নদীর ওপর খানিকটা বাকি সেতু পানিতে
Published: 17th, January 2025 GMT
জগন্নাথপুরের নাইয়াদাঁড়া নদী পারাপারে নির্মিত সেতুটি ভেঙে যাওয়ার পর পেরিয়ে গেছে ৯ বছর। স্থানীয়দের পক্ষ থেকে একাধিকবার সেখানে একটি নতুন সেতু নির্মাণের দাবি জানানো হলেও নেওয়া হয়নি উদ্যোগ।
 উপজেলার পাটলী ইউনিয়নের প্রভাকরপুর-নন্দীরগাঁও স্থানীয় সড়কের নাইয়াদাঁড়া নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল সেতুটি। ২০০০ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে এর প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। নদীর ওপর সেতু নির্মাণের পর এ পথে ইউনিয়নের প্রভাকরপুর, নন্দিরগাঁও, মোহাম্মদপুর, ইসলামপুর, হামিদপুর, বনগাঁওসহ ১০ গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষের জীবনযাত্রায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে।
 সেতু এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীর এক পারের সংযোগ সড়কের সঙ্গে যুক্ত সেতুর একাংশ নদীর খানিকটা ভেতর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে। বাকিটা ভেঙে পড়ে তলিয়ে গেছে।
 এলাকাবাসী ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে নদীর প্রবল স্রোতের ধাক্কায় সেতুটির অধিকাংশ ভেঙে ধসে পড়ে। তখন থেকেই সেতুতে পারাপার বন্ধ রয়েছে। সেতুর অভাবে জনগুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটি ব্যবহার করতে পারছেন না স্থানীয়রা। নতুন সেতু নির্মাণের দাবি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো লাভ হয়নি। নেওয়া হয়নি জনদুর্ভোগ কমানোর উদ্যোগ।
 প্রভাকরপুর গ্রামের বাসিন্দা রাসেল বক্স জানান, সেতুটি ভেঙে যাওয়ার পর এলাকাবাসীর দুর্ভোগ অবর্ণনীয়। স্থানীয় পর্যায়ে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই সড়কে চলাচলকারীদের ৫ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে ঘণ্টা ব্যয় করতে হচ্ছে দেড় কিলোমিটারের ঘুর পথে।
পাটলী ইউনিয়ন উইমেন্স কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সায়মা আক্তার জানান, সেতু থাকাকালে ৫ মিনিটে যাওয়া যেত স্কুলে। এখন ৩০ মিনিটের হাঁটা পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।
 ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ছায়াদ মিয়া জানান, ৯ বছর ধরে একটি সড়কে নদীর ওপর থাকা সেতুটি খোঁড়া হয়ে আছে। তা সংস্কার বা নতুন সেতু নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেই। অন্তত ১০টি গ্রামের মানুষ ভুগছেন এ কারণে। ওই সেতু দিয়ে উপজেলা সদর, ইউনিয়ন পরিষদ, রসুলগঞ্জ বাজারসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
 এ ব্যাপারে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী সোহরাব হোসেন জানান, নতুন সেতু নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, শিগগির কোনো নির্দেশনা পাওয়া যাবে।
  
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সুদানের যুদ্ধ ও গণহত্যার পেছনে কারা
১৮ মাস ধরে সবার চোখের সামনে সবকিছু ঘটে যাচ্ছে। সুদানের দারফুর অঞ্চলের আল ফাশের শহর মিলিশিয়া বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ) অনেক দিন ঘেরাও করে রেখেছিল। গত সপ্তাহে শহরটিতে এই বাহিনী ঢুকে পড়ে এবং তারপর যা ঘটেছে, তাকে এককথায় বলা যায় মহাবিপর্যয়।
সেখানে নির্বিচার গণহত্যা চলছে। একটি হাসপাতালেই প্রায় ৫০০ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে রোগী ও তাদের পরিবারের লোকজনও আছে। যাঁরা পালাতে পেরেছেন তাঁরা জানিয়েছেন, সেখানে একেবারে সাধারণ নাগরিকদের বাছবিচার ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে।
আরএসএফ এত নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করছে যে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকেও জমিতে জমে থাকা রক্ত দেখা গেছে। আল ফাশের পতনের পর প্রথম কয়েক ঘণ্টার গণহত্যার গতি ও তীব্রতাকে রুয়ান্ডার গণহত্যার প্রথম ২৪ ঘণ্টার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।
আল ফাশের ছিল সুদানের সেনাবাহিনীর দারফুর শেষ শক্তিকেন্দ্র। আর গত সপ্তাহটি সুদান যুদ্ধে একটি গুরুতর পরিবর্তনের সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এখন এই যুদ্ধে সুদানের সশস্ত্র বাহিনী এসএএফ এবং মিলিশিয়া বাহিনী আরএসএফ দেশের নিয়ন্ত্রণের জন্য নিষ্ঠুর ও অবিরাম লড়াই চালাচ্ছে।
সুদানের যুদ্ধকে অনেকে ‘ভুলে যাওয়া যুদ্ধ’ বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এটি বিশ্বশক্তিগুলোর চুপ থাকা ও অবহেলার ফসল। কারণ, সুদানের ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া মানে হচ্ছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির ভণ্ডামির মুখোমুখি হওয়া।এই দুই পক্ষ আগে একসঙ্গে সরকারে অংশীদার ছিল। ২০১৯ সালে এক জনপ্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তারা বেসামরিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে এক অস্বস্তিকর জোট সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু পরে তারা প্রথমে বেসামরিকদের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয় এবং এরপর একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।
এই দুই গ্রুপে যে সংঘাত শুরু হয়, তা ছিল ভয়াবহ। এই সংঘাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, বশিরের গড়ে তোলা আরএসএফ বাহিনী (বশিরকে রক্ষা করা ও দারফুর তাঁর হয়ে লড়ার জন্য মূলত জানজাউইদ যোদ্ধাদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল) গোপনে কতটা শক্তি ও সম্পদ সংগ্রহ করে ফেলেছিল।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে যে যুদ্ধ শুরু হয়, সেটি কেবল সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো ছোটখাটো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সংঘর্ষ ছিল না। এটি ছিল দুই পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধ। কারণ, উভয় পক্ষের হাতেই অস্ত্রভান্ডার, অর্থের উৎস, হাজার হাজার সেনা এবং বিদেশি জোগানদাতাদের সহায়তা—সবকিছু ছিল।
আরও পড়ুনযে কারণে সুদানে আজ রক্তক্ষয়ী সংঘাত১৯ এপ্রিল ২০২৩এর পর থেকে সেখানে কয়েক কোটি মানুষ ভিটেছাড়া হয়েছে এবং আনুমানিক দেড় লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। সেখানে এখন তিন কোটির বেশি মানুষের জরুরি মানবিক সহায়তার প্রয়োজন। কিন্তু এই ভয়াবহ সংখ্যাগুলোও সুদানের আসল দুর্দশার পুরোটা চিত্র দেয় না।
দেশটা খুব দ্রুত ভেঙে পড়ছে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর দারফুর আরএসএফ যে ভয়ংকরভাবে মানুষ হত্যা করেছে, তা এসব পরিসংখ্যানের বাইরের টাটকা নিষ্ঠুর বাস্তবতা।
প্রকাশ্যে আসা এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় মানুষ মিলিশিয়াদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছেন। এক ব্যক্তিকে একজন কমান্ডার বলছিলেন, ‘কেউ বাঁচবে না।’ এরপর তাঁকে গুলি করা হয়। কমান্ডার বলছিলেন, ‘আমি তোমাদের প্রতি কোনো দয়া দেখাব না। আমাদের কাজ শুধুই হত্যা করা।’
সবকিছুই আগে থেকে অনুমান করা গিয়েছিল। কোনো কিছু একদমই অপ্রত্যাশিত ছিল না। মাসের পর মাস ধরে গণহত্যা ও নৃশংসতার আশঙ্কা নিয়ে আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছিল। প্রায় ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত দারফুরবাসী (যাঁরা অন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন) আল ফাশের শহরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে যুদ্ধ বাড়তে থাকায় কেউ কেউ সেখান থেকে আবার পালিয়ে যান। অনেকেই শহরটিতে আটকা পড়ে যান।
আরও পড়ুনসুদানে আরএসএফের গণহত্যায় আরব আমিরাত ইন্ধন দিচ্ছে কেন০২ নভেম্বর ২০২৫এই দৃশ্য শুধু ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা গণহত্যার প্রথম দিকের দিনগুলোকেই মনে করিয়ে দেয় না; বরং ২০ বছর আগের দারফুরের সেই ভয়ংকর গণহত্যাকেও আবার জীবন্ত করে তোলে। তবে এবার তা ফিরে এসেছে আরও ভয়াবহ ও ঘনীভূত আকারে।
আজকের আরএসএফ আসলে সেই পুরোনো জানজাওয়িদেরই নতুন রূপ। তবে এবার তারা আরও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, শক্তিশালী বিদেশি মিত্রদের সমর্থনপুষ্ট এবং আবারও তারা অনারব জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে এগোচ্ছে। এখন তারা উট বা ঘোড়ায় চড়ে আসে না। তারা আসে চার চাকার ‘টেকনিক্যাল’ গাড়িতে। সেই গাড়িতে মেশিনগান বসানো থাকে। তাদের সঙ্গে আরও থাকে ভয়ংকর শক্তিশালী ড্রোন।
দারফুর ও আল ফাশের অঞ্চলে যে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চলছে, তার পেছনে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) বড় ভূমিকা রাখছে। ইউএই অনেক দিন ধরেই আরএসএফ-এর ঘনিষ্ঠ মিত্র। আরএসএফ মিলিশিয়াদের ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে ইউএই এর আগে ইয়েমেনের যুদ্ধে পাঠিয়েছিল। এখন তারা আরএসএফের হাতে প্রচুর টাকা ও অস্ত্র দিচ্ছে। এর ফলে সুদানের যুদ্ধ আরও ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়েছে।
ভূরি ভূরি প্রমাণ থাকার পরও ইউএই এখনো দারফুরে নিজের ভূমিকা অস্বীকার করে যাচ্ছে। বিনিময়ে তারা সুদানের মতো বড়, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশে নিজেদের প্রভাব বাড়িয়েছে। এ ছাড়া আরএসএফের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর খনি থেকে তোলা সোনার বেশির ভাগ অংশও ইউএই পাচ্ছে।
এদিকে আরও কিছু দেশ ও গোষ্ঠী এই সংঘাতে নিজেদের স্বার্থে জড়িয়েছে। ফলে যুদ্ধটি এখন একধরনের ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ বা পরোক্ষ শক্তির লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এর ফল এক ভয়াবহ অচলাবস্থা, রক্তক্ষয় ও এমন এক পরিস্থিতি, যার ইতি টানা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে, অথচ সবকিছুই সবার চোখের সামনে ঘটছে।
সুদানের যুদ্ধকে অনেকে ‘ভুলে যাওয়া যুদ্ধ’ বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এটি বিশ্বশক্তিগুলোর চুপ থাকা ও অবহেলার ফসল। কারণ, সুদানের ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া মানে হচ্ছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির ভণ্ডামির মুখোমুখি হওয়া।
● নাসরিন মালিক দ্য গার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত