এ পর্যন্ত ১১৮ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
Published: 17th, June 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্র থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত ১১৮ বাংলাদেশি নাগরিককে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১১ পুরুষ ও সাতজন নারী। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির অধীনে তাদের ফেরত পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সর্বশেষ ঈদুল আজহার পরদিন ৮ জুন একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ৪২ বাংলাদেশি ফেরত এসেছেন। গতকাল পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন সূত্র থেকে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সোমবার ইমিগ্রেশন পুলিশের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব বাংলাদেশি নাগরিককে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করেছে সে দেশের কর্তৃপক্ষ। তাদের কাউকে হাতকড়া পরানো হয়নি। ফেরত পাঠানোর আগের বিভিন্ন স্তরের আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মানবিক আচরণের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়াও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা জানান, সর্বশেষ ৮ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে চার্টার্ড ফ্লাইটে ৪২ বাংলাদেশি নাগরিককে ফেরত পাঠানো হয়। ওই ফ্লাইটে নেপালের একই ধরনের কিছু যাত্রী ছিলেন। বাংলাদেশি ৪২ জনের মধ্যে ১৬ জনের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নিশ্চিত করার মতো কাগজপত্র ছিল না। ফলে তাদের গ্রহণ করা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে পরিচয় নিশ্চিতে কাজ করেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা। পরে তাদের গ্রহণ করে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অবৈধ অভিবাসীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো শুরু করে ট্রাম্প প্রশাসন। ভারত, ব্রাজিলসহ অনেক দেশের নাগরিকদের হাতকড়া পরিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেক মানবাধিকারকর্মী।
বাংলাদেশি যেসব নাগরিক ফেরত এসেছেন, তাদের পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তাদের একজন অভিবাসন-সংক্রান্ত মামলায় হেরে যাওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। একজন এসেছেন, যাঁর অন্য মামলায় সাজা হয়েছিল। তারা সবাই অবৈধ অভিবাসী হিসেবে শনাক্তের পর তাদের ফ্লাইটে তুলে দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত আসাদের মধ্যে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর বাসিন্দা ইমরান হোসেন সমকালকে জানান, টেক্সাস থেকে তাদের ফ্লাইটে তোলা হয়। একই ফ্লাইটে ফেরত আসেন সাব্বির আহমেদ ও সুমন নামে আরও দুই বাংলাদেশি।
গত বছরের ১১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন সুমন। এর জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে ৬৫ লাখ টাকা দালালকে দিতে হয়। প্রথমে কাতার হয়ে ব্রাজিল নেওয়া হয় তাঁকে। সেখান থেকে সাড়ে তিন মাসে বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, কোস্টারিকা, পানামা, হুন্ডুরাস, মেক্সিকোসহ আরও কয়েকটি দেশ পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় পৌঁছান তিনি। সেখানকার ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাঁকে আটক করে। এর পর নেওয়া হয় টেক্সাসে।
ইমরান হোসেন বলেন, ফ্লাইটে বাংলাদেশি কোনো নাগরিককে হাতকড়া পরানো হয়নি। শাহজালাল বিমানবন্দরে আসার পর বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক থেকে তাঁকে সহযোগিতা করা হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন সে দেশে অবৈধ অভিবাসী এবং ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদকারী বিদেশি শিক্ষার্থীদের পর্যায়ক্রমে নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ভারতীয় নাগরিকদের হাতকড়া পরিয়ে সামরিক বিমান বোঝাই করে পাঠানোর ঘটনা গণমাধ্যমে এলে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সমালোচনার মুখে পড়ে। সর্বশেষ ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে অভিবাসনবিরোধী অভিযান শুরু করলে সেখানে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং কয়েক দিনে তা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র য ক তর ষ ট র থ ক ফ ল ইট হ তকড়
এছাড়াও পড়ুন:
বান্দরবানে ৯ বছরে ২৬ পর্যটকের মৃত্যু
বান্দরবান ভ্রমণে এসে গত ৯ বছরে ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। সবশেষ গত বুধবার পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছেন তিন পর্যটক। অধিকাংশ পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে বর্ষা মৌসুমে ঝিরি-ঝরনা থেকে পড়ে; পাহাড়ি ঢলে ও নদীতে গোসলে নেমে। সড়ক দুর্ঘটনায়ও মারা গেছেন তিনজন। পাহাড় সম্পর্কে ধারণা না থাকা ও নিয়মকানুন মেনে না চলাই এসব মৃত্যুর কারণ বলে পুলিশ ও পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
পর্যটনশিল্প–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, জুন থেকে সেপ্টেম্বরে, অর্থাৎ ভরা বর্ষায় সবচেয়ে বেশি পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গত ৯ বছরে এই চার মাসেই পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভেসে গিয়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুকনা মৌসুমে নদী-খাল ও বগালেকে গোসলে নেমে ১০ জন এবং সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তিনজন। তাঁদের প্রায় সবাই কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী। প্রবল বৃষ্টি ও প্রতিকূল আবহাওয়ায় আটকে পড়ে স্থানীয়দের সহযোগিতায় বেঁচে ফিরেছেন অনেক পর্যটক। ২০১৯ সালের আগস্টে থানচি উপজেলার দুর্গম জিন্নাহপাড়ায় ১৬ জন তরুণ-তরুণী প্রায় এক সপ্তাহ আটকে পড়েছিলেন। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় তাঁরা ফিরে আসেন।
সবচেয়ে বেশি ১০ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে রুমা উপজেলায়। উপজেলাভিত্তিক প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ২৯ জুন পাইন্দু ইউনিয়নের তিনের সাইথার ঝরনায় পাহাড়ি ঢলে নৌবাহিনীর সাব লেফটেন্যান্ট সাইফুল্লাহ ও একজন কলেজছাত্রী ভেসে যান। দুই দিন পর তাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ওই একই ঝরনায় মারা যান আরেকজন পর্যটক। ২০১৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রিজুক ঝরনায় ডুবে বগুড়া আজিজুল হক কলেজের একজন অধ্যাপকের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালে বগালেকে ও ২০১৮ সালে সাঙ্গু নদে গোসলে নেমে চারজনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া গত ২০ জানুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় রুমায় কেওক্রাডং পাহাড়ে একটি নারী পর্যটক দলের দুজন ও থানচিতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালে একজন ও ২০১৮ সালে একজনের মৃত্যু হয়েছে নাফাখুমের পাহাড়ি ঢলে।
শুষ্ক মৌসুমে পাহাড় নিরীহ। কিন্তু বর্ষাকালে পদে পদে বিপদ। বান্দরবানের ৮০ শতাংশের বেশি পাহাড় খাড়া প্রকৃতির। বৃষ্টিতে ধস নামার আশঙ্কা যেমন থাকে, তেমনি ঝিরি–ঝরনা পাহাড়ি ঢলে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। বৃষ্টি কমে গেলে আধঘণ্টার কম সময়ে আবার শান্ত হয়ে যায়।মাহবুবুল ইসলাম, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট২০২৩ সালে ১২ আগস্ট আলীকদমে মারা যান আতাহার ইসলাম নামের একজন। তিনি ট্যুর এক্সপার্ট নামে পর্যটন দল পরিচালনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর সংস্থাটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন তাঁর স্ত্রী বর্ষা ইসলাম। গত সপ্তাহে ওই সংস্থার ব্যবস্থাপনায় ক্রিস্টং ও রংরাং পাহাড় ভ্রমণে যাওয়া তিন পর্যটক পাহাড়ি ঢলে ভেসে গিয়ে মারা যান। এ ঘটনায় বর্ষা ইসলামকে গ্রেপ্তার করলেও তিনি এখন জামিনে রয়েছেন। গত সপ্তাহে রোয়াংছড়িতে চারজন ও বান্দরবান সদর উপজেলায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। একজনের লাশ এখনো পাওয়া যায়নি।
রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সোহরাওয়ার্দী বলেন, সমতল থেকে আসা পর্যটকদের পাহাড়ি পরিবেশ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। অনেক পর্যটক পর্যটন-সম্পর্কিত স্থানীয় প্রশাসনের দেওয়া নিরাপত্তা নিয়মকানুন মেনে চলেন না। আবার ক্ষেত্রবিশেষে ট্যুরিস্ট গাইডদের দায়িত্বের অবহেলা যেমন রয়েছে, তেমনি পর্যটকেরাও গাইডদের কথায় চলতে চান না। এসব কারণে বর্ষায় ঝিরি-ঝরনায় পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ও নদী-খালে নেমে দুর্ঘটনায় পর্যটকের মৃত্যু হচ্ছে।
পাহাড়ে পর্যটক অপহরণ, ছিনতাই, যৌন সহিংসতার ঘটনা খুব একটা ঘটে না বলে অভিমত পুলিশ কর্মকর্তাদের। পুলিশ জানায়, গত ৯ বছরে জেলা শহরের দুটি, রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচিতে তিনটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। আবাসিক হোটেলে সঙ্গী পর্যটক কর্তৃক নারীর ওপর সহিংসতা হয়েছে দুটি। সহিংসতার শিকার এক তরুণীর মৃত্যু হয়েছে।
আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মুমিন জানিয়েছেন, উপজেলা সদরে পর্যটনসেবাকেন্দ্র রয়েছে। সেখানে প্রত্যেক পর্যটকের নাম, ঠিকানা, কোন সময়ে কোথায় যাবেন, থাকবেন ও কোন ট্যুরিস্ট গাইডের সঙ্গে যাবেন—সবকিছু লিপিবদ্ধ থাকে। প্রতি ১০ জনের দলে ১ জন নিবন্ধিত ট্যুরিস্ট গাইড নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। প্রশাসনের এ নিয়ম মেনে চললে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু কিছু সংস্থা বেশি লাভের জন্য নিয়মকানুন না মেনে গোপনে পর্যটকদের দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে যান। তাঁদের সঙ্গে কোনো ট্যুরিস্ট গাইড থাকেন না। দুর্ঘটনার প্রবণতা কমাতে হলে নিয়মের মধ্যে ভ্রমণ করতে হবে।
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়, পাহাড়ি ভূমি ও জলধারা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে পাহাড় নিরীহ। কিন্তু বর্ষাকালে পদে পদে বিপদ। বান্দরবানের ৮০ শতাংশের বেশি পাহাড় খাড়া প্রকৃতির। বৃষ্টিতে ধস নামার আশঙ্কা যেমন থাকে, তেমনি ঝিরি–ঝরনা পাহাড়ি ঢলে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। বৃষ্টি কমে গেলে আধঘণ্টার কম সময়ে আবার শান্ত হয়ে যায়।’ মাহবুবুল ইসলাম আরও বলেন, পাহাড়িরা বৃষ্টিতে বাড়ি থেকে সহজে বের হন না। সন্ধ্যার পর চলাফেরা করেন না। বর্ষায় পাহাড়ে দিনের চেয়ে রাতে চলাচলে ঝুঁকি বেশি। পাহাড়ধস ও পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে সাপ ও অন্য প্রাণীর ভয় আছে। চলাচলের সময় বৃষ্টি হলে সতর্ক থাকতে হবে। প্রয়োজনে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিরাপদ জায়গায় অপেক্ষা করতে হবে। শুকনা মৌসুমেও পাহাড়ি নদী ও খালে গোসলে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। অদৃশ্য স্রোত থাকায় খুব সহজে গভীরে টেনে নিয়ে যায়। সাঁতার না জানলে ডুবে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। পাশে নৌকা ও দক্ষ সাঁতারু না থাকলে ডুবন্ত কাউকে উদ্ধার করাও কঠিন।