ইসলাম মানুষকে উত্তম চরিত্রের শিখরে পৌঁছানোর পথ দেখায়। মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে পাঠানো হয়েছে শুধু উত্তম চরিত্র পূর্ণমাত্রায় পৌঁছাতে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৮,৯৫২)
উত্তম চরিত্র গড়ে তুলতে ইসলাম কিছু মৌলিক গুণের ওপর জোর দেয়, যার মধ্যে হায়া অন্যতম। হায়া শুধু লজ্জা বা শালীনতা নয়, বরং এটি এমন একটি গুণ, যা মানুষকে অশোভন আচরণ থেকে বিরত রাখে। মহানবী (সা.
হায়া আরবি শব্দ হায়াত (জীবন) থেকে এসেছে, কারণ প্রাচীন আরবরা বিশ্বাস করত, হায়া ছাড়া মানুষের জীবন অসম্পূর্ণ। এটি লজ্জা, শালীনতা, সংযম ও সচেতনতার সমন্বয়, যা মানুষকে অনৈতিক কাজ থেকে দূরে রাখে।
ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘হায়া মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ, যা ছাড়া মানবতার কোনো অংশ থাকে না। এটি ছাড়া কেউ অতিথির সেবা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা বা পবিত্রতা বজায় রাখতে পারে না।’ (আল-মুকাদ্দিম, ফিকহুল হায়া, পৃ. ২৫)
আধুনিক যুগে লজ্জার ধারণা ব্যক্তিবাদের কারণে নেতিবাচক হয়ে উঠলেও মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সুস্থ লজ্জা আমাদের ভুল সংশোধনের জন্য একটি অভ্যন্তরীণ সতর্কতা হিসেবে কাজ করে।
কোরআনে হায়ার সূচনা দেখা যায় আদম ও হাওয়া (আ.)-এর ঘটনায়। নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর তাঁরা তাঁদের নগ্নতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে পাতা দিয়ে নিজেদের ঢেকেছিলেন (সুরা ত্ব-হা, আয়াত: ১২১)।
কেননা, হায়া প্রতিটি মানুষের ফিতরাতে (সৃষ্টিজাত স্বভাব) রয়েছে। ইসলাম হায়াকে ইমানের অংশ বলে আরও শক্তিশালী করেছে, যাতে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য ও তাঁর শাস্তির ভয়ে পাপ থেকে বিরত থাকে।
হায়া মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ, যা ছাড়া মানবতার কোনো অংশ থাকে না। এটি ছাড়া কেউ অতিথির সেবা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা বা পবিত্রতা বজায় রাখতে পারে না।ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.), আল-মুকাদ্দিম, ফিকহুল হায়া, পৃ. ২৫আরও পড়ুনশিক্ষাদানে মহানবীর (সা.) ১২ কৌশল১৩ মে ২০২৫কোরআন ও সুন্নাহতে হায়ামুসা (আ.) মাদিয়ানের কূপে দুই নারীকে সাহায্য করার পর প্রতিদান না চেয়ে ছায়ায় বিশ্রাম নিতে চলে যান, যা তাঁর শালীনতার প্রকাশ (সুরা কাসাস, আয়াত: ২৪)। একই সুরায় একজন নারী হায়ার সঙ্গে মুসা (আ.)-কে তাঁদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান, যা তার কণ্ঠ ও আচরণে প্রতিফলিত হয়। (সুরা কাসাস, আয়াত: ২৫)
নবীজি (সা.) হায়াকে ইমানের অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, ‘হায়া ও ইমান একসঙ্গে জোড়া; একটি উঠে গেলে অপরটিও চলে যায়।’ (মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস: ৫৮)
ইসলামি আইনে হায়ার সুরক্ষার জন্য বিশেষ বিধান রয়েছে। যেমন কাউকে লজ্জার চাপে তার অধিকার ছাড়তে বাধ্য করা নিষিদ্ধ। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মুসলিমের সম্পত্তি তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ছাড়া নেওয়া হারাম’ (সুনানে দারাকুতনি, হাদিস: ২,৮৮৫)। তিনি বলেছেন, ‘হায়া শুধু কল্যাণ বয়ে আনে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,১১৭)
ইসলামি আইনে হায়ার সুরক্ষার জন্য বিশেষ বিধান রয়েছে। যেমন কাউকে লজ্জার চাপে তার অধিকার ছাড়তে বাধ্য করা নিষিদ্ধ। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মুসলিমের সম্পত্তি তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ছাড়া নেওয়া হারাম।’নবী ও সাহাবিদের জীবনে হায়ানবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ হায়াসম্পন্ন ও উদার; যখন কেউ তাঁর কাছে হাত তোলে, তিনি তা খালি ফিরিয়ে দিতে লজ্জা বোধ করেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৫৫৬)
হায়া আল্লাহর মহত্ত্ব ও দয়ার প্রকাশ। তিনি পাপ গোপন রাখতে ভালোবাসেন, কিন্তু যারা নিজের পাপ প্রকাশ করে, তারা এই রক্ষাকবচ হারায়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,৭২১)
নবীদের জীবনে হায়া ছিল তাঁদের চরিত্রের প্রধান অলংকার। মুসা (আ.)-এর তীব্র হায়ার কারণে আল্লাহ তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ থেকে তাঁকে মুক্ত করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৭৮)
আমাদের নবীজি (সা.) ছিলেন এমন লজ্জাশীল, যখন তিনি কিছু অশোভন দেখতেন তাঁর চেহারায় অপছন্দের ভাব ফুটে উঠত। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,১০২)
মিরাজের রাতে অন্য নবীদের পরামর্শে বারবার নামাজের সংখ্যা কমানোর জন্য আল্লাহর কাছে যাওয়ার পরে, শেষে ৫ ওয়াক্তের পরে আর ফিরে যাননি, কারণ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি লজ্জায় পড়ে গেছি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭,৫১৭)
সাহাবিদের মধ্যে ওসমান (রা.)-এর হায়া এত বেশি ছিল যে ফেরেশতারাও তাঁর সম্মানে লজ্জা পেতেন (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৪০১)। ওমর (রা.)-এর কবরের পাশে যেতেও আয়েশা (রা.) হিজাব পরতেন হায়ার কারণে (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৫,৬৬০)।
ফাতিমা (রা.) মৃত্যুর পরও তাঁর শরীরের আকৃতি গোপন রাখতে বিশেষ কাফনের ব্যবস্থা করেছিলেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৩৯)।
প্রথম প্রজন্মের মুসলিমরা, যেমন ফুজায়েল ইবনে আয়াজ (রহ.), অন্ধকারেও আল্লাহর প্রতি হায়া পোষণ করতেন।
আরও পড়ুনইসলাম সম্পর্কে কীভাবে শিখবেন০৮ জুন ২০২৫মিরাজের রাতে অন্য নবীদের পরামর্শে বারবার নামাজের সংখ্যা কমানোর জন্য আল্লাহর কাছে যাওয়ার পরে, শেষে ৫ ওয়াক্তের পরে আর ফিরে যাননি, কারণ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি লজ্জায় পড়ে গেছি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭,৫১৭)হায়া গড়ে তোলার উপায়হায়া গড়ে তুলতে কয়েকটি পদক্ষেপ অত্যন্ত কার্যকর। প্রথমত, আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা হায়াকে জাগিয়ে তোলে। ইবনুল কাইয়্যিম বলেন (রহ.), ‘যে আল্লাহর গুণের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করে, সে তাঁর নৈকট্য লাভ করে।’ (আল-মুকাদ্দিম, ফিকহুল হায়া, পৃ. ১৫০)
দ্বিতীয়ত, হায়ার চর্চা, যেমন দৃষ্টি নত করা বা হিজাব পরা, এটিকে পুনরুজ্জীবিত করে। (সুরা আল-আ’রাফ, ৭:২৭)
তৃতীয়ত, আল্লাহর গুণাবলি, যেমন আর-রাকিব (পর্যবেক্ষক) বা আল-বাসির (সর্বদ্রষ্টা), সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন হায়াকে শক্তিশালী করে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘পাপ করার সময় তোমার ডানে-বাঁয়ে ফেরেশতাদের উপস্থিতি ভুলে যাওয়া পাপের চেয়েও বড়।’
চতুর্থত, আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামত স্মরণ করা হায়া জাগায়। আল-জুনায়দ বলেন, ‘হায়া হলো নিয়ামত দেখা এবং নিজের ত্রুটি উপলব্ধি করা।’ (আল-মুকাদ্দিম, ফিকহুল হায়া, পৃ. ১৭৫)
পঞ্চমত, নিয়মিত ইবাদত করা। যেমন নামাজ অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখে (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৪৫)। ষষ্ঠত, সৎসঙ্গ এবং সাহাবিদের জীবনী পড়া হায়াকে অনুপ্রাণিত করে।
সপ্তমত, সততা আত্মমর্যাদা ফিরিয়ে আনে, যা হায়ার ভিত্তি। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘সততা পুণ্যের দিকে নিয়ে যায়, আর পুণ্য জান্নাতে নিয়ে যায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,০৯৪)
হায়া ইসলামের প্রাণ। এটি শুধু লজ্জা নয়, বরং আল্লাহ ও মানুষের সামনে আমাদের আত্মমর্যাদা ও পবিত্রতার প্রতীক। এটি নবীদের উত্তরাধিকার এবং আল্লাহর প্রিয় গুণ।
সূত্র: ইয়াকিন ইনস্টিটিউট
আরও পড়ুনঘড়ির চাপে কি আমাদের ইবাদতের ক্ষতি হচ্ছে২২ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আল ম ক দ দ ম সহ হ ব খ র চর ত র র জন য আম দ র বল ছ ন আল ল হ র জ বন শ ল নত ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত দ্রুত ইসিকে জানান, সরকারকে সালাহউদ্দিন আহমদ
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে হওয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে আলোচনা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
সোমবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং কল্যাণ রাষ্ট্রের ভাবনায় বাজেট ২০২৫-২৬’ শীর্ষক আয়োজিত এক সেমিনারে আলোচনায় তিনি এই আহ্বান জানান। ‘নাগরিক ঐক্য’ এ সেমিনারের আয়োজন করে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে যেতে পারি, এই ব্যবস্থা এই সরকারকে নিতে হবে। সেই হিসেবে লন্ডনের আলোচনার সূত্র ধরে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বাস্তবায়নে যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সরকার যোগাযোগ করবে বলে আশা করছি। যাতে নির্বাচন কমিশন জনগণের সামনে বলতে পারে যে, তারা সরকারের কাছ থেকে একটা পরামর্শমূলক বা নির্দেশনামূলক বার্তা পেয়েছে।
বিএনপির এ নেতা বলেন, এই বাজেটে রাজস্ব খরচের পরিমাণ উন্নয়ন খরচের দ্বিগুণ। এই অবস্থায় এই উন্নয়ন বাজেট পরনির্ভরশীল হবে, ঋণ নিতে হয়। অর্থাৎ বাজেট বিদেশি ঋণ ও আর্থিক খাত নির্ভর হয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে নিজস্ব অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে বাজেট প্রণয়ন করা সম্ভব হবে না। এ সময় তিনি করমুক্ত আয় সীমা চার লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেন। একইসঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতায় দেওয়া বিভিন্ন ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, জ্বালানী ক্ষেত্রে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব খনিজ সম্পদ দেশীয়ভাবে আহরণে মনোযোগ দিতে হবে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকে এই সরকারের দায়মুক্তির বিষয়ে কোনো ধরনের আলোচনা হয়নি। সংবিধানের ধারা ১০৬ এবং সুপ্রিম কোর্টের একটা রুল অনুসারে এই সরকার গঠিত হয়েছে। সংবিধান যেহেতু এখনও বলবৎ, সেহেতু সাংবিধানিকভাবে এই সরকার চলছে। এই সরকারের বৈধতার জন্য একটা নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর মান্নার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, ভাসানী জনশক্তি পার্টির আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) স্থায়ী কমিটির সদস্য মোস্তাক হোসেন, গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান, নাগরিক ঐক্যের প্রেসিডিয়াম মেম্বার প্রেসিডিয়াম সদস্য মমিনুল ইসলাম প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার।