ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় গুম-হত্যা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা
Published: 5th, July 2025 GMT
বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিম দেশের মানুষের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। মানুষের মৌলিক অধিকার ও বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সর্বোপরি জীবন ছিল কারাগারের মতো। এ সময়ে গুম, খুন, গণহত্যা, সীমাহীন দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার সবকিছুই ছিল নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনা।
শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘‘জুলাইয়ের লাল বিপ্লব বনাম সশস্ত্র বাহিনী ‘বিচারহীনতায় বরখাস্ত–বাধ্যতামূলক অবসর–পিএনজি’’’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। এ সভার আয়োজন করে নেক্সাস ডিফেন্স অ্যান্ড জাস্টিস (এনডিজে)।
সভায় বলা হয়, ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও অন্যায়-অবিচারের স্বীকার হয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ৫৭ জন দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা শহীদ হয়েছেন। গুম, খুন, জেল ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অনেক কর্মকর্তা। অসংখ্য কর্মকর্তাকে বরখাস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। এসব ঘটনার এখনও কোনো বিচার হয়নি।
সভায় কয়েকটি দাবি তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো-
১.
২. কর্মকর্তাদের অন্যায়ভাবে গুম, খুন, জুলুম, নিষ্ঠুর নির্যাতন এবং অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করার সঙ্গে যুক্ত এবং দায়ী সবাইকে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
৩. সশস্ত্র বাহিনীর কোনো সদস্যকে তার বাহিনীতে অবাঞ্চিত ঘোষণা করার সামরিক বা বেসামরিক কোনো আইন নেই। এমন নিয়ম পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে নেই। এমনকি দেশেরও অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নেই। শুধু রাজনৈতিক বা প্রতিহিংসা জনক কারণেই বিগত সময়ে অনেককে বেআইনিভাবে পিএনজি বা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। এটা একেবারেই অযৌক্তিক, অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা চাই এই নতুন বাংলাদেশে আর কাউকে যেন পিএনজি করা না হয়। একই সঙ্গে অতীতে করা সব পিএনজি তুলে নেওয়া হয়। এই অন্যায় কাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঠিক বিচার এবং ভুক্তভোগীদের সঠিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়।
৪. দেশের অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও কার্যকরী সশস্ত্র বাহিনীর কোনো বিকল্প নেই। আর তার জন্য দেশপ্রেমিক ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি স্বাধীন প্রতিরক্ষা কমিশনের দাবি আমরা অনেকদিন ধরে জানিয়ে আসছি। এই দাবিটাই আমরা পুনরায় উত্থাপন করছি।
৫. মেজর জিয়া একজন সৎ, দেশ প্রেমিক ও অত্যন্ত যোগ্য অফিসার, কিন্তু সেনাবাহিনীতে ক্যু করার নাটক সাজিয়ে তাকে দেশছাড়া করা হয়েছে। আমরা এর ন্যায়বিচারের মাধ্যমে মেজর জিয়ার যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন চাই।
বক্তারা আরও বলেন, জুলাই বিপ্লব আমাদের গর্ব এবং অহংকার। এই জুলাই মাসের লাল বিপ্লবের প্রথম দিনে জুলাই বিপ্লবের একজন সম্মুখ দেশপ্রেমিক অফিসারকে সেনানিবাসে বেআইনিভাবে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। একজন বয়স্ক অসুস্থ মানুষকে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই। এ ব্যাপারে সেমিনারে উপস্থিত সবার সর্বসম্মতিক্রমে ন্যায়বিচারের জন্য রিট করা হবে।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে রাখেন- নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হাসানুজ্জানান চৌধুরী। নেক্সাস ডিফেন্স অ্যান্ড জাস্টিসের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসিরের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন- প্রফেসর ভাজ হাশমী, সাংবাদিক ড. কনক সরওয়ার, কর্নেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান, শহীদুল ইসলাম, আলী আহসান জোনায়েদ, শরিফ ওসমান হাদি, আশরাফ উদ্দিন মাহানি প্রমুখ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সশস ত র ব হ ন কর মকর ত অন য য় র জন য প এনজ
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ