রকিব ভাইয়ের লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৮০ সালে। আমি তখন স্কুলে পড়ি। বরিশাল হেমায়েতউদ্দিন খান রোডের এ কে স্কুলে। ওখান থেকে ঢিল মারা দূরত্বে, বিবির পুকুরপাড়ে ছিল বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি। হলুদ রঙের রহস্যময় একটি বিল্ডিং। ভেতরে ঢুকতে কেমন গা ছমছম করত। লাইব্রেরিতে বসে অনেকেই বই পড়তেন। স্কুল ছুটির পরে বহুদিন বাসায় না গিয়ে ঢুকে পড়েছি লাইব্রেরিতে। বেশিরভাগ সময় পড়তাম পশ্চিমবঙ্গের দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত কিশোর ক্ল্যাসিক অনুবাদ। বড় বড় কাঠের আলমারিতে থাকত বইগুলো।

একদিন এ রকম একটি বই আলমারি থেকে আনতে গিয়ে দেখি এক কোণায় পড়ে আছে ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’। রূপান্তর: রকিব হাসান। ড্রাকুলা মুভি বিটিভিতে দেখেছি আমি, তবে এটির যে অনুবাদ বেরিয়েছে জানতাম না। সেবা প্রকাশনীর অনেকগুলো কুয়াশা এবং জুল ভার্নের অনুবাদ ততদিনে আমার পড়া হয়ে গেছে। এই প্রকাশনীর রীতিমত ভক্ত হয়ে গেছি। তবে রকিব হাসানের কোনো বই আমি তখনো পড়ি নি, নামটিও জানতাম না। পরে জেনেছি তিনি ১৯৭৭ সাল থেকে লিখতে শুরু করেন। তাঁর প্রথম বই ছিল মাসুদরানা সিরিজের ‘কুউউ!’ গোস্টরাইটার হিসেবে লিখেছিলেন। যেহেতু বইয়ের নাম ছিল ড্রাকুলা তাই আমি আগ্রহী হয়ে আলমারি থেকে বইটি নিয়ে কোণার দিকে একটি টেবিল বেছে নিয়ে পড়তে বসে যাই। সেবার পাঠক মানেই জানেন সেবার সিনিয়র লেখকদের অনুবাদে কী দারুণ যশ! বলাবাহুল্য রকিব হাসানও আমাকে দারুণভাবে ধরে রাখেন। ড্রাকুলা দুই খণ্ডে বেরিয়েছিল। আমি হাতে পেয়েছিলাম প্রথম খণ্ডটি। বই পড়ার সাংঘাতিক নেশা আমাকে একজন ফাস্ট রিডারে পরিণত করেছিল। সম্ভবত দুই ঘণ্টার মধ্যে প্রথম খণ্ড পড়া শেষ। মন তখন আকুপাকু দ্বিতীয় খ- পড়ার জন্য।  খেয়ালও করিনি কখন সাঁঝ গড়িয়ে প্রকৃতির বুকে নেমেছে রাত। সেরেছে, আজ বাসায় নির্ঘাত পিট্টি খেতে হবে। তবে মার খাওয়ার ভয়ের চেয়ে আমার বুকে আরেকটা ভয় সাপের মতো হিলহিল করে ঢুকে গিয়েছিল। ড্রাকুলার ভয়! সেই রাতে কীভাবে যে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাসায় ফিরেছিলাম সেই গল্প হবে আরেকদিন।

তবে ড্রাকুলার দ্বিতীয় খণ্ড আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে পাই নি। কেউ হয়তো হাপিশ করে দিয়েছিল। দ্বিতীয় খ-টি আমি মরণদার (মরণ চক্রবর্তী, যাকে বরিশালের সবাই এক নামে চেনেন। তিনি এক/দুই টাকায় সেবা প্রকাশনীসহ অন্যান্য প্রকাশনীর বই ভাড়া দিতেন। বরিশাল কসাই মসজিদের ঠিক সামনেই ছিল তাঁর দোকান।) কাছ থেকে এক টাকায় ভাড়া নিয়ে পড়েছিলাম।

সেই শুরু। কাজী আনোয়ার হোসেনের পরে সেবার যে লেখক আমাকে কিশোর বয়সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রেখেছিলেন তিনি রকিব হাসান। পরে আমাকে আরও দু’জন লেখক দারুণ মুগ্ধ করেছিলেন― প্রয়াত শেখ আবদুল হাকিম এবং নিয়াজ মোর্শেদ। হাকিম ভাইয়ের ভক্ত হয়ে যাই তাঁর রচিত রহস্যোপন্যাস ‘কামিনী’ পড়ে। আর নিয়াজ ভাইয়ের অনূদিত কিশোর ক্ল্যাসিকগুলোর তো তুলনাই হয় না। আমার সৌভাগ্য সেবা’র এই তিন সুপারস্টার লেখকের সান্নিধ্য এবং স্নেহ আমি লাভ করি রহস্যপত্রিকায় লিখতে গিয়ে।

রকিব ভাইকে আমি প্রথম দেখি সেগুনবাগিচার রহস্যপত্রিকা অফিসে। ১৯৯১ সালের শরতের এক স্নিগ্ধ বিকেলে। আমাকে রহস্যপত্রিকা অফিসে এর আগের বছর, একদিন সকালে নিয়ে গিয়েছিলেন আমার ডিপার্টমেন্টের জয়দা (তপন সিনহা জয়। তিনিও ঢাবিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পড়তেন। রহস্যপত্রিকায় টুকটাক লিখতেন। সেই সুবাদে তাঁকে একদিন ধরে বসি আমাকে স্বপ্নের সেবা প্রকাশনীতে নিয়ে যাবার জন্য।) রহস্যপত্রিকার সহকারী সম্পাদকরা বিকেলে বসতেন জানতাম না। তাই বেশ হতাশই হয়েছিলাম। তবে রহস্যপত্রিকার সমন্বয়কারী শেখ মহিউদ্দিন ভাই বলেছিলেন যে কোনো শনিবার বিকেল চারটার পরে যেতে। ওইদিন পত্রিকার তিন সহকারী সম্পাদককেই পাওয়া যাবে। তিনি আমাকে লেখা নিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওই ঘটনার প্রায় বছরখানেক বাদে আমি আবার যাই রহস্যপত্রিকা অফিসে দুটো লেখা নিয়ে। তবে এবারে একা। দুরুদুরু বক্ষে পত্রিকা অফিসে প্রবেশ আমার। আজ কি সত্যি দেখা হবে আমার প্রিয় লেখকদের সঙ্গে যাদের বই পড়ে বড় হয়েছি! বিশেষ করে রকিব হাসানের কথা ভেবে ভয় একটু বেশিই লাগছিল। উনি কি আদৌ আমাকে পাত্তা দেবেন? শুনেছি কাঠখোট্টা স্বভাবের মানুষ। কাউকে তোয়াক্কা করেন না।

আসলেই সেদিন আমাকে পাত্তা দেন নি রকিব ভাই। আমার দিকে ভালো করে তাকান নি পর্যন্ত। কিন্তু হাকিম ভাই আমার গল্পটি এক পাতা পড়ে মন্তব্য করেছিলেন, দেখে তো মনে হচ্ছে ভালোই। রেখে যান। তিন মাস পরে খবর নিয়েন। (আমার ওই গল্পটি হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি! পরে গাদাগাদা লেখার স্তূপ থেকে ওটাকে আমি উদ্ধার করি এবং পরের মাসেই ঘুণপোকা নামে রহস্যপত্রিকায় ছাপা হয়। এরপর আক্ষরিক অর্থেই আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। কারণ গল্পটি পড়ে বহু পাঠক ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিলেন। হাকিম ভাই তারপর আমাকে নিয়মিত লিখতে উৎসাহ দেন।)

নিয়াজ মোর্শেদ ভাইয়ের জন্য রিডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকার একটি ফিচার অনুবাদ করে নিয়ে গিয়েছিলাম। স্বল্পভাষী লেখকটি শুধু সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়েছিলেন―মানে রেখে যাও। পরে পড়ব। আর রকিব ভাই? তাঁকে আদাব দিয়েছিলাম আমি। তিনি শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে কী একটা লেখা এডিট করছিলেন সেটাতে ফিরে গেলেন এবং খানিক পরে ‘কিচ্ছু হয় নাই’ বলে ওটাকে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ছুড়ে ফেলে দিলেন। তারপর মহিউদ্দিন ভাইকে বললেন, ‘মহিউদ্দিন, চা আনান।’ এরপর শুরু হলো তাঁর বকবক। আমি যে একটা মানুষ, বসে আছি তাঁর সামনে, তাঁকে তৃষিত নয়নে দেখছি তিন গোয়েন্দার লেখক, ড্রাকুলাসহ বিভিন্ন শিকার কাহিনির দুর্দান্ত অনুবাদক হিসেবে; খেয়ালই করলেন না। কিংবা লক্ষ্য করলেও গ্রাহ্য করলেন না। এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর এমন কত হাজার হাজার ভক্ত আছে দেশজুড়ে।

তবে আমার ইগোতে খুব লাগল। রকিব হাসানকে প্রথম দর্শনেই মনে হলো অত্যন্ত অহঙ্কারী একজন মানুষ এবং রসকষহীন যিনি চিৎকার করে কথা বলেন এবং অন্যদের কথা শুনবার চেয়ে নিজের কথা বলতেই বেশি ভালোবাসেন। তবে পরবর্তীতে তাঁর সঙ্গে যখন আমার রসায়ন মিলে গেল তখন দেখলাম তিনি অহঙ্কারী বটে ( আত্মবিশ্বাসী বেশিরভাগ মানুষ অহঙ্কারী হয়ে থাকেন, এতে দোষের কিছু নেই) তবে নিরস নন। এবং দেশের অনেক জনপ্রিয় লেখকের প্রতি তাঁর একটু নাক সিঁটকানোর অভ্যাস আছে। ‘স’ আদ্যাক্ষরের একদা জনপ্রিয় এক লেখককে তিনি লেখক বলেই মনে করতেন না। বলতেন ওর তো বাক্য গঠনই হয় না। তবে কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রতি তাঁর অসম্ভব শ্রদ্ধাবোধ ছিল। সেবা থেকে অভিমান করে ২০০০ সালের দিকে চলে গেলেও তাঁকে কোনোদিন কাজীদা সর্ম্পকে কোনো কটূক্তি করতে শুনি নি। তিনি বলতেন কাজীদা তাঁকে নিজের হাতে লেখক হিসেবে গড়ে তুলেছেন।

রকিব ভাইয়ের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ আমার ঘটে সম্ভবত ১৯৯৩ সালের দিকে। ততদিনে হরর লেখক হিসেবে রহস্যপত্রিকায় আমার একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছে। একদিন বিকেলে রহস্যপত্রিকা অফিসে গেছি হাকিম ভাইকে একটি গল্প দিতে। তিনি তখনো আসেন নি। আমি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় রকিব ভাই আমাকে ডাক দিলেন, ‘অনীশ, এদিকে আসেন।’  আমি লাফ মেরে তক্ষুণি তাঁর টেবিলের সামনে। তিনি রিডার্স ডাইজেস্টের লেটেস্ট সংখ্যাটি আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘এটা নিয়ে যান। এতে হাঙরের ওপর একটা লেখা আছে। পড়ে দেখেন। ভালো লাগলে অনুবাদ করবেন।’

আমি নাচতে নাচতে পত্রিকা নিয়ে জগন্নাথ হলে ফিরলাম। দুইদিন পরেই আমার ইনকোর্স পরীক্ষা। রকিব ভাইকে সেটা জানাই নি পাছে লেখাটি তিনি অন্য কাউকে অনুবাদের জন্য দিয়ে দেন! ‘পরীক্ষার গুল্লি মারি’ বলে সেই রাতেই লেখাটি নিয়ে বসে পড়লাম। রকিব ভাই যদিও আমাকে তিনদিন সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি পরদিনই লেখাটি মহিউদ্দিন ভাইকে দিয়ে এলাম। লেখার শিরোনাম: সাগরতলের আতঙ্ক। তারপর শুরু হলো আমার অন্তহীন বেদনাদায়ক অপেক্ষা। মনে ভয় কী হয়! কী হয়! লেখাটি রকিব ভাইয়ের পছন্দ না হলে ওটার শেষ আশ্রয় নির্ঘাত ময়লা ফেলার ঝুড়ি। আর উনি যা খুঁতখুঁতে! লেখা পছন্দ না হলে আর কোনো দিনই হয়তো তাঁর বিভাগে লেখার চান্স পাব না। ওনাকে জিজ্ঞেস করারও সাহস নেই। পাছে রেগেটেগে যান। একদিন মহিউদ্দিন ভাইকে ফোনও করেছিলাম জানতে লেখাটার কী অবস্থা। জানলাম রকিব ভাই পড়ার সময় করে উঠতে পারেন নি এখনো। তবে পরের মাসে আমার জন্য দারুণ একটি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল। তখন আমি নিয়মিত সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকায় কিনতাম। একদিন পত্রিকা স্টলে ২০০০ কিনতে গিয়ে দেখি সেই মাসের রহস্যপত্রিকা ঝুলছে দোকানে। প্রচ্ছদে একটি হাঙরের ছবি। নিচে ক্যাপশন―সাগরতলের আতঙ্ক। আশ্চর্য খুশিতে ভরে উঠল মন।

এরপর থেকে রকিব ভাই আমাকে দিয়ে নিয়মিত ফিচার অনুবাদ শুরু করালেন। আমার অসংখ্য অনুবাদ ফিচার দিয়ে রহস্যপত্রিকায় কভার করা হয়েছে। তিনি এক পর্যায়ে আমাকে দিয়ে ধারাবাহিক লেখা লেখাতে লাগলেন। প্রথমে দিয়েছিলেন জিম করবেটের আত্মজীবনীমূলক বই ‘মাই ইন্ডিয়া’। বইটি ‘বনের গল্প’ নামে এক বছরেরও বেশি সময় রহস্যপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। পরে ২০০৩ সালে বই আকারে সেবা থেকে প্রকাশিত হয়। তিনি জেরাল্ড ডুরেলের ‘মাই ফ্যামিলি অ্যান্ড আদার অ্যানিম্যালস’ নামে আরেকটি বই অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন। এটিও রহস্যপত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছে ‘মানবজন্তু’ নামে। সেবা থেকে আমার যত বই বেরিয়েছে আমি সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পেয়েছি এই বইটির জন্য। রকিব ভাই নিজেও আমার অনুবাদের প্রশংসা করেছেন। মহিউদ্দিন ভাইয়ের কাছে শুনেছি তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘অনীশের লেখা আগে এডিট করতে হতো। কিন্তু এখন আর হাত দেওয়ার দরকার হয় না।’ 

রকিব হাসান ছিলেন কাজীদার পরে সেবা প্রকাশনীর সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তাঁর তিন গোয়েন্দা মাসে সাত হাজার কপি বিক্রি হতো। তাঁর লেখা ‘গরমের ছুটি’ বইটি তিনদিনে প্রথম এডিশন শেষ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি তাঁর বইয়ের রয়ালটি তুলেছিলেন ৯২ হাজার টাকা। এটা মাত্র তিন মাসের বইবিক্রির রয়ালটি। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকার সময় তিনি সেবা ত্যাগ করেন।  কী ছিল তাঁর অভিমান সেটি কোনোদিনই খোলাসা করেন নি। তবে সেবা ছেড়ে চলে আসার পরে বছর কয়েক রকিব ভাই একটু বিপাকেই ছিলেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন বাংলাবাজারের প্রকাশকরা তাঁকে লুফে নেবে। কিন্তু শুরুতেই এটা ঘটে নি। সময় লেগেছে। ওই সময় ফোনে রকিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।

আমি তখন সেবার পাশাপাশি বাংলাবাজারেও নিয়মিত লিখছি। তাই তিনি বাংলাবাজারের হালহকিকত বুঝতে চাইতেন আমার সঙ্গে কথা বলে। তাঁর সঙ্গে দেখাও করতাম তিনি চাইলে। আমি বলতাম, কোন কোন প্রকাশক ঠিকঠাক টাকাপয়সা দেয়, কারা ঠকায়, কাদের ওপর ভরসা রাখা যায় ইত্যাদি। সেবা প্রকাশনীর মতো পাইপয়সা হিসাব করে দেওয়ার মতো প্রকাশক খুব কম আছে শুনে তিনি হতাশই হতেন। পরে সিদ্ধান্ত নেন এককালীন পেমেন্ট নেবেন। এবং তিনি তাই করতে থাকেন। একসময় তাঁর কাছে বাংলাবাজারের প্রকাশকরা নক দিতে শুরু করেন। সবাই তাঁর কাছে তিন গোয়েন্দার মতো সিরিজের আবদার করতেন। কিন্তু তিন গোয়েন্দার গ্রন্থস্বত্ব ছিল সেবা প্রকাশনীর। তাই রকিব ভাই তিন বন্ধু ইত্যাদি শিরোনামে বই লিখতে থাকেন। 

রকিব হাসানকে নিয়ে অসংখ্য স্মৃতি আছে আমার যা এই স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। বাংলাবাজারে লেখালেখি সংক্রান্ত কোনো পরামর্শের দরকার হলেই তিনি আমাকে ফোন দিতেন। তবে তিনি অসুস্থ হবার পরে যোগাযোগটা কমে যায়। একদিন তিনি অত্যন্ত দুর্বল কণ্ঠে ফোনে বললেন, তিনি আর লিখতে পারছেন না। কারণ সবসময় হাত কাঁপে। সম্ভবত পারকিনসন্স ডিজিজে আক্রান্ত হয়েছিলেন রকিব ভাই। তিনি আলঝিমার্স রোগেও ভুগছিলেন। স্মরণশক্তি কমে যাচ্ছিল ক্রমে। দুটো নম্বরে কথা বলতেন আমার সঙ্গে। একটি ছিল গ্রামীণ ফোন, অপরটি সিটি সেল। তিনি ফোন করেই বলতেন, ‘হ্যালো, অনীশ কী খবর?’  বরাবরই উচ্চস্বরে কথা বলতেন। আর একবার ফোন করলে সহজে ছাড়তেন না। বিল উঠে যাচ্ছে সমানে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই! হাসির কথায় ঘর ফাটিয়ে হাসছেন। যে মানুষটিকে প্রথম দর্শনে আমার অপছন্দ হয়েছিল সেই তিনিই হয়ে গিয়েছিলেন আমার একজন প্রিয় বন্ধু, আমার অগ্রজ যার কাছে লেখা সম্পাদনার অনেক কিছুই শিখেছি। 

আফসোস, যে মানুষটির একটি পাণ্ডুলিপি নেওয়ার জন্য প্রকাশকরা হাজার হাজার টাকা নিয়ে তাঁর বাড়িতে যেতেন, তিনি অসুস্থ থাকাকালীন কেউ তাঁর খোঁজ নেয় নি। এ জন্যেই তিনি মৃত্যুর আগে অভিমান করে তাঁর ছেলেদের বলে গিয়েছিলেন, তাঁর লাশ নিয়ে কেউ যেন কোনো আদিখ্যেতা না দেখায়। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি একরকম নীরবেই প্রস্থান করেছেন। বিদায় মায়েস্ত্রো! অন্যেরা ভোলে ভুলুক কিন্তু আমরা পাঠকরা, যাদের কৈশোর আপনি রঙিন করে দিয়েছিলেন তারা কোনোদিনই আপনাকে ভুলব না!
 

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর রক ব হ স ন রক ব ভ ই র অন ব দ জনপ র য় ন আম র র জন য কর ছ ল বর শ ল প রক শ র একট বলত ন রহস য একদ ন প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

যৌনকর্মীদের কাছে কনডম নেই, এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি

যশোরের বাবুবাজার যৌনপল্লিতে প্রায় ১৫ বছর ধরে আছেন যৌনকর্মী আশা (ছদ্মনাম)। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কনডমের ব্যবহার সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা আছে। তবে ধারণা থাকলে কী হবে, সেই সুরক্ষাসামগ্রী এখন আর বিনা পয়সায় পাচ্ছেন না তিনি। বছর দুয়েক হলো এ সমস্যা। এখন কনডমের সংকট চরমে, জানান আশা।

যৌনপল্লিতে এখন খদ্দের অনেক কম বলে জানান তিনি। এরপর শুরু হয়েছে কনডমের সংকট। আশার কথা, ‘নিজির টাকায় কনডম কিনতি হয় বাইরের দোকান থেইকে। অনেক দাম দিতি হয়। কাস্টমারের বেশির ভাগই কনডম আনে না। আর আমার ঘরে কনডম না থাকলি কাস্টমার চলি যায়। কী আর করব, খাবার জোটাই মুশকিল। এখন কনডম কিনতি খরচ বেশি।’

খদ্দেরদের কাছে যদি কনডম না থাকে তখন এটা ছাড়াই যৌনকাজ করতে হয় বলে জানান আশা।

আশার মতো দেশের লক্ষাধিক যৌনকর্মী সুরক্ষা বা কনডমের স্বল্পতায় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন। এদিকে দেশে প্রতিবছর যৌনবাহিত রোগ এইডসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এই বাবুবাজার যৌনপল্লিতেই চলতি বছর একাধিক যৌনরোগবাহিত নারী যৌনকর্মীর সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার এক স্বাস্থ্যকর্মী।

গত সোমবার (১ ডিসেম্বর) পালিত হয়েছে বিশ্ব এইডস দিবস। চলতি বছর দিনটির প্রতিপাদ্য ছিল, ‘চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে, নতুনভাবে এইডস প্রতিরোধ গড়ে তোলা।’
নতুনভাবে এইডসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বললেও, সুরক্ষাসামগ্রীর অভাব এই রোগের ঝুঁকিতে থাকা লক্ষাধিক যৌনকর্মীকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। যৌনকর্মী, বিভিন্ন সংগঠন এবং বিশেষজ্ঞদের কথা, যৌনপল্লি এবং ভাসমান যৌনকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়ার কাজটি মূলত বেসরকারি সংগঠনগুলোই করত। মূলত এইচআইভি থেকে সুরক্ষায় এই কনডম দেওয়া হতো। এখন এ খাতে বিশেষত বৈদেশিক সহযোগিতা একেবারেই কমে গেছে। আর তাতে বাড়ছে এই নারীদের ঝুঁকি।

এই বাবুবাজার যৌনপল্লিতেই চলতি বছর একাধিক যৌনরোগবাহিত নারী যৌনকর্মীর সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার এক স্বাস্থ্যকর্মী।

বাড়ছে এইডস রোগ

চলতি বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১ হাজার ৮৯১ জন এইডস রোগের ভাইরাস এইচআইভিতে সংক্রমিত হয়েছেন। একই সময়ে দেশে এইডসে মারা গেছেন ২১৯ জন। গতকাল বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস ও এসটিডি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানা যায়।

এ সময় আরও বলা হয়, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বছর ২১৭ জন এইচআইভিতে সংক্রমিত হয়েছেন। আর দেশে এখন এইচআইভিতে সংক্রমিত ব্যক্তির মোট অনুমিত সংখ্যা ১৭ হাজার ৪৮০। বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইচআইভি (এইডসের ভাইরাস) পজিটিভ ব্যক্তি শনাক্ত হন। এরপর প্রতিবছর এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া গেছে। দু-এক বছর এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা কমে গেলেও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতাই ছিল বেশি। গত বছর (২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত) ১ হাজার ৪৩৮ জন নতুন করে সংক্রমিত হন। এ সময় এইডসে মারা যান ১৯৫ জন।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে আক্রান্তদের মধ্যে ৫২ শতাংশের বেশি বিবাহিত। আক্রান্তদের মধ্যে ৮১ শতাংশ পুরুষ।

দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায়। সেখানকার যৌনকর্মী মালিহা (ছদ্মনাম) দুই বছর ধরে এ পাড়ায় আছেন। এখানে আসার পর বিনা মূল্যে কনডম পেলেও এখন একেবারেই সেই সরবরাহ নেই বলে জানান তিনি।

যৌন রোগ বাড়ছে

যশোরের বাবুবাজার যৌনপল্লিতে পিএসটিসি নামের একটি সংগঠন যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য সহায়তা দেয়। তবে তাঁদের কনডম দেওয়ার কর্মসূচি এখন আর নেই। এ সংগঠনের কর্মী সালমা খাতুন জানিয়েছেন, যৌনকর্মীদের মধ্যে কনডম বিতরণের কর্মসূচি এখন প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নানা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এতে মেয়েরা নানা রোগ এবং গর্ভধারণের শিকার হচ্ছে।

চলতি বছর এ যৌনপল্লিতে ছয়জন নারী সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানান সালমা। গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের সংখ্যা ছয়। তিনি বলেন, ‘আগের বছর এ রকম কেস পাইনি। তবে এ বছর রোগ বাড়তিছে মেয়েদের মধ্যে।’

আগে পাড়াগুলোতে এনজিওদের কাজ ছিল। এখন তো কোনো কাজই নেই। মেয়েগুলো অসহায়। কনডম না থাকার কারণে বড় ঝুঁকি আছে।মোর্চা সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের সভাপতি নূর নাহার

দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায়। সেখানকার যৌনকর্মী মালিহা (ছদ্মনাম) দুই বছর ধরে এ পাড়ায় আছেন। এখানে আসার পর বিনা মূল্যে কনডম পেলেও এখন একেবারেই সেই সরবরাহ নেই বলে জানান তিনি।

দেশের যৌনকর্মীদের সংগঠনগুলোর মোর্চা সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ১১টি যৌনপল্লিতে ৪ হাজার ৫৩১ জন যৌনকর্মী আছেন। নেটওয়ার্কের সভাপতি নূর নাহার (রানু)। প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘আগে পাড়াগুলোতে এনজিওদের কাজ ছিল। এখন তো কোনো কাজই নেই। মেয়েগুলো অসহায়। কনডম না থাকার কারণে বড় ঝুঁকি আছে।’

ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে বড় ঝুঁকি

সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি যৌনকর্মী আছে ভাসমান। কনডমের সরবরাহ কমে যাওয়ায় যৌনপল্লিগুলোর চেয়ে এই ভাসমান যৌনকর্মীরা অনেক বেশি ঝুঁকিতে আছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনডম সরবরাহের হার এখন অনেক কমে গেছে। এখন হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান সরবরাহ দেয়। আগে যেখানে মেয়েরা ১০টি কনডম পেত, সেখানে এখন বড়জোর ৩টি পায়।কল্যাণময়ী নারী সংঘের সভাপতি রীনা বেগম

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় যৌনকাজ করেন মর্জিনা (ছদ্মনাম)। তিনি বলছিলেন, ‘এখন চেয়েচিন্তে কনডম নেওয়া লাগে। রাস্তার লোক তো কনডম রাহে না। আমাদেরই রাকতে অয়। কিন্তু আমরা কিনে কিনে কত দিন চালাব?’

ঢাকার ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে কল্যাণময়ী নারী সংঘ। এ সংগঠনের সভাপতি রীনা বেগম বলছিলেন, ‘কনডম সরবরাহের হার এখন অনেক কমে গেছে। এখন হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান সরবরাহ দেয়। আগে যেখানে মেয়েরা ১০টি কনডম পেত, সেখানে এখন বড়জোর ৩টি পায়।’

এইচআইভি থেকে সুরক্ষায় কমছে সহায়তা

জাতীয় পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে এখনো নিম্ন বিস্তৃতির দেশ হলেও গত কয়েক বছরে নতুন সংক্রমণ বাড়ছে। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী—যার একটি  অংশ যৌনকর্মী ও তাঁদের খদ্দের—তাঁদের মধ্যে সুরক্ষাহীন যৌন সম্পর্কই সংক্রমণ বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এইচআইভি বাড়লেও এ খাতে দেশে দাতাদের সহায়তা কমছে ব্যাপক হারে। এ চিত্র শুধু বাংলাদেশের না।

বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে ইউএনএইডসের ‘ওভারকামিং ডিসরাপশন: ট্রান্সফরমিং দ্য এইডস রেসপন্স’ নামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক স্তরে এইচআইভি খাতে সহায়তা কমে যাওয়ায় মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। জাতীয় এইডস ব্যয় মূল্যায়ন সম্পন্ন করা আটটি দেশের (বাংলাদেশ, বেলিজ, বেনিন, কোত দিভোয়ার, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউগিনি) তথ্য বলছে—বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন এ খাতে ৯৯ শতাংশ অর্থসহায়তা পায় দাতাদের কাছে থেকে। দেশের নিজস্ব উৎস থেকে পাওয়া সহায়তা মোট ব্যয়ের শূন্য দশমিক ১ শতাংশেরও কম।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক জুবাইদা নাসরিন বলেন, ‘যৌনপল্লিগুলোতে কনডম সরবরাহ কমে গেছে, তা জানি। এর মূল কারণ ইউএসএইডসহ দাতারা এ খাতে যে অর্থ দিতেন তা কমে গেছে। আমরা কিছু দাতা সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছি এ খাতে এগিয়ে আসতে।’

সরকারের পক্ষ থেকে কনডম বা লুব্রিকেন্টের যে সরবরাহ তাতে ঘাটতি নেই। যৌনপল্লি বা ভাসমানদের মধ্যে কনডমের সংকটের কথাটা শুনলাম।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এইচআইভি/এসটিডি) মো. খায়রুজ্জমান

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, দেশের ৩১টি ড্রপ-ইন সেন্টার থেকে নিয়মিত কনডমসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা হয়। তারা যৌনপল্লিতে সরবরাহের কাজ করে না। এটা কখনোই করা হতো না বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এইচআইভি/এসটিডি) মো. খায়রুজ্জমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কনডম বা লুব্রিকেন্টের যে সরবরাহ তাতে ঘাটতি নেই। যৌনপল্লি বা ভাসমানদের মধ্যে কনডমের সংকটের কথাটা শুনলাম।

এইচআইভি ও এইডস প্রতিরোধে বৈশ্বিক সহায়তা কমে যাওয়ার কারণেই যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অনেক বেশি উপক্ষিত এখন। এ ক্ষেত্রে সরকারের মনোযোগী হওয়াটা দরকার বলে মনে করেন গবেষক ডি এম অহিদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এইচআইভি–সংক্রান্ত কাজে গুরুত্ব ও অর্থায়ন নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। তরুণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন সংক্রমণ বাড়ায় বাংলাদেশকে তার প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ