ইরান আক্রমণের মাস্টারমাইন্ড: হামাসের হামলার পর মোসাদকে নীরবে পাল্টে দিলেন যিনি
Published: 20th, June 2025 GMT
গত সপ্তাহে ইরান আক্রমণের জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নাটকীয় সিদ্ধান্তের নেপথ্যে ছিলেন দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র অবকাঠামো, সামরিক নেতৃত্ব, পরমাণুবিজ্ঞানীদের টার্গেট বা লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল।
সে দুজন ব্যক্তি হলেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদের পরিচালক ডেভিড বার্নিয়া এবং বিমানবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল তোমার বার।
ইসরায়েলের একজন সিনিয়র প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, ‘মোসাদের স্থলভাগের কার্যক্রম এবং বিমানবাহিনীর আকাশপথে হামলার নিখুঁত সমন্বয়ে এক মিলিমিটারও এদিক-সেদিক হয়নি। তারা একটি অবিশ্বাস্য পরিকল্পনা তৈরি করেছে এবং আমরা এখনও এর সবকিছু দেখিনি। সে পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে তা ড্রোন ও বিপারের অপারেশনকেও ম্লান করে দেবে ’
এবার মোসাদই ইরানে হামলার পরিকল্পনাটি তৈরি করে এবং সামরিক বাহিনী তা কার্যকর করার জন্য আগ্রহের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে ইরানে হামলার পক্ষে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাচি হানেগবি। তিনি নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফের প্রধান থেকে সহায়তা আদায় করে নেন ইরানে হামলার জন্য। দেশটির নিরাপত্তা পরিষদে হানেগবি নিজের পরিকল্পনাগুলো উপস্থাপন করেন এবং তা সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন পায়।
২০০৭ সাল থেকে গাবি আশকেনাজি, বেনি গানৎজ এবং গাদি আইজেনকোটসহ যারাই আইডিএফের প্রধান ছিলেন, সবাই ইরান আক্রমণের বিরোধিতা করেছিলেন। ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে পারমাণবিক চুক্তির পর ইরান হামলার ধারণাটিও বাতিল হয়ে যায়।
এবার দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে বার্নিয়া ও তার সহকর্মীরা গুপ্তচর নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিজেদের পরিকল্পনা সাজান। সেটির ভিত্তিতে একের পর এক অপারেশন চালায় মোসাদ। ২০২১ সালে মোসাদের প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর বার্নিয়া গোয়েন্দা সংস্থাটিতে ‘বায়োমেট্রিক বিপ্লব’ ঘটানোর দিকে মনোযোগ দেন। এর মধ্য দিয়ে সংস্থাটিকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে রূপান্তর করেছিলেন তিনি।
ইসরায়েলের একজন সিনিয়র প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, ‘বার্নিয়া মোসাদকে আমূলভাবে পরিবর্তন করেছেন। তিনি মোসাদের কাজের ধারা পাল্টে দিয়েছেন এবং স্মার্ট নজরদারি ক্যামেরা ও চেহারা শনাক্তকরণের মতো প্রযুক্তির ব্যবহার নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এটা তার জন্য সহজ ছিল না। মোসাদ এখনও একটি রক্ষণশীল সংস্থা এবং সেখানে পরিবর্তন আনতে বার্নিয়াকে অনেক অভ্যন্তরীণ লড়াই লড়তে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি জিতেছেন এবং আমরা ইরানে তার ফলাফল দেখতে পাচ্ছি।’
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বার্নিয়া একজন অসাধারণ অপারেটর। তিনি এমন এক ব্যক্তি যিনি মিডিয়ায় কোনো আলোচনায় থাকতে চান না। কোনো সাক্ষাৎকার দেওয়া বা মোসাদের অপারেশন সম্পর্কে কথা বলারও সুযোগ নেই তার পক্ষ থেকে। আবার বার্নিয়া অহংকারী ব্যক্তি নন। তিনি কোনো কিছুতে ভয় পান না, যাতে কেউ তাকে দুর্বল ভাবতে পারে।’
৬০ বছর বয়সী এই ব্যক্তি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যতিক্রমী সব অপারেশন চালিয়ে সাফল্যের রেকর্ড দেখিয়েছেন। এরপর তিনি ইরানে হামলার বিষয়ে পদক্ষেপ নেন। বিশেষ করে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস-নেতৃত্বাধীন আক্রমণ ও দক্ষিণ ইসরায়েলে হত্যাকাণ্ড এবং এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি ইরানে হামলার বিষয়ে ভাবতে থাকেন।
নেতানিয়াহুর মতো বার্নিয়াও বিশ্বাস করতেন ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা উচিত। বারাক ওবামার সময় যুক্তরাষ্ট্র সে চুক্তি করেছিল। বার্নিয়া নিশ্চিত ছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র সে চুক্তি থেকে সরে আসলে পরিস্থিতি তখন ইসরায়েলের অনুকূলে আসবে। যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালের মে মাসে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন ইরানিরা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে অগ্রসর হওয়া পুনরায় শুরু করে। এতে মূলত ইরানে হামলার একটা সুযোগ তৈরি হয়।
ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যে তার সমর্থিত অন্যান্য শক্তিগুলোর সঙ্গে সরাসরি এবং পরোক্ষ সংঘাতে বার্নিয়া সুনাম অর্জন করেন। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে মোসাদ ‘বিপার অপারেশন’ চালায়। যে অপারেশনে হিজবুল্লাহর সদস্যদের হাতে হাজার হাজার পেজার এবং শত শত ওয়াকিটকি বিস্ফোরিত হয়েছিল। এ অপারেশন বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে তেহরানে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যাকাণ্ডও বার্নিয়া এবং মোসাদের কৃতিত্ব। এরপর হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা এবং এখন ইরানিদের নিজস্ব মাটিতে একের পর এক সিনিয়র ইরানি সামরিক ব্যক্তিত্বের গুপ্তহত্যাগুলো করা সম্ভব হয়েছে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ও মোসাদের তথ্যের ওপর নির্ভর করে নির্ভুল বিমান হামলার মাধ্যমে।
এই সপ্তাহের শুরুতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল প্রকাশ করেছে যে বছরের পর বছর ধরে মোসাদ সুটকেস, ট্রাক এবং শিপিং কন্টেইনারের ভেতরে ড্রোন এবং গোলাবারুদ তৈরির উপাদান ইরানে পাচার করতে সক্ষম হয়েছিল। ইরানের ভেতরেই সরঞ্জামগুলো জোড়া লাগানো হয়েছিল। গত শুক্রবার সবুজ সংকেত না আসা পর্যন্ত সেসব অস্ত্র ও সরঞ্জাম লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। যখন ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানগুলো তেহরান, নাতানজ এবং অন্যান্য এলাকার দিকে উড়ে যাচ্ছিল, তখন ইরানের ভেতর থেকে ড্রোনগুলো সক্রিয় করা হয়। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানকে নিরাপদে পথ তৈরি করে দিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ড্রোনগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছিল।
ওই প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘বার্নিয়া বুঝেছিলেন যে এবার কোনো বিকল্প নেই, আমাদের ইরান আক্রমণ করতে হবে। আমরা সব সময় জানতাম যে ইরানিরা ভাবছে আমরা কোনো পদক্ষেপ নেব না। তারা মনে করেছিল, আমাদের সেই সক্ষমতা নেই। তারা দেখেছিল যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তিনি ইরানে হামলার বিষয়টি সমর্থন করেননি। ট্রাম্পও ইরানে হামলা করতে আগ্রহী ছিলেন না।’
কর্মকর্তা আরও যোগ করেন, ‘ইরানিরা ভেবেছিল তাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সব হুমকি অর্থহীন ছিল। তারা মনে করেছিল আসলে কিছুই হবে না এবং তারা তাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে থাকে। তারা আসলে সেই ভুলের ফল ভোগ করছে এখন। ইসরায়েল ইরানকে হতবাক করতে সক্ষম হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে নিজেদের যুক্ত করলে আমরা একসঙ্গে এগিয়ে যেতে পারব। সেই ক্ষেত্রে, ইরানের আর কোনো সুযোগ থাকবে না। তখন সম্ভবত আমরা বলতে পারব যে পারমাণবিক হুমকি দূর করার একটি বড় বিজয়ের মাধ্যমে আইডিএফ-মোসাদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে।’
সরকার যদি আরও এক বছর মেয়াদ না বাড়ায় বার্নিয়ার দায়িত্ব ২০২৬ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। যদি তিনি রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত করতে চান তাহলে অবসরের পর নিয়মানুযায়ী তাকে তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। এরপর একজন জনপ্রিয় প্রার্থী হওয়ার সুযোগ আছে তার। এমন রাজনৈতিক দল খুব কমই আছে যারা তাঁকে উচ্চ পদে, এমনকি দলীয় প্রধান হিসাবেও চাইবে না, যদিও এটি ঘটবে না। কারণ তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে, কিন্তু জাতীয় রাজনীতির শীর্ষে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা নেই।
মোসাদ প্রধানকে ভালোভাবে চেনেন এমন একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, ‘বার্নিয়া এমন ধরনের ব্যক্তি নন যিনি রাজনীতিতে শীর্ষ অবস্থানে যেতে মিডিয়ায় লড়াই করবেন বা রাজনৈতিক বিবাদে জড়াবেন। কখনও কখনও আপনাকে আপনার আজীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে নেতিবাচক কৌশল অবলম্বন করতে হয় কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসার মতো সেই স্বপ্ন নেই বার্নিয়ার।
শালোম ইয়েরুসালমি টাইমস অব ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিশ্লেষক
টাইমস অব ইসরায়েল থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: রাফসান গালিব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র কর মকর ত কর ছ ল র জন ত র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো সংগ্রামী বীরের মহাপ্রস্থান
সাতাশি বছর বয়সে আফ্রিকার বিশিষ্ট লেখক এবং নয়া-উপনিবেশবিরোধী চিন্তাবিদ নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো ২৮ মে পরলোকগমন করেছেন। পরিণত বয়সের এই মৃত্যুতে আক্ষেপের কিছু নেই। বরং সন্তুষ্টির কারণ রয়েছে যে একজন মানুষ হিসেবে তিনি পরিপূর্ণ একটি জীবন যাপন করে গেছেন। তিনি মূলত একজন লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হলেও কিন্তু নানা কর্মকাণ্ডে জীবনকে পরিপূর্ণ করে তুলেছিলেন।
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো প্রসঙ্গে প্রথম কথা সম্ভবত এই যে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। এ সূত্রে ২০১০ সালের ৭ অক্টোবর বৃহস্পতিবারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁর বাসার সামনে কয়েক ডজন সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে হাজির হয়েছেন। তারা জেনে গেছেন ওই বছর সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা যাদের খুব বেশি, নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো তাদের মধ্য অগ্রগণ্য। সুইডেনের নোবেল একাডেমির স্থায়ী সচিব পিটার এঙ্গলুন্ড বিকাল পৌনে ৫টায় সংবাদ সম্মেলনে সংক্ষিপ্তভাবে জানালেন যে মারিয়ো বার্গাস ইয়োসাকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। খবরটি শুনে নগুগি ঘর থেকে দরজা খুলে বের হয়ে এসে সাংবাদিকদের সান্ত্বনা দিতে দিতে বললেন, দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। নোবেল কমিটির মূল্যায়ন খারাপ না। বার্গাস ইয়োসা একজন ভালো লেখক; নোবেল পাওয়ার যোগ্য। অনেক অনেক বছর সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার প্রদানের জন্য নগুগির নাম সুপারিশ করা হয়েছে। লং লিস্ট করা হয়েছে। শর্ট লিস্ট করা হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে নোবেল কমিটি সব সময় তাঁর পরিবর্তে অন্য কাউকে বেছে নিয়েছে। লাতিন আমেরিকার সাহিত্য বিষয়ে উৎসাহ জাগ্রত হওয়ার আগেই আফ্রিকার সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের উৎসাহ উস্কে দিয়েছিল চিনুয়া আচেবে ও নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর উপন্যাস। তাদের সাহিত্য আমাদের নয়া-ঔপনিবেশিকতার আবির্ভাব সম্পর্কে ধীরে ধীরে সচেতন করে তুলেছিল।
আফ্রিকা থেকে অনেকে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন– যাদের মধ্যে রয়েছেন আলবেয়ার কাম্যু, নাডিন গর্ডিমার ও আবদুলরাজাক গুরনাহ। কেনিয়ার মানুষ নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর অনন্য হয়ে উঠেছিলেন তাঁর কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ ও বক্তৃতার মধ্য দিয়ে। ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৬৩ সালে কেনিয়া স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু এই স্বাধীনতা প্রকৃতই স্বাধীনতা কিনা তা বারংবার তার কথাসাহিত্যের মধ্য দিয়ে পরীক্ষা করেছেন নগুগি। যাদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, তাদের সঙ্গে রাষ্ট্র বিশ্বাসঘাতকতা করে– এই চিত্রটি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কথাসাহিত্য এমন এক ঘরানার যাকে বলা হয় ‘ফিকশনাল হিস্ট্রি’। কোনো কোনো উপন্যাসে রাষ্ট্র ও সরকারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমরা মূর্তিমান দেখতে পাই।
ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আফ্রিকার মুক্তির যে বয়ান গড়ে তোলা হয়েছে তা নগুগির উপন্যাস প্রবন্ধ এবং বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কেনিয়ার ঔপনিবেশিক ইতিহাস থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পরবর্তীকালের বিবিধ রূপ রাজনৈতিক দুর্নীতি ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। এমনকি ভাষাগত স্বাধীনতার পক্ষেও আন্দোলনের সূত্রপাত করেছেন। নিজের জন্মগত নাম জেমস নগুগি বদলে করেছেন। নতুন নাম নিয়েছেন নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো। ইংরেজিতে লেখা বন্ধ করে মাতৃভাষায় (গিকুয়ু ভাষায়) লিখতে শুরু করেছেন। তাঁর জনপ্রিয় বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘দ্য উইজার্ড অব দ্য ক্রো’, ‘পেটালস অব ব্লাড’ ও ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’। এ বইগুলিতে তিনি মাতৃভাষায় লেখা ও ভাষার স্বাধীনতা ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সরকারের কোপানলে পড়ে বহু বছর তাঁকে নির্বাসনে কাটাতে হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকে এক বছর কারাবন্দি ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হন।
তিনি ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন এবং পার্ক কিয়ং-নি সাহিত্য পুরস্কার জিতেছিলেন। উল্লেখযোগ্য, তাঁর ‘দ্য আপরাইট রেভল্যুশন’ গল্পটি ১০০-এরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর উপন্যাসগুলো কেনিয়া তথা আফ্রিকার সীমাহীন সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বিশ্বস্ত প্রতিরূপ।
তাঁর শারীরিক ও রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন কিন্তু কখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা থেকে পিছিয়ে আসেননি। তাঁর কথা– “প্রতিরোধই জীবিত থাকার সেরা উপায়।” তাঁর সাহিত্যিক অবদান আফ্রিকান ভাষার পুনরুত্থান, ন্যায়বিচার এবং রাজনৈতিক সাহস নিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তাঁর প্রথমদিকের উপন্যাস ‘উইপ নট, চাইল্ড’ ও ‘দ্য রিভার বিটুইন’ জেমস নগুগি নামে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে ১৯৬৭-তে প্রকাশিত ‘আ গ্রেন অব হুইট’-এ (একদানা গম) উপস্থাপিত ইতিহাস এবং কল্পকাহিনির মধ্যে সম্পর্ক নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করেছেন। একসময় রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে জীবনের অভিলক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। সাহিত্য তাঁর জন্য কেবল সামাজিক বাস্তবতা প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যম ছিল তা নয়, বরং তিনি সাহিত্যকে দেখেছেন ঐতিহাসিক সামাজিক শক্তি এবং চাপ দ্বারা নির্ধারিত একটি সৃজনশীল প্রক্রিয়া হিসেবে। যারা কেনিয়ার ইতিহাস রচনা করবেন তাদের জন্য নগুগির সাহিত্য একটি অন্যতম উপাদান। তাকে “রাজনৈতিক আন্দোলনের আলোচক, ভবিষ্যদ্বাণীকারী এবং দ্রষ্টা” হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
সাহিত্যের রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে নগুগির মতো অকপট লেখক আর কাউকে দেখা যায় না। ১৯৭৫ সালে নগুগি একটি সাক্ষাৎকারে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, সাহিত্যকে অবশ্যই আমাদের সমাজের সমস্ত শক্তি এবং দুর্বলতাগুলো স্বাধীনভাবে এবং সঠিকভাবে প্রতিফলিত করতে সক্ষম হতে হবে। তিনি বলতেন: এমন কোনো লেখক নেই যিনি অরাজনৈতিক। মূল কথা হলো: একজন লেখক তাঁর রচনায় কার রাজনীতিকে সমর্থন করেন? –তাঁর ব্যাপক সাহিত্যকর্মে স্বীয় সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি তাঁর অটল বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়ে আছে।
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর প্রয়াণে পৃথিবী এমন একজন লেখককে হারাল যিনি নিরাপসভাবে রাষ্ট্র ও মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ও বৈরিতার ব্যাপারে আমাদের অক্লান্তভাবে সচেতন করে গেছেন। তাঁর প্রতি জ্ঞাপন করছি অতল শ্রদ্ধা। v