গু আর শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক নয়, বরং ছড়িয়ে পড়ছে মফস্বল ও গ্রামীণ এলাকায়-যেখানে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা অবকাঠামো, নেই সচেতনতা।
আরো পড়ুন:
বরিশাল বিভাগে চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু
বরগুনায় ডেঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টায় ৩ মৃত্যু
বরিশাল বিভাগের গ্রামাঞ্চল এখন হটস্পট
ডেঙ্গুর এই বিস্তার শুধু বরিশাল শহরেই নয়, বরং তার বাইরের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায় থেকেই রোগী আসছে বেশি। ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা। সব জেলাতেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে থাকা রোগী রুপা (২১)। গ্রামের বাড়ি বাকেরগঞ্জ। তার মা সালমা বেগম বলেন, “জ্বর হইছিল তিন দিন আগে। ভাবছিলাম সাধারণ জ্বর। দিন দিন খারাপ হইতেছিল। হাসপাতালে আইসা শুনলাম ডেঙ্গু।”
এই হাসপাতালেই প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছেন গড়ে ৭০ থেকে ৮০ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা.
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১১ জুন পর্যন্ত দেশে মোট ৫ হাজার ৩১৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৪ হাজার ৮৩২ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের।
গত বছর এই সময় আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকলেও বছর শেষে মারা যান ৫৭৫ জন। ২০২৩ সালে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭০৫ জন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গু বছর।
কেন বরিশালে ডেঙ্গু
বিশ্লেষকরা বলছেন, বরিশালে ডেঙ্গুর বিস্তার আকস্মিক নয়। কয়েকটি কারণ স্পষ্ট:
১. আবহাওয়াজনিত কারণ ও জলাবদ্ধতা।
বর্ষা এ বছর আগেভাগেই এসেছে বরিশালে। মে মাস থেকেই নিয়মিত বৃষ্টি হচ্ছে। এতে বহু এলাকায় জমে থাকা পানিতে জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা।
২. খোলা পানির আধার ও সামাজিক অভ্যাস:
বরিশালের গ্রামাঞ্চলে এখনও অনেক বাড়িতে খোলা ড্রাম, পানির ট্যাংক, ফুলের টব ইত্যাদি রাখা হয় যেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না।
৩. সচেতনতা ও মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাব:
ঢাকার মতো ওয়ার্ডভিত্তিক সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বরিশালে নেই। কীটনাশক ছিটানো, বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার, বা সিটি করপোরেশন পর্যায়ের উদ্যোগ এখানে অনুপস্থিত।
চিকিৎসা খাতের হিমশিম দশা
বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. রাফিউল ইসলাম বলেন, “আমাদের কিট প্রতিদিনই শেষ হয়ে যাচ্ছে। রোগীর ভিড় এত বেশি, কাউকে কাউকে অন্য হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে।”
বিভিন্ন উপজেলার হাসপাতালগুলোতে শয্যার চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেককে মেঝেতে কিংবা বারান্দায় রেখেই চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও স্যালাইন ঝোলানো হচ্ছে জানালার খাঁজে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ডা. আহাদুল কবির বলেন, “বরিশালের পরিস্থিতি আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। আমরা সেখানে অতিরিক্ত কিট পাঠিয়েছি। আইইডিসিআরের বিশেষজ্ঞ দলও সেখানে কাজ শুরু করেছে। শুধু চিকিৎসা নয়, মশা নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, “বরিশালের অভিজ্ঞতা বলছে, ডেঙ্গু এখন আর শহরের ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই। গ্রামে-গঞ্জে এটি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এখনই গ্রাম পর্যায়ে পানি জমা রোধ, কীটনাশক ছিটানো, ও সচেতনতামূলক প্রচার জোরদার না করলে সামনে বড় বিপদ আসবে।”
কিট নেই বহু এলাকায়
বরিশাল সদর উপজেলার এক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “আমাদের এলাকায় অনেকে এখনো জানেই না ডেঙ্গু কী। তারা সাধারণ জ্বর ভেবে চিকিৎসা নিতে দেরি করে, তখন অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এমনকি অনেক জায়গায় ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটও নেই। বরিশালের গ্রামীণ জনপদে ডেঙ্গুর বিস্তার দেখিয়ে দিয়েছে। শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক উদ্যোগে এই রোগ মোকাবিলা সম্ভব নয়।”
স্বাস্থ্য খাতের প্রস্তুতি, জনসচেতনতা, কীটনাশক কার্যক্রম সবকিছুই এখন চাই সারা দেশের, বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ের জন্য।
ঢাকা/এএএম/এসবি
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর বর শ ল ব ভ গ বর শ ল র এল ক য় পর য য় উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
বিহারের ভোটার তালিকা নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট: ‘মৃত’ নন জীবিত এমন ১৫ জনকে হাজির করলে ব্যবস্থা
বিহারে খসড়া ভোটার তালিকায় ‘মৃত’ চিহ্নিত ১৫ জন জীবিতকে হাজির করাতে পারলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ব্যবস্থা নেবেন। বিহারের ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে মামলাকারীদের আইনজীবীদের এ আশ্বাস দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি সূর্য কান্ত ও জয়মাল্য বাগচী এ আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। গণহারে ভোটার বাদ দেওয়া দেওয়া হলে তাঁরা অবশ্যই পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
আবেদনকারীদের উদ্দেশে দুই বিচারপতি বলেছেন, প্রক্রিয়ায় অনিয়ম বা ত্রুটি পাওয়া গেলে অবশ্যই তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন।
মামলাকারীদের আবেদন মেনে সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য খসড়া ভোটার তালিকা পেশ করার ওপর স্থগিতাদেশ দেননি। তবে ইসিকে তাঁরা বলেছেন, তাদের কাজ গণহারে ভোটার বাদ দেওয়া নয়। তাদের দেখা উচিত যাতে গণহারে ভোটারদের তালিকাভুক্ত করা যায়।
এসআইআর–প্রক্রিয়া অনুযায়ী ভোটার তালিকা সংশোধনের পর খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হবে ১ আগস্ট। সে লক্ষ্যেই ইসি এগিয়ে চলেছে। ইসি সূত্রে খবর, নিবিড় সংশোধনপ্রক্রিয়ার পর প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে ৬৫ লাখেরও বেশি নাম খসড়া তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে অন্তত ২২ জন ‘মৃত’, ৩৬ লাখ ‘নিখোঁজ’। এ ছাড়া বেশ কয়েক লাখ ভোটারের নাম বিভিন্ন এলাকার তালিকায় রয়েছে। অর্থাৎ একই ভোটার অন্তত দুই জায়গায় নথিভুক্ত। আগের তালিকা অনুযায়ী বিহারে মোট ভোটারের সংখ্যা ৭ কোটি ৮৯ লাখ। ইসির দাবি, এই তালিকায় বহু ভোটার ভুয়া। তাদের বাদ দিতেই এই নিবিড় সংশোধন।
যে প্রক্রিয়ায় এই খসড়া তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে, মামলাকারীদের আপত্তি তা নিয়েই। তাঁদের অভিযোগ, ইসি যেভাবে নাগরিকত্বের যাচাই করছে, সে জন্য যেসব নথি পেশ করতে বলা হচ্ছে, তা বহু ক্ষেত্রে সম্ভবপর নয়। তেমন করা তাদের কাজও নয়। সেই কাজ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তাঁদের অভিযোগ, এভাবে বহু দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের ভোটাধিকার ইসি কেড়ে নিচ্ছে।
গত সোমবার ও মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার শুনানি হয়। মঙ্গলবারের শুনানিতে মামলাকারীদের আইনজীবী কপিল সিব্বাল ও প্রশান্ত ভূষণকে আশ্বস্ত করে বিচারপতিরা বলেন, কমিশনের ত্রুটি–বিচ্যুতি দেখলে তাঁরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন। ভোটার প্রমাণে আধার কার্ড ও ভোটার কার্ডকে নথি হিসেবে গ্রাহ্য করার সুপারিশ বিচারপতিরা জোরের সঙ্গে করেছেন। এই দুই নথি জাল করা সহজ বলে ইসির দাবি নস্যাৎ করে বিচারপতিরা বলেছেন, যে ১১টি নথির ওপর নির্ভর করে তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেগুলোর প্রতিটিই জাল করা সম্ভব। কপিল সিব্বাল ও প্রশান্ত ভূষণকে বিচারপতিরা বলেন, খসড়া ভোটার তালিকায় ‘মৃত’ অথচ আসলে জীবিত, এমন ১৫ জনকে আপনারা হাজির করুন। আমরা ব্যবস্থা নেব।
আগামী ১২ ও ১৩ আগস্ট এই মামলার পরবর্তী শুনানি। তার আগে ৮ আগস্টের মধ্যে মামলাকারীদের বক্তব্য লিখিতভাবে আদালতে পেশ করতে হবে।