রাজশাহীর চারঘাটের মুংলি গ্রামে সেলিম হোসেনের ইলেকট্রনিকস পণ্যের দোকান ছিল। ভালো ব্যবসা হচ্ছিল। কিছু জায়গাজমিও আছে। একতলা ছাদের বাড়ি। সচ্ছল পরিবার। কিছুদিন থেকে ধারকর্জ নিয়ে আর শোধ করতে পারছিলেন না। প্রায় ১৫ দিন আগে গভীর রাতে তিনি সপরিবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তিনি কোথায় আছেন, কেউ বলতে পারছেন না। আগামী ১০ এপ্রিল তাঁর ছেলের এসএসসি পরীক্ষা। সেটাও অনিশ্চিত।

এই গ্রামের আরও দুটি পরিবার একইভাবে দেনার দায়ে বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে গেছে। গ্রামের আরও বেশ কয়েকজন একইভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। উপজেলার কালুহাটি গ্রামের একজন পালিয়ে গেছেন, আরও অন্তত ১০ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বাঘা উপজেলার পীরগাছা গ্রামের একজন, মাঝপাড়া বাউসা গ্রামের একজন ও দিঘা গ্রামের একজন বাড়ির ফেলে পালিয়ে রয়েছেন বলে খোঁজ পাওয়া গেছে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, দিন দিন গ্রামে গ্রামে এই ধরনের ঋণগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। রাজশাহীর প্রায় প্রতিটি গ্রামে ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়া মানুষ পাওয়া যাবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সহউপাচার্য ফরিদ খান বলেন, তাঁদের বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্ষুদ্রঋণের ওপরে মাঠে কাজ করেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ঋণ দেওয়ার জন্য সংস্থা কর্মীদের একটা টার্গেট ধরিয়ে দেয়। এই টার্গেট পূরণের জন্য কর্মীরা ঠিকমতো যাচাই না করেই ঋণ দেন। আবার গ্রাহকেরা যে কারণ দেখিয়ে ঋণ নেন, সেটা আসলে করেন না। ফলে সময়মতো এই ঋণের টাকা আর পরিশোধ করতে পারেন না।

আবার গ্রাহকেরা যে কারণ দেখিয়ে ঋণ নেন, সেটা আসলে করেন না। ফলে সময়মতো এই ঋণের টাকা আর পরিশোধ করতে পারেন না।অধ্যাপক ফরিদ খান, সহউপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

গত মঙ্গলবার মুংলি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেলিম হোসেনের ইলেকট্রনিকসের দোকান ‘সেলিম স্টোর’ বন্ধ রয়েছে। বাজারের পেছনেই তাঁর বাড়ি। বাড়িতে তাঁর মা হোসনে আরা বেগমকে পাওয়া গেল। উঠানে বসে নাতির পোষা পাখিকে খাবার দিচ্ছিলেন। একা বাড়িতে আছেন, খাওয়াদাওয়া করছেন কীভাবে—জানতে চাইলে বললেন, পাশেই তাঁর মেয়ের বাড়ি। মেয়ের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করছেন। কাঁদতে কাঁদতে হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘একলা মানুষ কি এত বড় বাড়িতে থাকা যায়?’ ছেলে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর পাঁচ থেকে সাতজন টাকার জন্য এসেছেন। তাঁরা কেউ বলছেন পাঁচ লাখ টাকা পাবেন, কেউ বলছেন আট লাখ পাবেন। ছেলে তাঁকে এসবের কিছু বলে যায়নি। রাত একটার সময় চলে গেছেন।

একই গ্রামের মাইনুল ইসলামের একতলা ছাদের পাকা বাড়িতে গিয়ে দরজায় তালা লাগানো অবস্থায় পাওয়া গেল। তবে দরজায় বেসরকারি একটি সংস্থার একটি নোটিশ লাগানো রয়েছে। এতে তাঁর অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ লেখা রয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৮০ টাকা। নোটিশের নিচে সংস্থার জেলা ব্যবস্থাপকের স্বাক্ষর ও ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সংস্থাটির ব্যবস্থাপক মতিউর রহমান বললেন, ‘কোনো ঋণখেলাপি গ্রাহককে না পাওয়া গেলে তাঁর বাড়িতে এই নোটিশ লাগিয়ে দেওয়া হয়।’

একই গ্রামের উজ্জ্বল আলীর টিনশেডের পাকা বাড়ির সঙ্গে উজ্জ্বল ভ্যারাইটি স্টোর নামের দোকান ছিল। এখনো দোকানের সাইনবোর্ড আছে। প্রতিবেশী মাহাতাব হোসেনের স্ত্রী নাদিরা বেগম জানালেন, উজ্জ্বলের দুই ছেলে, এক মেয়ে। ছেলের বয়স ১৫ বছর হবে। মেয়ের বয়স ৮ বছর। কোলের ছেলের বয়স ৫ বছর হতে পারে। সংসারে স্ত্রী ও মা আছে। গত রমজানের পরে সবাইকে নিয়ে কখন চলে গেছেন, কেউ জানে না।

ঋণ নিয়ে ঋণচক্রে

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার কালুহাটিতে জুতার কারখানা করে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। তবে অনেকে ঋণ নিয়ে পথেও বসে গেছেন। সেই রকম একজন ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বাড়িতে এখন তাঁর বাবা-মা আছেন। তাঁরা বলতে পারেন না ছেলে কোথায় আছেন।

কালুহাটি বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, তাঁদের বাজারের অন্তত ১০ ব্যবসায়ী ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজনের আর ঋণ শোধ করার কোনো উপায় নেই। তাঁরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। উপজেলার মুংলি বাজারের একজন ব্যবসায়ী জানালেন, তাঁদের বাজারে কয়েকজন ঋণগ্রস্ত ব্যবসায়ী আছেন। তাঁরা বেকায়দায় রয়েছেন।

একটার টাকা দিয়ে আরেকটার কিস্তি দিতেই ঘাড়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দেনার বোঝা হয়েছে। আফজাল হোসেন, ঋণের দায়ে পলাতক

বাঘা উপজেলার পীরগাছা গ্রামের মারজুল হোসেন পেঁয়াজের আবাদ করতে গিয়ে লোকসান খেয়েছেন। ঋণ শোধ করতে না পেরে বছরখানেক আগে বউ-বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। মারজুলের এক প্রতিবেশী জানান, পেঁয়াজ চাষ করার জন্য মারজুল প্রথমে একটি বেসরসারি সংস্থা থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু পেঁয়াজের ফলন ভালো না হওয়ায় ঠিকমতো ঋণের কিস্তি দিতে পারেননি। পরে মায়ের একটা জমি ৭০ হাজার টাকায় ইজারা রাখেন। এই টাকা দিয়ে পরের মৌসুমে লাভের আশায় আরও বেশি করে পেঁয়াজ রোপণ করেন। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে সুদের ওপরে টাকা নেন। শেষ পর্যন্ত সংস্থার কিস্তি শোধ করতে পারলেও গ্রামের মহাজনের ঋণ আর শোধ করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। তাঁর মোট ঋণের পরিমাণ কত হয়েছে, তা জানা সম্ভব হয়নি। সেই সঙ্গে তাঁর মায়ের জমিটিও এখনো ছাড়ানো হয়নি।

দিঘা গ্রামের আফজাল হোসেন নামে ঋণগ্রস্ত পলাতক এক ব্যক্তির সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি জানান, প্রথমে একটি সংস্থা থেকে ব্যবসা করার জন্য ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। তাঁর এই ব্যবসা ভালো না চলার কারণে ঋণের কিস্তি ঠিকমতো দিতে পারেননি। ওই ঋণের কিস্তি দিতে পরে আরেকটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নেন। তারপরও ব্যবসা থেকে তিনি সেই টাকা তুলতে পারেননি। বাধ্য হয়ে পরে আশা থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নেন। একটার টাকা দিয়ে আরেকটার কিস্তি দিতেই শেষ পর্যন্ত তাঁর ঘাড়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দেনার বোঝা চাপে। তখনই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যান আফজাল। পাঁচ বছর আগের ঘটনা এটি। এখনো তিনি পালিয়ে আছেন। বাইরে কাজ করে ঋণ শোধ করার চেষ্টা করছেন। তিনি কোথায় আছেন, তা জানাননি।

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চারঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, এ বিষয়ে তাঁকে কেউ কিছু জানাননি। তবে যাঁর ছেলে পরীক্ষার্থী, এ বিষয়ে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। এ জন্য কারা ঋণ দিয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে জানতে পারলে সুবিধা হতো। তবু তিনি বিষয়টি দেখবেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ র ম র একজন উপজ ল র শ ধ করত ব যবস য় প র নন শ ধ কর র জন য ঋণ ন ন ঋণ ন য়

এছাড়াও পড়ুন:

সব্যসাচী কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন

প্রথিতযশা অধ্যাপক ও পরিসংখ্যানবিদ কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন সব্যসাচী মানুষ। তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তাঁর ঐতিহ্য শিক্ষার্থীদের ধারণ করতে হবে।

জ্ঞানতাপস কাজী মোতাহার হোসেনের ১২৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।

অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তৃতা, বৃত্তি, পদক, পুরস্কার ও সনদ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজক কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ এবং পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট।

অনুষ্ঠানে ‘যুগলের বন্ধন: কাজী নজরুল ইসলাম-কাজী মোতাহার হোসেন’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা দেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী। তিনি দুই বন্ধুর সম্পর্কের রসায়নের নানা দিক তুলে ধরেন।

প্রধান অতিথি বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, এই অনুষ্ঠানের দুটো প্রাপ্তি আছে। প্রথমত, মানুষের অবদান ও মেধাকে স্বীকার করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই উপমহাদেশের একজন প্রথিতযশা সব্যসাচী মানুষের ঋণ স্বীকার করা হচ্ছে।

কাজী মোতাহার হোসেন যেকোনো বিবেচনায় একজন দার্শনিক বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। প্রথম সারির পরিসংখ্যানবিদ, বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও তিনি অনেকগুলো সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রভাব বিস্তার করেছেন। একজন মানুষের ছোট জীবদ্দশায় এত গুণ সন্নিবেশিত করা কঠিন। কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেন।

সবাইকে নিয়ে চলা, প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, নিজের জগতের বাইরে নানা কিছুতে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঐতিহ্য কাজী মোতাহার হোসেন করে গেছেন বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, তাঁর সম্মানে যাঁরা আজ স্বীকৃতি পেলেন, তাঁরা এই ঐতিহ্যকে ধারণ করবেন। এটা (বিশ্ববিদ্যালয়) যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সে বার্তা দেবেন। যেসব শিক্ষার্থী সম্মাননা পাচ্ছেন, তাঁদের ছোট প্রোফাইল তৈরি করে ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মাজেদ বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন একজন সব্যসাচী মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞানের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে তাঁর পদচারণা ছিল না। তিনি দাবা খুব পছন্দ করতেন। দাবা খেলার কথা শুনলে তিনি ছুটে যেতেন। কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে তাঁর শোনা নানা গল্প তিনি স্মৃতিচারণা করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাফর আহমেদ খান বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন পরিসংখ্যান চর্চার পথিকৃৎ ছিলেন। বিজ্ঞান, দাবাচর্চারও পথিকৃৎ ছিলেন। এমন কোনো পুরস্কার নেই যে, তিনি পাননি। তাঁর দেখানো পথে যেন শিক্ষার্থীরা নিজেদের আলোকিত করতে পারেন।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রওনাক হোসেন। এই আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের সেরা শিক্ষার্থীদের বই, নগদ অর্থ ও সনদ তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গঙ্গাচড়ায় হিন্দুবাড়িতে হামলা ঠেকাতে ‘পর্যাপ্ত’ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি
  • নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ-আ.লীগ নেতা–কর্মীদের ‘গোপন বৈঠক’ ঘিরে গ্রেপ্তার ২২, সেনা হেফাজতে মেজর
  • দেশের চারজনের একজন বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার
  • ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ যাতে মাথাচাড়া দিতে না পারে
  • ডেঙ্গুতে দুজনের, করোনাভাইরাসে একজনের মৃত্যু
  • জাওয়াইদেহ বেদুইনদের মৌখিক সাহিত্য
  • রাবিতে আ.লীগ ট্যাগ দিয়ে চিকিৎসা কর্মীকে বিবস্ত্র করে মারধর
  • ইরানের সঙ্গে সংঘাত: ইসরায়েলকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা দিতে সৌদি সরকারকে অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র
  • সিরিজের শেষ ম্যাচে নেই স্টোকস, দায়িত্বে পোপ
  • সব্যসাচী কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন