ধর্মীয় আবেগ পুঁজি করে স্থানীয় পর্যায়ে অপতথ্য ছড়ানো হয়: তথ্য উপদেষ্টা
Published: 4th, May 2025 GMT
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, বাংলাদেশের সমাজে যে ধর্মীয় আবেগ আছে, সেটাকে পুঁজি করে স্থানীয় পর্যায়ে অপতথ্য বেশি ছড়ানো হয়। এ বিষয়ে তথ্য কর্মকর্তাদের শক্ত ভূমিকা নিতে হবে। কারণ একটা অপতথ্য বা মিথ্যা খবর শুধু একজন ব্যক্তির ক্ষতি করে না, সমাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দেয়। তথ্য কর্মকর্তাদের এমন ভূমিকা নিতে হবে যেন সামাজিক অস্থিরতা এবং ধর্মীয় সহিংসতা বা হানাহানির ঘটনা না ঘটে।
রোববার বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের অডিটরিয়ামে আয়োজিত ‘ডিজিটাল ভেরিফিকেশন অ্যান্ড ফ্যাক্টচেকিং’–বিষয়ক প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশে যে গুজব–অপতথ্য আছে, সেটা শুধু ভারত থেকে আসে, এ রকম না। দেখা যাচ্ছে দেশেই অনেকে আছেন, যারা গত জুলাই–আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে না পেরে গুজব এবং অপতথ্য ছড়িয়ে যাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘এমনভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে যে মনে হচ্ছে, জুলাই–আগস্টে কিছু ঘটে নাই। অপপ্রচার এমন হচ্ছে যে, বরং উল্টো ঘটনা ঘটছে। মনে হচ্ছে ছাত্ররা পুলিশকে মেরে জোর করে ক্ষমতা দখল করছে।’
অনুষ্ঠানে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অপতথ্য এবং সাইবার ক্রাইমের শিকার হবে।’
তিনি বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের পর অপতথ্য ও গুজবের যে প্রচার হয়েছে, সেটা হয়েছে দেশের ভেতরের ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী ও দেশের বাইরের গোষ্ঠীগুলোর যৌথ প্রয়াসে।’
সভাপতির বক্তব্যে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘একদল লোক বসে আছে এই সরকারকে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য। সরকারের সংস্কার কার্যক্রমগুলো তাদের সহ্য হচ্ছে না। কারণ, তারা এত খারাপ কাজ করে গেছে যে কাজগুলোকে আড়াল করার জন্য এই সরকারকে সরাসরি তারা প্রতিপক্ষ মনে করছে।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্রধান তথ্য কর্মকর্তা নিজামূল কবীর, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মামুনুর রশীদ ভূঞা প্রমুখ।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
এপ্রিলে অনলাইনে ২৯৬টি ভুল তথ্য শনাক্ত করল রিউমর স্ক্যানার, ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি
গত এপ্রিল মাসে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ২৯৬টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার।
গতকাল বৃহস্পতিবার তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। এর আগের মাসে (মার্চ) ২৯৮টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছিল রিউমর স্ক্যানার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে এপ্রিলে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক থেকে গণনাকৃত সংখ্যার মধ্যে জাতীয় বিষয়ে সবচেয়ে বেশি (১০১) ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ মিলেছে, যা মোট ভুল তথ্যের ৩৪ শতাংশ। এ ছাড়া রাজনৈতিক বিষয়ে ৯৫টি, আন্তর্জাতিক বিষয়ে ৩৮টি, ধর্মীয় বিষয়ে ২৭টি, বিনোদন ও সাহিত্য বিষয়ে ৮টি, শিক্ষা বিষয়ে ৭টি, প্রতারণা বিষয়ে ১০টি, খেলাধুলা বিষয়ে ৯টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে এপ্রিলে।
রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মাসের এসব ঘটনায় তথ্যকেন্দ্রিক ভুল ছিল সবচেয়ে বেশি, ১৩৮টি, ভিডিওকেন্দ্রিক ভুল ছিল ১০৫টি ও ছবিকেন্দ্রিক ভুল ছিল ৫৩টি। শনাক্ত হওয়া ভুল তথ্যগুলোর মধ্যে মিথ্যা হিসেবে ১৭৯টি, বিভ্রান্তিকর হিসেবে ৬৬টি ও বিকৃত হিসেবে ৪৮টি ঘটনাকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া সার্কাজম বা কৌতুক হিসেবে হাস্যরসাত্মক ঘটনাকে বাস্তব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাক্টচেক করা হয়েছে তিনটি।
প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গত মাসে ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, সংখ্যার হিসাবে তা ২৭৬টি। এ ছাড়া ইউটিউবে ৫৪টি, ইনস্টাগ্রামে ৪৮টি, এক্সে (সাবেক টুইটার) ৪৪টি, টিকটকে ২৪টি, থ্রেডসে অন্তত ১৩টি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। ভুল তথ্য প্রচারের তালিকা থেকে বাদ যায়নি দেশের গণমাধ্যমও। ১৫টি ঘটনায় দেশের একাধিক গণমাধ্যমে ভুল তথ্য প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।
রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যম ও ভারত থেকে পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ভুয়া তথ্য প্রচারের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এপ্রিলেও এই ধারাবাহিকতা লক্ষ করেছে রিউমর স্ক্যানার। গত মাসে ভারতীয় গণমাধ্যমে দুটি ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়িয়ে অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও দুটি ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতীয় অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে ভুয়া তথ্যের প্রচার করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের বিষয়টি কিছু মাস ধরেই আলোচনায় রয়েছে। এপ্রিলে এমন ১৬টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে ছয়টি ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতীয় পরিচয়ধারী অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত মাসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়ে ১২টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। ভুল তথ্যগুলোর ধরন বুঝতে এগুলোকে রিউমর স্ক্যানার দুটি আলাদা ভাগে ভাগ করে। সরকারের পক্ষে যায়—এমন ভুল তথ্যের প্রচারকে ইতিবাচক এবং বিপক্ষে যায়—এমন অপতথ্যের প্রচারকে নেতিবাচক হিসেবে ধরে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, এসব অপতথ্যের প্রায় ৮৩ শতাংশ ক্ষেত্রেই সরকারকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়, এপ্রিলে ২৯টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে, যা চলতি বছরের মাসগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে প্রায় ৮৩ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাঁকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে জড়িয়ে তিনটি (সব কটি বিপক্ষে), আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াকে জড়িয়ে দুটি (৫০ শতাংশ বিপক্ষে), সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে জড়িয়ে দুটি (সব কটি বিপক্ষে), আ ফ ম খালিদ হোসেনকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে), শেখ বশিরউদ্দীনকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে) ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে) ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানারের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত মাসে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) জড়িয়ে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য (১৩টি) প্রচার করা হয়েছে। এসব অপতথ্যের সব কটিই দলটির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করার সুযোগ রেখেছে। এই সময়ে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে), ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে দুটি (৫০ শতাংশ বিপক্ষে) ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে ৯টি (সব কটিই বিপক্ষে) অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে। দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে জড়িয়ে এই সময়ে দুটি (সব কটিই বিপক্ষে) ও যুবদলকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদন বলছে, গত মাসে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে জড়িয়ে ছয়টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এসব অপতথ্যের সব কটিই দলটির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করার সুযোগ রেখেছে। নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) জড়িয়ে গত মাসে তিনটি অপতথ্য (সব কটিই বিপক্ষে) শনাক্ত করা হয়েছে। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে জড়িয়ে গত মাসে দুটি (সব কটিই বিপক্ষে) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এ ছাড়া দলটির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহকে জড়িয়ে তিনটি (সব কটিই বিপক্ষে), সারজিস আলমকে জড়িয়ে দুটি (সব কটিই বিপক্ষে), নুসরাত তাবাসসুমকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে) অপতথ্যের প্রচার শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
রিউমর স্ক্যানার এপ্রিলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে জড়িয়ে ৬টিসহ এই বাহিনীকে নিয়ে ১৬টি ভুল তথ্য প্রচার শনাক্ত করেছে। এ ছাড়া গত মাসে বাংলাদেশ পুলিশের বিষয়ে ছড়ানো ৯টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
ভুল তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার এই সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ১৯টি ভুয়া কনটেন্ট শনাক্ত করেছে। একই সময়ে ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করা হয়েছে তিনটি।
ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মসূচি দেওয়া হয়। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এপ্রিলে এ-সংক্রান্ত অন্তত ৩৮টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। অন্যদিকে গত মাসে কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১১টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় ২৬ এপ্রিল সুন্নি মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পাঁচটি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
গত মাসে গণমাধ্যমের নাম, লোগো ও শিরোনাম এবং নকল ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে ৫৮টি ঘটনায় দেশি-বিদেশি ২৫টি সংবাদমাধ্যমকে জড়িয়ে ৬২টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে বলে রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।