রাত তিনটা পেরিয়ে গেছে। ঢাকার ঘুমন্ত শহর যেন জেগে উঠেছে এক ঝলক আলো আর হাততালির শব্দে। হাতিরঝিলের এম্ফিথিয়েটার মঞ্চে তখন ধীরে ধীরে উঠে আসছেন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়েরা। ক্লান্ত মুখ কিন্তু তাতে দমে যাওয়ার লক্ষণ নেই। চোখে সাহস, ঠোঁটে হাসি। যেন অজান্তেই বলছেন, ‘আমরা ফিরেছি, বিজয় নিয়ে। তবে এখনও পথ বাকি।’

গতরাত দেড়টায় মিয়ানমার জয় করে ফিরেছেন তাঁরা। প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের টিকিট কেটে তাঁদের এই ফেরাটা হলো বীরের মতো। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি আনা হয়েছে হাতিরঝিলে। গভীর রাতেও হাজার খানেক দর্শক অপেক্ষায় ছিলেন তাঁদের জন্য, মুখে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ ধ্বনি নিয়ে। একে একে মঞ্চে ডাক হয় রুপণা চাকমা, শিউলি, শামসুন্নাহার, আফঈদা, তহুরা, কোহাতি, মনিকা, মারিয়া, ঋতু ও অন্যদের। বাফুফের সদস্যরা তাঁদের বরণ করেন ফুলের তোড়ায়। মেয়েরা মঞ্চে বসেন যেন মাথায় গর্বের অদৃশ্য মুকুট পরে।

মেয়েদের ছবি দিয়ে বানানো বড় বড় বিলবোর্ড, ব্যানারে সাজানো অনুষ্ঠানস্থলকে বর্নিল করতে চেষ্টার কসুর করেনি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। ডিজিটাল যুগে যাবতীয় ডিজিটাল রংই থাকল পুরোটা জুড়ে। বড় পর্দায় দেখানো হয়েছে মিয়ানমার-কীর্তির খন্ড ছবিগুলো। কখনো ঋতুপর্ণার গোল, কখনো রুপণার সেভ.

..। কিন্তু চোখে লাগার মতো ছিল পুরস্কারের অভাব। কোনো প্রতীকী চেক, অর্থ পুরস্কার এমনকি একটি ঘোষণাও এল না। যেন আলো আর অভিনন্দন জানানোর সঙ্গে অনুষ্ঠানের চাকচিক্যই হয়ে উঠেছিল স্বীকৃতির প্রতীক।

ঝলমলে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল বক্তব্য শুরু করলে নড়চড়ে বসেছেন অনেকে। কোনো ঘোষণা কী তিনি দেবেন! কিন্তু সেই পথে হাঁটেননি তাবিথ। মেয়েদের প্রশংসাই করে গেছেন নিজের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে, ‘আপনারা দুটি কাজ করেছেন। নতুন করে ইতিহাস লিখছেন। এবং আমাদের সমাজের মন মানসিকতা বদলানোর যাত্রায় এগিয়ে নিচ্ছেন।’ কিন্তু বাফুফে সভাপতির কাছ থেকে নগদ কিছু চাইছিল দর্শকেরাও। সেই প্রত্যাশা মেটেনি তাবিথ এভাবে বক্তব্য শেষ করায়, ‘ যেভাবে আমরা নারী দলের পেছনে ছিলাম আগামীতেও থাকব। আমরা আপনাদের ওপর আস্থা রাখছি। এবং প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনাদের পেছনে আমরা আছি।’

বললেন ২০২৬ এশিয়া কাপ, যেটি বিশ্বকাপ বাছাই পর্বও, তা নিয়ে স্বপ্নের কথা। এখন শুধু ‘মিশন অস্ট্রেলিয়া ’ বলে শেষ করেন তাবিথ। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ করতে শক্ত কাঠামো লাগে। লিগ আয়োজনসহ সঠিক পরিকল্পনা দরকার। সেসব অনুচ্চারিতই রয়ে গেল বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসেই অভিনব এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে । পৃথিবীতে আর কোনো ক্রীড়া দল এভাবে মধ্যরাতে সংবর্ধনা পেয়েছ কি না সেটাও বিরাট গবেষণার বিষয়।

মঞ্চ আর গ্যালারি পানির ওপর। সে এক অনন্য পরিবেশ। তবে রাত গভীর হওয়ায় তিন পাশে গ্যালারির মাত্র এক তৃতীয়াংশ ভরেছে দর্শকে। তাঁদের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলেন ঋতুপর্ণা, যাঁর জোড়া গোলে মিয়ানমারকে হারিয়ে ইতিহাস লিখেছে বাংলাদেশ। মাঠে চেনালেন নিজের জাত, চিনিয়েছেন মঞ্চেও। দৃপ্ত বার্তায় ঋতুপর্ণা বলেন , ‘আজকের যে পর্যায়ে এসেছি আমরা এটা একটা টিম ওয়ার্ক। ফুটবল কোনো ব্যক্তিগত খেলা নয়। বাংলাদেশের মেয়েরা জানে কীভাবে কঠিন পরিস্থিতিতে লড়াই করতে হয়। আপনারা অমাদের ওপর বিশ্বাস রাখবেন। আমরা আপনাদের নিরাশ করব না। আমরা শুধু এশিয়া না, বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যেতে চাই।’

ঋতুর এই আত্মবিশ্বাস ছুঁয়ে গেল প্রধান অতিথি সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে, যিনি বললেন, যাঁর কাছে এই মুহুর্তে দেশের সেরা অ্যাথলেট রাঙামাটির মেয়ে। ঋতুকে লক্ষ্য করে প্রকাশ করেন নিজের উচ্ছাসও, ‘আপনি একটি কথা বলেছেন, আপনারা আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখবেন বাংলাদেশের মেয়েরা জানে কীভাবে প্রতিকুল পরিস্থিতিতে দৌড়াতে হয়, এটা দারুণ কথা। বাংলাদেশ আপনার জন্য গর্বিত।’

কোচ পিটার বাটলার শুরুতেই বাংলায় ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে মন জিতলেন সবার। মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে পরিশ্রম কতটা হয়েছে তা তুলে ধরেছেন। প্রশংসাও করেছেন তাঁদের ‘এই জয় সম্ভব হতো না যদি মেয়েরা নিজেদের শেষ বিন্দুও ঢেলে না দিত।’ উপস্থিত জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হকের কণ্ঠেও ঝরে মেয়েদের দরাজ প্রশংসা। সঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি, আরও পেশাদার পরিকল্পনায় মেয়েদের গড়ে তোলা দরকার।

কিন্তু এই অভ্যর্থনা শেষে একটা প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছিল। শুধু ফুলের তোড়া আর সভাপতির বক্তব্য অনুযায়ী ‘আপনাদের পেছনে আছি’ কথাই কী যথেষ্ট? গত বছর সাফ জয়ের পর মেয়েদের দেড় কোটি টাকা বোনাস দেবে বলেছিল বাফুফে, কিন্তু নয় মাস পেরোলেও এখনো কানাকাড়িও খেলোয়াড়েরা পাননি। এবার তাই হয়তো কোনো ঘোষণাই এল না।

এই মেয়েরা যারা আজকের গর্ব, তাঁদের জন্য ঘরোয়া লিগ নেই। নেই প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ বা কোনো টুর্নামেন্ট। গত বছর মে মাসে শেষবার লিগ হয়েছিল, তারপর একটাও আয়োজন হয়নি। অথচ মেয়েরা দক্ষিণ এশিয়ার পেরিয়ে এশিয়ায় পৌঁছার দরজা খুলেছেন। নতুন পথও দেখিয়েছেন। পথটা মজবুত করার বড় দায়িত্ব এখন বাফুফের।

তবু এই রাত মনে থাকবে। এই রাত শুধু ক্লান্তি নয়,মেয়েদের কাছে আত্মসম্মান আর অঙ্গীকারেরও। রুপণা, ঋতু, আফঈদারা জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশ শুধু ‘বন্যার দেশ’ নয় এখন আর। এটা ‘ফুটবলের দেশ’ও। আর তাঁদের পাশে দাঁড়ানো এখন শুধু উৎসবের দায়িত্ব নয়, প্রয়োজনীয় সমর্থন দেওয়া সময়ের দাবিও।

অনুষ্ঠান শেষেই ঋতু আর মনিকা আবার রওনা দিলেন বিমানবন্দরের পথে। ভুটানে লিগ খেলতে হবে। এটাই তাঁদের বাস্তবতা। বিজয়ের উৎসব শেষে আবার লড়াই। কারণ, এই মেয়েরা জানেন কীভাবে চলতে হয়। আলো খুঁজে নিতে হয় নিজেদের মতো করে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন আপন দ র আপন র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

উজানে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মারাত্মক সংকটে তিস্তা নদী

আন্তর্জাতিক নিয়ম না মেনে উজানে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে তিস্তা নদী মারাত্মক সংকটে পড়েছে। আর প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প নিয়েও কেউ খোলামেলা কথা বলতে চাইছেন না।

রোববার রাজধানীর প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে (পিআইবি) ‘সংকটে তিস্তা নদী: সমাধানের পথ কী?’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) যৌথভাবে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।

মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাপার সহসভাপতি অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জমান। প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ভারতের সঙ্গে কোনো পানিবণ্টন চুক্তি না থাকায় এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম না মেনে উজানে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে তিস্তা নদী মারাত্মক সংকটে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে আর বর্ষাকালে নিয়ন্ত্রণহীন পানিনির্গমনের ফলে বাংলাদেশ অংশে বন্যা ও ভাঙনের ঝুঁকি বাড়ছে।

মতবিনিময় সভায় বিশেষজ্ঞরা তিস্তা সমস্যার সমাধানে ভারতের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পৃক্ততা, আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ এবং প্রকল্পে স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহণের ওপর জোর দেন। তাঁরা তিস্তা মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে স্বচ্ছতা ও পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানান।

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সরকারের কাছে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কোনো তথ্য নেই। বিগত বছরগুলোতে উন্নয়নের নামে দেশের নদীগুলোকে সংকুচিত করা হয়েছে। আমরা আর সংকুচিত করার উন্নয়ন চাই না। নদীকে নদীর মতোই রাখতে হবে।’

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, দেশের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বার্থকে উপেক্ষা করে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে। যেসব প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদি, সেসব প্রকল্প গ্রহণের আগে অবশ্যই জনগণের মতামত নিতে হবে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব সামর্থ্য অনুযায়ী প্রকল্প নেওয়া উচিত। নদীকে রক্ষা করতে হবে কিন্তু তাকে খালে পরিণত করে নয়। এই প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

বাপার প্রতিষ্ঠাতা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বাপা কখনো উন্নয়নবিরোধী নয়। আমরাও চাই দেশের উন্নয়ন হোক। কিন্তু সেই উন্নয়ন হতে হবে দেশের প্রাণপ্রকৃতি, পরিবেশ ও নদীকে ঠিক রেখে। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে কেউ খোলামেলা কথা বলতে চাইছেন না। সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে সংবেদনশীল হওয়ায় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।’

বাপার সভাপতি অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদারের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবিরের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পরিবেশবিদ, গবেষক ও তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা অংশ নেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ