বাংলাদেশে উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি বারবার আলোচিত হলেও দলিত সম্প্রদায় আজও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। যুগের পর যুগ তারা পরিচ্ছন্নতা কর্ম, চর্মশিল্প, মৃতদেহ দাহ, নর্দমা ও বর্জ্য পরিষ্কারের মতো পেশায় নিয়োজিত থেকেছেন, কেউ বা যুক্ত রয়েছেন পৈতৃক জীবিকা নির্বাহের পেশায়। আমাদের সমাজ ও দেশের উন্নয়ন করতে হলে এ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন অসম্ভব। সময় এসেছে দলিত সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনার।
বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলনের (বিডিইআরএম) ২০২৩ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৫৫ লাখ দলিত মানুষ বসবাস করছে; যাদের অধিকাংশই কর্মসংস্থানে, বাসস্থানে, স্বাস্থ্যসেবায় ও শিক্ষায় ব্যাপকভাবে বৈষম্যের শিকার। এ জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৮০ শতাংশ দলিত পরিবার এখনও নিরক্ষর বা প্রাথমিক শিক্ষার নিচে অবস্থান করছে। স্বাস্থ্যসেবায় তাদের মধ্যে প্রায় ৬৭ শতাংশ বৈষম্যের মুখোমুখি হন এবং প্রায় ৭২ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ বাসস্থান বা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করেন। সরকারি চাকরিতে অংশগ্রহণের হার ১ শতাংশেরও নিচে, যা তাদের ক্ষমতায়নের পথে বড় বাধা।
বিশেষত দলিত নারীর অবস্থা আরও ভয়াবহ। উপরোক্ত জরিপে দেখা যায়, দলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশ নারী যৌন হয়রানি বা গার্হস্থ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ পরিসংখ্যান শুধু তাদের সামাজিক দুরবস্থাই নয়, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার ঘাটতিও তুলে ধরে।
যদিও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু বরাদ্দ রয়েছে; দলিতদের জন্য আলাদা করে বাজেট বরাদ্দ দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত হয়ে আসছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে দলিতদের জন্য পৃথক কোনো অর্থ নির্ধারিত হয়নি (অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রতিবেদন, ২০১৯)। ২০২০-২১ অর্থবছরে ‘উন্নয়ন সহায়তা’ খাতে দলিত, হিজড়া ও বেদে জনগোষ্ঠীর জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও দলিতদের জন্য আলাদা হিসাব উল্লেখ করা হয়নি (বাজেট বক্তৃতা ২০২০, পৃষ্ঠা ১৩৪)।
একমাত্র ব্যতিক্রম ২০২১-২২ অর্থবছরে দেখা যায়, ‘দলিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি’ নামে একটি প্রকল্পে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরবর্তী দুই অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৭ কোটি ও ৮ কোটি টাকা। এসব বরাদ্দ বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব ছিল; যা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০২৩ সালের জুন মাসের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়।
দলিতদের জন্য বাজেট বরাদ্দ শুধু অর্থনৈতিক সমর্থন নয়, এটি একটি বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থানের ইতিবাচক কার্যকর রূপ। জেন্ডার বাজেট যেমন নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নীতিগত স্বীকৃতি ও কর্মসূচির রূপরেখা নির্দেশ করে, তেমনি দলিত বাজেট সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীর সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের অধিকার নিশ্চিতের দিকটি নির্দেশ করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রায় ৩৫টিরও বেশি দলিত গোষ্ঠী রয়েছে। যেমন– জেলে, হরিজন, ডোম, রবিদাস, বাসফোর, বিন্ন, মালো, চুড়িহর, রাউত, সন্ন্যাসী, ধোপা, কায়পুত্র, রাজবংশী, পাটনি, ঋষি, ঢেলি, কাহার, গোপ, নট, কুমার, হরিজন ইত্যাদি। অধিকাংশই এখন সামাজিকভাবে অবহেলিত এবং উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে দূরে। তারা মূলত সেবামূলক পেশায় নিয়োজিত থাকলেও জাতীয় জনশুমারি বা সরকারি প্রণোদনা কর্মসূচিতে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত না হওয়ায় তাদের জন্য নির্দিষ্ট করা উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।
এ প্রেক্ষাপটে দলিত বাজেটের যৌক্তিকতা আরও জোরালোভাবে সামনে আসে। তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ করলে তা কেবল আর্থিক সহায়তা নয় বরং শিক্ষা-বৃত্তি, পেশাগত প্রশিক্ষণ, নিরাপদ আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সুরক্ষা, নারীর জন্য বিশেষ সহায়তা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সুযোগ তৈরি করবে। দলিত যুবদের জন্য প্রজননস্বাস্থ্য ও অধিকার খাতে পৃথক বরাদ্দ থাকলে, তারা সমাজে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
তবে বাজেট বরাদ্দের পাশাপাশি দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, স্বচ্ছ বাস্তবায়ন কাঠামো ও জবাবদিহিমূলক মনিটরিং ব্যবস্থা। দলিতদের জন্য আলাদা জনশুমারি, শিক্ষায় বরাদ্দ, ভূমিহীনদের জন্য খাসজমি বরাদ্দ, শ্রম অধিকার ও নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করতে হবে। বিশেষ করে বিধবা ও বৃদ্ধ দলিতদের জন্য রেশন কার্ড, বয়স্ক ভাতা ও আবাসন নিশ্চিত করা জরুরি। সর্বোপরি, দলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নকে সাধারণ প্রান্তিক গোষ্ঠীর ভেতর ঢেলে না দিয়ে তাদের জন্য পৃথক সেবা কাঠামো ও বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে সম্মানজনক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে হবে।
দলিত বাজেট মানে শুধু বরাদ্দ নয়, এটি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথ। সময় এসেছে, জেন্ডার ও জাতীয় বাজেটের মতো দলিত বাজেটকেও জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় স্থান দেওয়ার। তাদের জন্য সম্মানজনক জীবন নিশ্চিত করতে কেবল সুযোগ নয়, রাষ্ট্রের অঙ্গীকারই হতে হবে মূল ভিত্তি। v
শ্রুতিলিখন: ফারহানা আক্তার, উন্নয়নকর্মী
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব জ ট বর দ দ জনগ ষ ঠ র জ ত দ র জন য দল ত ব জ ট ত জনগ ষ ঠ বর দ দ র বর দ দ দ র জন য প
এছাড়াও পড়ুন:
৪ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম: ৭ অডিটর নিষিদ্ধ
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চারটি কোম্পানির সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও আইনের লঙ্ঘন থাকা সত্ত্বেও তা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপন না করায় সাত নিরীক্ষক (অডিটর) প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ বছরের জন্য অডিট এবং অ্যাসিউর্যান্স কার্যক্রমে অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
সেইসঙ্গে ওই নিরীক্ষা ফার্ম এবং নিরীক্ষকদের কেন অযোগ্য ঘোষণা করা হবে না, সেই মর্মে ব্যাখ্যা তলব করে তাদের শুনানিতে ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
আরো পড়ুন:
সোনালী পেপারের শেয়ার কারসাজি: ১১ কোটি ৮২ লাখ টাকা জরিমানা
পুঁজিবাজার উন্নয়নে ডিএসই ও ডিসিসিআইয়ের যৌথ সভা
গত মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সভাপতিত্বে ৯৭৩তম কমিশন সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৯ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক এ হক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস; রিংসাইন টেক্সটাইল লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক যথাক্রমে: আহমেদ অ্যান্ড আক্তার, মাহফেল হক অ্যান্ড কোং, আতা খান অ্যান্ড কোং এবং সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস; আমান কটন ফাইব্রাস লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০২০ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক ইসলাম কাজী শফিক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস এবং ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৮ ও ২০১৯ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক মাহফেল হক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস আর্থিক প্রতিবেদনে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন থাকা সত্ত্বেও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপন করেনি।
এ সকল নিরীক্ষা ফার্ম এবং নিরীক্ষককে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত সকল কোম্পানি, সকল ধরনের বিনিয়োগ স্কিম (যথা- মিউচ্যুয়াল ফান্ড, অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ও এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড) এবং পুঁজিবাজারে মধ্যস্থতাকারী সকল প্রতিষ্ঠানের অডিট ও অ্যাসিউর্যান্স কার্যক্রম পরিচালনার উপর নিষেধাজ্ঞা তথা পাঁচ বছরের জন্য অডিট ও অ্যাসিউর্যান্স কার্যক্রমে অংশগ্রহণে কেন অযোগ্য ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে ব্যাখ্যা তলব করে শুনানি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঢাকা/এনটি/বকুল