চাকরি ছেড়ে মুরগির খামারে বাজিমাত, আকরামের মাসে আয় অর্ধলাখ টাকা
Published: 27th, July 2025 GMT
একসময় অন্যের অধীনে চাকরি করতেন আকরাম। মাস শেষে নির্দিষ্ট বেতন মিলত ঠিকই, কিন্তু তাতে মনের খোরাক জুটত না। মনে হতো, জীবনটা কি শুধু এভাবেই যাবে? কিছু একটা নিজের মতো করে গড়ে তুলতে হবে। এই ভাবনাই তাঁকে টেনে এনেছিল নিজের মাটিতে, নিজের গ্রামে। শুরু করেছিলেন ছোট্ট এক খামার দিয়ে। সেই খামারই এখন তাঁর সফলতার সবচেয়ে বড় ঠিকানা। খামার থেকে এখন তাঁর মাসে আয় প্রায় অর্ধলাখ টাকা।
আকরাম মোল্যার বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার হবখালী ইউনিয়নের সিঙ্গিয়া গ্রামে। বাবা আবদুর সামাদ মোল্যার চার সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তাঁদের সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। তাই ২০১৪ সালে এইচএসসিতে পড়ার সময়ই ভাগ্য বদলের আশায় চট্টগ্রামে পাড়ি দেন আকরাম। কাজ নেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। টানা তিন বছর চাকরি করে সিদ্ধান্ত নেন, আর নয় অন্যের হয়ে কাজ; এবার নিজের স্বপ্নের পথে হাঁটবেন।
২০১৭ সালে চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসেন আকরাম। এ সময় পরিবার তাঁর পাশে দাঁড়ায়। তিন লাখ টাকা জোগাড় করে আকরাম শুরু করেন ‘ভাই ভাই অ্যাগ্রো ফার্ম’। শুরুতেই তোলেন দুই হাজার সোনালি জাতের মুরগির বাচ্চা। কিন্তু ভাগ্য তখন সহায় ছিল না। একে একে মারা যায় ১ হাজার ৬০০ বাচ্চা। একেবারে শুরুতেই এমন ধাক্কা অনেককেই হয়তো থামিয়ে দিত। তবে আকরাম হাল ছাড়েননি।
আকরাম বলেন, শুরুতেই এত বড় লোকসানে মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েন। কিন্তু ঠিক করেন—এখানেই থামবেন না। এরপর নতুন করে শুরু করলেন মিসরীয় ফাউমি মুরগির খামার, যাকে বলা হয় ‘ডিমের রাজা’। এই জাতটি রোগ প্রতিরোধে শক্তিশালী, ডিমও দেয় বেশি। ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন করে বিক্রি শুরু করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
খামারের একটি শেডে রাখা হয়েছে বড় মুরগিগুলো। এই মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন করে বিক্রি করেন আকরাম। সম্প্রতি নড়াইল সদর উপজেলার সিঙ্গিয়া গ্রামে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলতে চান রিকশাচালক শফিকুল
বাঁশির সঙ্গে সখ্য সেই শৈশবে। গ্রামে যাত্রাপালায় গান করতেন আর বাঁশির সুরে ছড়াতেন মুগ্ধতা। জীবন-জীবিকার তাগিদে একসময় বেছে নেন রিকশাচালকের পেশা। গ্রাম ছেড়ে থিতু হন ব্যস্ত শহরে। তবে বাঁশের বাঁশিকে হাতছাড়া করেননি শফিকুল ইসলাম (৪৫)।
যানজটে গতি থামতেই রিকশার হ্যান্ডেল ছেড়ে শফিকুল কোমর থেকে হাতে নেন প্রিয় বাঁশি। হর্নের কর্কশ ধ্বনি এড়িয়ে তখন বাতাসে ভাসে সুরের মূর্ছনা। বেখেয়ালি যাত্রী আর পথচারীরা হঠাৎ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন বাঁশিওয়ালার দিকে।
দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। সেই বাঁশির সুরেই যেন তাঁর জীবন বাঁধা। অভাব, দুর্দশা আর দারিদ্র্যও এ বন্ধন থেকে তাঁকে আলাদা করতে পারেনি। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।
শফিকুলের পৈতৃক ভিটা বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার শালিখা গ্রামে। তবে জীবিকার তাগিদে থাকেন বগুড়া শহরের মালতীনগর এলাকার একটি গ্যারেজে। গত রোববার বিকেলে তাঁর দেখা মেলে বগুড়া শহরের কোর্ট হাউস স্ট্রিটের ব্যস্ত সড়কে। শেষ বিকেলে যানজটে যখন পথচারীরা বিরক্ত, তখন বাতাসে ভেসে আসে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ ভাওয়াইয়া গানটির সুর।
দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।এরই একফাঁকে আলাপ হয় শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি জানান, দারিদ্র্যের কারণে পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই পড়ালেখা বন্ধ করতে হয়। এরপর জড়িয়ে পড়েন গ্রামের একটি যাত্রাপালার দলে। ‘কাজলরেখা’, ‘সাগরভাসা’, ‘গুনাইবিবি’, ‘রাখালবন্ধু’, ‘রূপবান’সহ নানা লোককাহিনিনির্ভর যাত্রাপালায় অভিনয় ও গান করেছেন। শুধু তা–ই নয়, গানের সুরে হারমোনিয়ামও বাজাতেন। এসবের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক রিকশা চালাতেন তখন।
পরিবারের বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, ২০০০ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রী মোর্শেদা গৃহিণী। তাঁদের তিন মেয়ে—শরীফা, শম্পা ও শাকিলা। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী ও দুই মেয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মাসে দুবার তিনি বাড়িতে যান। শফিকুলের দাবি, বগুড়া শহরে রিকশা চালিয়ে দিনে পান ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। থাকা-খাওয়া ও রিকশার জমা খরচ ছাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা থেকে যায়। সেই টাকায় চলে সংসার।
শুরুতে শহুরে জীবন শফিকুলের একদম ভালো লাগত না, মন পড়ে থাকত সেই গ্রামে। মন ভালো রাখতে রিকশা চালানোর সময় গুনগুন করে গাইতেন। এর মধ্যে শহরের রাস্তায় একদিন এক বাঁশিওয়ালার সঙ্গে তাঁর দেখা। তাঁর কাছ থেকে উপার্জনের ৮০ টাকা দিয়ে একটি বাঁশি কেনেন তিনি। এরপর রাতে গ্যারেজে শুয়ে সেই বাঁশিতে সুর তোলেন। এখন বাঁশি তাঁর নিত্যসঙ্গী।
বাঁশি বাজাতে বাজাতে রিকশা চালানো অভ্যাস হয়ে গেছে জানিয়ে শফিকুল বলেন, যানজটে আটকা পড়লে বাঁশিতে সুর তোলেন। যাত্রী না পেলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একমনে বাঁশি বাজান। সুর শুনে যাত্রীরা ১০-২০ টাকা বেশি ভাড়া দেন কখনো কখনো।
গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী।শফিকুল ইসলামস্মৃতি হাতড়ে শফিকুল বলেন, একবার ঢাকায় রিকশা চালাতে গিয়েছিলেন। দৈনিক বাংলার মোড়ে রিকশা থামিয়ে একমনে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি ২০ তলা ভবন থেকে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তির চিৎকার শুনতে পান। ওপরে তাকাতেই ৫০ টাকার একটা নোট নিচে ফেলে দেন ওই ব্যক্তি। প্রশংসা করেন বাঁশির সুরের।
আলাপচারিতা একসময় আনমনে হয়ে পড়েন শফিকুল। বলেন, ‘মন তো (মনে) না পাওয়ার কষ্ট আচে। ১৬ বছর বয়সে এলাকার এক মেয়ের প্রেমে পড়চিনু। ৬ মাস ভালোই চলিচ্চিল সেই প্রেম। গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী। আরও পরে সঙ্গী হয় বাঁশি। এহন বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলে থাকপার চেষ্টা করি।’