রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র আর বেশিদিন টিকবে না
Published: 3rd, August 2025 GMT
প্রথম আলো:
গণ–অভ্যুত্থানের পর অংশীজনদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে বলে অনেকে দাবি করছেন। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে এ ধারণাকে ব্যাখ্যা করছেন। এই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রায়োগিক সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক রূপ আসলে কেমন বলে আপনি মনে করেন?
কাজী মারুফুল ইসলাম: আমার কাছে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হলো, ক্ষমতার নতুন বিন্যাস। অর্থাৎ ক্ষমতার পুরোনো কেন্দ্র যেমন রাজনৈতিক দল, সংসদ, বিচার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্থানীয় সরকার, আমলাতন্ত্র, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, গণমাধ্যম—এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং একই সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালনে উপযোগী সক্ষমতা গড়ে তোলা।
একটা উদহারণ হতে পারে যে সংসদের ক্ষমতা ভেঙে এক কেন্দ্রের জায়গায় একাধিক কেন্দ্র স্থাপন করা, যাকে আমরা ‘বাই ক্যামেরাল’ সংসদের কথা বলছি; ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিবর্তনে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে কোনো নির্দিষ্ট বিনিয়োগকারীদের হাত থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা; পুলিশের বর্তমান কাঠামো ভেঙে একটি স্বাধীন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আনা—এগুলো হতে পারে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার প্রায়োগিক জায়গা।
একটি গণতান্ত্রিক অর্থনীতি, অর্থাৎ সবার জন্য প্রতিযোগিতার সমান সুযোগ আছে; স্বচ্ছ, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত, মালিক ও শ্রমিক-—উভয়ের অধিকার আছে, এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টি নতুন বন্দোবস্তের অংশ।
প্রথম আলো:অভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কাজী মারুফুল ইসলাম: অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা রেখেছিলাম যে তারা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজটি ভালোভাবে করতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হলো, অভ্যুত্থান–পরবর্তী যে ডিজঅর্ডার, তারা সেই জায়গা থেকে জোরালোভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর জন্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে উপদেষ্টামণ্ডলী বেছে নিয়েছেন, তাঁদের অনেকের যোগ্যতা বা দক্ষতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। আমরা দেখেছি, কোনো কোনো উপদেষ্টা কী বাজেভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।
আমি একটি উদাহরণ দিই। অন্তর্বর্তী আমলে অরাজনৈতিক ব্যক্তি বলে কিছু শিক্ষককে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁরা যেমন অরাজনৈতিক নন, তেমনি সেই পদগুলোর জন্য যোগ্যও নন। তাঁরা নির্দিষ্ট দু-একটি দলের সমর্থক। সিভিল সার্ভিসেও ডিসিপ্লিন ফেরত আনতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার।
এরপরও কিছু জায়গায় সরকারের সাফল্যের কথা স্বীকার করতে হবে। যেমন অর্থনীতিতে একটা শৃঙ্খলা এসেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও খুব ধীরে হলেও কিছুটা স্বস্তি ও নিয়মকানুন ফিরছে। রাষ্ট্র সংস্কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো হাল ছেড়ে দেয়নি বলে মনে হচ্ছে।
আমরা দেখেছি, জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা প্রবল। পুরোনো ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফেরত না যাওয়ার ব্যাপারে সমাজে মোটাদাগের ঐকমত্য রয়েছে। কিন্তু সেই ঐকমত্যের প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তরে যে সংস্কারের কথাগুলো বলা হচ্ছে, সেগুলোর বিষয়ে আপনার মতামত কী?
কাজী মারুফুল ইসলাম: আসলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর রাতারাতি করা যায় না। কিন্তু আশার কথা হলো, আমাদের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা অনেক বেড়েছে। আমাদের ১১টি সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে যেসব সংস্কার প্রস্তাব করেছে, সেগুলোর সবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমি স্থানীয় সরকার কমিশনে কাজ করেছি। আমি দেখেছি, ১০ জন মানুষ কি অক্লান্ত পরিশ্রম করে সুপারিশগুলো তৈরি করেছেন। একই রকম অন্য কমিশনের ক্ষেত্রেও হয়েছে। এই সুপারিশগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
সুপারিশগুলো তো কমিশনের সদস্যরা এককভাবে তাঁদের মাথা থেকে বের করেননি, বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করে দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতা ও গবেষণার ভিত্তিতে দিয়েছেন। যেকোনো কমিশনের রিপোর্টে দেখা যাবে, সেখানে সমস্যা ও সমাধান চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সুপারিশের চার ভাগের একভাগও যদি বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে দেশের সার্বিক ব্যবস্থায় ও অবস্থায় বিরাট পরিবর্তন সম্ভব হতো।
তবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর কোনো সরলরৈখিক ব্যাপার নয়। এটা সব সময় এক দিকে এক গতিতে চলতে থাকবে, এমন নয়। এটা কখনো সামনে যেতে পারে, কখনো পেছনেও আসতে পারে। কিন্তু আশার ব্যাপার হলো, কিছু বিষয়ে জনগণের মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। সংস্কারের দাবিগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভবিষ্যতে এ দেশে রাজনীতি করা খুব সহজ হবে না।
প্রথম আলো:বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর বাছাইকৃত একটি অংশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। আলোচনা প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই আলোচনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
কাজী মারুফুল ইসলাম: আমরা ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন দেখলাম। সেখানে যে ১৯টি মৌলিক সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেগুলো নিয়ে ভিন্নমত আছে। আমার ধারণা, আবার আলোচনায় বসলে সেগুলোতেও আরও একটু অগ্রগতি হবে বলে আশা করছি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় নিলে এই অগ্রগতি সামান্য নয়।
সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, সংকট হলো বাস্তবায়নে। আর বাস্তবায়নের জন্য যেহেতু আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল, তারা যদি নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষায় সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তারাও অচিরেই আস্তাকুঁড়ে চলে যাবে। তবে এটা তো বলতেই হবে, এই আলোচনার প্রক্রিয়াটারও একটা মূল্য আছে। এতগুলো দল প্রতিদিন একসঙ্গে বসছে, পরস্পরের যুক্তি শুনছে, নিজেদের পাল্টা যুক্তি-প্রস্তাব দিচ্ছে। আমি মনে করি, এগুলোও ইতিবাচকতার চিহ্ন।
কাজী মারুফুল ইসলাম.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম র ফ ল ইসল ম ক র প ন তর প রথম আল প রস ত ব ব যবস থ ঐকমত য র জন য ক ষমত সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এখন দেশের ১৮ কোটি মানুষের দাবি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘এই সনদ নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জারি করা হোক এবং প্রয়োজনে গণভোটের আয়োজন করা হোক। তবে এই গণভোট অবশ্যই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই হতে হবে, নির্বাচনের পরে নয়।’
আজ বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে তৃতীয় ধাপে তৃতীয় দিনের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন রফিকুল ইসলাম খান। এ সময় উপস্থিত ছিলে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ।
জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ স্বাভাবিকভাবেই আবারও রাস্তায় নেমে আসবে বলে মন্তব্য করেন রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর সে সময়কার দলগুলোর ঐকমত্য থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতায় থাকা দলগুলো সেটি (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা) যথাসময়ে বাস্তবায়ন করেনি। পরে আন্দোলনের মাধ্যমেই তা সংবিধানে যুক্ত হয়।
জামায়াতের এই নেতা আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের মাধ্যমে। আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এ রায় দেওয়ানো হয়েছিল। তাই বিচার বিভাগকে আবার বিতর্কের মুখে না ফেলে সংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে জামায়াত।
জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ঐকমত্য কমিশন একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে চারটি বিকল্প নিয়ে কাজ করেছে, যার মধ্যে কমিশন সংবিধানিক আদেশের প্রস্তাবটি সমর্থন করেছে। এই আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের ২২টি আর্টিকেল বাস্তবায়িত হতে পারে। এটি আইনিভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি।
এক প্রশ্নের জবাবে হামিদুর রহমান বলেন, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করার এখতিয়ার সংসদের নেই, এবং এ ধরনের পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই গণভোটের প্রয়োজন হয়।
জামায়াতে ইসলামী জনগণের অভিপ্রায়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় উল্লেখ করে জামায়াতের এ সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন।
জুলাই সনদের যে আদর্শ ও চেতনা, তা বাস্তবায়ন হওয়া উচিত এবং যারা এই আদর্শের পথে হাঁটবে না, জনগণ তাদের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে করেন হামিদুর রহমান আযাদ। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ এটি প্রমাণ করে যে এ দেশের তরুণসমাজ ও জনগণ নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা চায় এবং জুলাই বিপ্লবের যোদ্ধাদের পক্ষেই রয়েছে।