প্রথম আলো:

গণ–অভ্যুত্থানের পর অংশীজনদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে বলে অনেকে দাবি করছেন। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে এ ধারণাকে ব্যাখ্যা করছেন। এই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রায়োগিক সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক রূপ আসলে কেমন বলে আপনি মনে করেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: আমার কাছে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হলো, ক্ষমতার নতুন বিন্যাস। অর্থাৎ ক্ষমতার পুরোনো কেন্দ্র যেমন রাজনৈতিক দল, সংসদ, বিচার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্থানীয় সরকার, আমলাতন্ত্র, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, গণমাধ্যম—এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং একই সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালনে উপযোগী সক্ষমতা গড়ে তোলা।

একটা উদহারণ হতে পারে যে সংসদের ক্ষমতা ভেঙে এক কেন্দ্রের জায়গায় একাধিক কেন্দ্র স্থাপন করা, যাকে আমরা ‘বাই ক্যামেরাল’ সংসদের কথা বলছি; ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিবর্তনে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে কোনো নির্দিষ্ট বিনিয়োগকারীদের হাত থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা; পুলিশের বর্তমান কাঠামো ভেঙে একটি স্বাধীন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আনা—এগুলো হতে পারে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার প্রায়োগিক জায়গা।

একটি গণতান্ত্রিক অর্থনীতি, অর্থাৎ সবার জন্য প্রতিযোগিতার সমান সুযোগ আছে; স্বচ্ছ, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত, মালিক ও শ্রমিক-—উভয়ের অধিকার আছে, এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টি নতুন বন্দোবস্তের অংশ।

প্রথম আলো:

অভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা রেখেছিলাম যে তারা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজটি ভালোভাবে করতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হলো, অভ্যুত্থান–পরবর্তী যে ডিজঅর্ডার, তারা সেই জায়গা থেকে জোরালোভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর জন্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে উপদেষ্টামণ্ডলী বেছে নিয়েছেন, তাঁদের অনেকের যোগ্যতা বা দক্ষতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। আমরা দেখেছি, কোনো কোনো উপদেষ্টা কী বাজেভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।

আমি একটি উদাহরণ দিই। অন্তর্বর্তী আমলে অরাজনৈতিক ব্যক্তি বলে কিছু শিক্ষককে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁরা যেমন অরাজনৈতিক নন, তেমনি সেই পদগুলোর জন্য যোগ্যও নন। তাঁরা নির্দিষ্ট ‍দু-একটি দলের সমর্থক। সিভিল সার্ভিসেও ডিসিপ্লিন ফেরত আনতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার।
এরপরও কিছু জায়গায় সরকারের সাফল্যের কথা স্বীকার করতে হবে। যেমন অর্থনীতিতে একটা শৃঙ্খলা এসেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও খুব ধীরে হলেও কিছুটা স্বস্তি ও নিয়মকানুন ফিরছে। রাষ্ট্র সংস্কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো হাল ছেড়ে দেয়নি বলে মনে হচ্ছে।

প্রথম আলো:

আমরা দেখেছি, জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা প্রবল। পুরোনো ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফেরত না যাওয়ার ব্যাপারে সমাজে মোটাদাগের ঐকমত্য রয়েছে। কিন্তু সেই ঐকমত্যের প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তরে যে সংস্কারের কথাগুলো বলা হচ্ছে, সেগুলোর বিষয়ে আপনার মতামত কী?

কাজী মারুফুল ইসলাম: আসলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর রাতারাতি করা যায় না। কিন্তু আশার কথা হলো, আমাদের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা অনেক বেড়েছে। আমাদের ১১টি সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে যেসব সংস্কার প্রস্তাব করেছে, সেগুলোর সবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমি স্থানীয় সরকার কমিশনে কাজ করেছি। আমি দেখেছি, ১০ জন মানুষ কি অক্লান্ত পরিশ্রম করে সুপারিশগুলো তৈরি করেছেন। একই রকম অন্য কমিশনের ক্ষেত্রেও হয়েছে। এই সুপারিশগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

সুপারিশগুলো তো কমিশনের সদস্যরা এককভাবে তাঁদের মাথা থেকে বের করেননি, বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করে দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতা ও গবেষণার ভিত্তিতে দিয়েছেন। যেকোনো কমিশনের রিপোর্টে দেখা যাবে, সেখানে সমস্যা ও সমাধান চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সুপারিশের চার ভাগের একভাগও যদি বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে দেশের সার্বিক ব্যবস্থায় ও অবস্থায় বিরাট পরিবর্তন সম্ভব হতো।

তবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর কোনো সরলরৈখিক ব্যাপার নয়। এটা সব সময় এক দিকে এক গতিতে চলতে থাকবে, এমন নয়। এটা কখনো সামনে যেতে পারে, কখনো পেছনেও আসতে পারে। কিন্তু আশার ব্যাপার হলো, কিছু বিষয়ে জনগণের মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। সংস্কারের দাবিগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভবিষ্যতে এ দেশে রাজনীতি করা খুব সহজ হবে না।

প্রথম আলো:

বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর বাছাইকৃত একটি অংশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। আলোচনা প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই আলোচনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

কাজী মারুফুল ইসলাম: আমরা ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন দেখলাম। সেখানে যে ১৯টি মৌলিক সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেগুলো নিয়ে ভিন্নমত আছে। আমার ধারণা, আবার আলোচনায় বসলে সেগুলোতেও আরও একটু অগ্রগতি হবে বলে আশা করছি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় নিলে এই অগ্রগতি সামান্য নয়।

সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, সংকট হলো বাস্তবায়নে। আর বাস্তবায়নের জন্য যেহেতু আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল, তারা যদি নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষায় সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তারাও অচিরেই আস্তাকুঁড়ে চলে যাবে। তবে এটা তো বলতেই হবে, এই আলোচনার প্রক্রিয়াটারও একটা মূল্য আছে। এতগুলো দল প্রতিদিন একসঙ্গে বসছে, পরস্পরের যুক্তি শুনছে, নিজেদের পাল্টা যুক্তি-প্রস্তাব দিচ্ছে। আমি মনে করি, এগুলোও ইতিবাচকতার চিহ্ন।

কাজী মারুফুল ইসলাম.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম র ফ ল ইসল ম ক র প ন তর প রথম আল প রস ত ব ব যবস থ ঐকমত য র জন য ক ষমত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ সনদ প্রকাশ উচিত নয়

প্রথমত যে বিষয়টিতে আমি গুরুত্ব দিতে চাই, সেটি হলো ঐকমত্য কমিশন কিছু সংস্কার প্রস্তাব ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ (ভিন্নমত) গ্রহণ করছে। আমি এটি সমর্থন করি না। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (গত নভেম্বরে) বলেছিলেন, তাঁরা মূলত ফ্যাসিলিটেটরের (এগিয়ে নিতে সহায়তাকারী) ভূমিকা পালন করছেন। তাঁর ভাষায়, যতটুকু সংস্কারে সবাই একমত হবেন, ততটুকুই বাস্তবায়নের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হবে। তিনি সংখ্যার উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, যদি ১০০টি প্রস্তাব আসে, আর সব দলের সম্মতি মেলে মাত্র ১০টির ক্ষেত্রে, তাহলে কেবল সেই ১০টি বাস্তবায়নের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হবে, বাকিগুলো নয়।

আমি মনে করি, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো অন্তর্ভুক্ত করে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা উচিত নয়; বরং যেসব বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য রয়েছে, কেবল সেগুলো নিয়েই জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়া উচিত।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, বিএনপি যেসব প্রস্তাবের ব্যাপারে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়। ফলে ভবিষ্যতে তারা যদি ক্ষমতায় যায়, তাহলে সেসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নেই। কারণ, তারা আগেভাগেই আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছে। সুতরাং এই প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদ হওয়ার মানে, আমার কাছে মনে হয় সরকার কোনো একটি পক্ষকে খুশি করার কৌশল হিসেবে এই পদক্ষেপ নিয়েছে।

গণতন্ত্রে সংখ্যার কথা বলা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবও বিবেচনায় রাখা উচিত। শুধু বিএনপি নয়, জামায়াতে ইসলামী বা জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) যদি কোনো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়, তবে সেগুলো জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত না করাই শ্রেয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নোট অব ডিসেন্টসহ জুলাই সনদ প্রকাশ করা উচিত নয়।

যে উদ্দেশ্যে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, আমি সেটির সঙ্গে সহমত। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) উচ্চকক্ষ গঠনের যে ভাবনা, তাতে ভারসাম্য রক্ষার সুযোগ ছিল। আমি সেই প্রস্তাবের পক্ষে। তবে আমি নিম্নকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির ঘোরতর বিরোধী।

অবশ্য সবকিছু ছাপিয়ে ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রমে কিছু বিষয় আমাকে যথেষ্ট সন্তুষ্ট করেছে। প্রথমত, কমিশনের সদস্যদের উপস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অকল্পনীয় মাত্রায় খোলামেলা বিতর্ক হয়েছে। তাঁরা একসঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেশ পরিচালনার কাঠামো নিয়ে আলোচনা করেছেন, এটা বড় অগ্রগতি। দ্বিতীয়ত, বিএনপির অবস্থানও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তারা যেসব প্রস্তাব মানেনি, তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। সমালোচনা হবে জেনেও তারা যেটা করবে না, সে বিষয়ে কথা দেয়নি। বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি, সংবিধান ও কমিশনসংক্রান্ত কিছু বিষয়ে একমত হয়নি এবং তা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে। আমি এটিকে সৎ অবস্থান মনে করি। অতীতে কোনো প্রস্তাবে সম্মতি দিলেও পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় গিয়ে তা পালন না করার প্রবণতা দেখা গেছে।

এ ছাড়া বিচার বিভাগ সম্পূর্ণভাবে পৃথক্‌করণের বিষয়ে সব দল রাজি হয়েছে। এটা একটা অসাধারণ অর্জন। সরকারের সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত পৃথক সচিবালয় হবে, হাইকোর্টের বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে যাবে, নিম্ন আদালত উপজেলায় যাবে—এগুলোতে সবাই একমত হয়েছে, এগুলো অবিশ্বাস্য অর্জন।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়েও মোটামুটি সবাই একটি জায়গায় পৌঁছেছে। নির্বাচন কমিশন সরকারের হাত থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে ফেলার বিষয়ে রাজি হওয়া, কেউ ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে না পারার সিদ্ধান্ত—এগুলো খুবই মৌলিক সংস্কার। সব মিলিয়ে যতটুকু একমত হওয়া গেছে তা যথেষ্ট।

জাহেদ উর রহমান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে গতি আনতে চায় কমিশন
  • ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ সনদ প্রকাশ উচিত নয়
  • ঐকমত্য হয়েছে বেশ কিছু মৌলিক সংস্কারে
  • নারী আসন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ
  • নানা বাধার কারণে রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব হয়নি: আসিফ মাহমুদ
  • ৮% জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কীভাবে ঐক্য হয়, প্রশ্ন সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের
  • যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তা জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত হবে: আলী রীয়াজ
  • মৌলিক ১৯ সংস্কার বিষয়ে সিদ্ধান্ত, ৯টিতে ভিন্নমত
  • সংবিধানের চার মূলনীতি প্রশ্নে কমিশনের সভা বর্জন বাম দলগুলোর