সুদানের রাস্তায় শত শত মরদেহ, পালিয়েছে ৬০ হাজার বাসিন্দা
Published: 1st, November 2025 GMT
দারফুরের উত্তরাঞ্চলীয় শহর এল-ফাশের দখলের পর ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সুদান। রাস্তায় পড়ে আছে শত শত মরদেহ, ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে হাজারো মানুষ।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা জানিয়েছে, আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর দখলের পর সহিংসতা ও গণহারে হত্যার কারণে অন্তত ৬০ হাজার বাসিন্দা শহর ছেড়ে পালিয়েছে। খবর বিবিসির।
সুদান ডক্টরস নেটওয়ার্ক জানিয়েছে, শহরটি রবিবার দখলের পর থেকে আরএসএফ অন্তত ১,৫০০ জনকে হত্যা করেছে, যার মধ্যে অন্তত ৪৬০ জনকে একটি হাসপাতালে হত্যা করা হয়েছে।
আরএসএফ যোদ্ধারা শহরটি দখল করার পর গণহারে হত্যা, ধর্ষণ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, রাস্তায় শত শত মরদেহ পড়ে আছে, অনেককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। শহরটি গত ১৮ মাস ধরে আরএসএফ অবরোধ করে রেখেছিল, ফলে খাদ্য ও ওষুধের ঘাটতি ছিল ভয়াবহ।
ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র ইউজিন বায়ুন বলেন, “এল-ফাশের থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের বেশিরভাগ এখন পশ্চিমের তাউইলা শহরে আশ্রয় নিচ্ছে। শরণার্থীরা ভয়াবহ নৃশংসতার কথা জানিয়েছেন, যার মধ্যে ধর্ষণ, পরিবারের সদস্যদের হত্যা ও ঘরবাড়ি ধ্বংসের ঘটনা রয়েছে।”
তিনি বলেন, “প্রতিটি শিশুই অপুষ্টিতে ভুগছে, আমরা পর্যাপ্ত আশ্রয় ও খাবার দিতে পারছি না। ধারণা করা হচ্ছে, এখনো প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ শহরটিতে আটকা রয়েছে, যেখানে খাবার, পানি ও ওষুধ প্রায় শেষ।
দারফুর অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা ভেঙে পড়েছে, হাসপাতালগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। মানবিক সংস্থাগুলো বলছে, সাহায্য পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সুদানের সেনাবাহিনী (এসএএফ) ও আধাসামরিক বাহিনী আরএসএফের মধ্যে ক্ষমতা দখল নিয়ে সংঘাত শুরু হয়, যা পরিণত হয় পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত, এবং প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, এটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট।
এল-ফাশেরের পতনে সুদান কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। পশ্চিম সুদান ও দক্ষিণ কর্ডোফান এখন আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে, আর সেনাবাহিনী দখলে রেখেছে রাজধানী খার্তুমসহ মধ্য ও পূর্বাঞ্চল।
আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও আফ্রিকান ইউনিয়ন, তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি ও মানবিক করিডর খোলার আহ্বান জানিয়েছে, তবে এখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ না হলে সুদান রুয়ান্ডার মতো ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
ঢাকা/ইভা
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সুদান এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং শক্তিশালী আধা সামরিক গোষ্ঠী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে শুরু হওয়া তীব্র লড়াই থেকে এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এবং সেখানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগও ওঠে।
সম্প্রতি আরএসএফ এল-ফাশের শহরটি দখল করার পর এর বাসিন্দাদের নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত সারা দেশে দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন এবং প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। জাতিসংঘ এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকট বলে অভিহিত করেছে।
পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান ও সংঘাতের শুরু১৯৮৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই দফায় দফায় যে উত্তেজনা চলছিল, তার সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে বর্তমান গৃহযুদ্ধ।
বশিরের প্রায় তিন দশকের শাসনের অবসানের দাবিতে বিশাল জনবিক্ষোভ হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু দেশটির মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে একটি যৌথ সামরিক-বেসামরিক সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারটিকে উৎখাত করা হয়। এই অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও দেশটির কার্যত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং তাঁর ডেপুটি ও আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো।
এই দুই জেনারেল দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়া নিয়ে প্রস্তাবিত পদক্ষেপে একমত হতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয় ছিল প্রায় এক লাখ সদস্যের আরএসএফ-কে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা এবং নতুন এই যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে। ধারণা করা হয়, দুজন জেনারেলই তাঁদের ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।
আরএসএফ সদস্যদের দেশের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হলে সেনাবাহিনী বিষয়টিকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। সেই লড়াই দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করে এবং আরএসএফ খার্তুমের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নেয়। যদিও প্রায় দুই বছর পর সেনাবাহিনী খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।
জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান (বামে) এবং আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো (ডানে)