Samakal:
2025-05-01@03:52:41 GMT

ক্ষমা কর ‘আছিয়া’

Published: 15th, March 2025 GMT

ক্ষমা কর ‘আছিয়া’

মাগুরার ধর্ষিত শিশুটির চলে যাওয়া আমাদের সমাজের ‘অধিকার সচেতন’ মানুষের জন্য তীব্র এক আঘাত যেন। একুশ শতকের সভ্য সমাজ নাকি প্রাগৈতিহাসিক যুগের শ্বাপদ পরিবেষ্টিত সমাজ, যেখানে আমাদের সন্তানরা বেড়ে উঠছে এক অজানা-অদেখা ভবিষ্যতের লক্ষ্যে। ‘আছিয়া’ তো একটি নামমাত্র, কিন্তু সে এ সমাজের বাস্তবতার অস্বস্তিকর একটা ছবি, যে সমাজে একটি শিশুও হয়ে ওঠে একটা ভোগ্যবস্তুমাত্র; যাকে যে কোনো বয়সী পুরুষ চাইলেই ধর্ষণ করতে পারে এবং ধর্ষণ করে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে নারী নির্যাতনের যতো ঘটনা ঘটেছে, তা আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের এক ভয়াবহ চিত্র। পথেঘাটে নানা অজুহাতে নারীকে হেনস্তা করা, নারীর পোশাক নিয়ে কটূক্তি করা, শরীরে হাত দেওয়া, কোথাও কোথাও ম্যুরাল পুলিশিংয়ের নামে বেধড়ক মারধর করা– এসব যেন নিতান্তই মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী ধর্ষণ, দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ এবং ধর্ষণ শেষে হত্যার ঘটনা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আজকাল পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের খবর; যা প্রজন্মের স্বাভাবিক মানস গঠনের জন্য বিরাট এক বাধা। 
প্রতিবাদে নারীরাও নেমে এসেছেন রাজপথে, তীব্রভাবে জানান দিচ্ছেন যথেষ্ট হয়েছে। চুপ থাকা নয়, আর সহ্য করা হবে না। সব বয়সী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারীর স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হচ্ছে রাজপথ। এমনকি প্রতিবাদ করতে গিয়েও তারা হেনস্তার শিকার হয়েছেন। নানা শ্রেণি-পেশার নারীরা কেন আজ এমন প্রতিবাদী? তারা কি জুলাই আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশ নেননি? তাদের অবদান ছাড়া এই আন্দোলন কি সফল হতো? কিন্তু আন্দোলনের পুরস্কার তারা কী পেল? রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তারা উপেক্ষিতপ্রায়। এমনকি পরিবর্তন আনার নামে নতুন যে দল গঠন করা হলো, তাতেও তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বরং টোকেনিজমের অংশ হিসেবে রাখা হয়েছে নারীকে; যা কিনা অপমানেরই নামান্তর। তাই বলা যায়, নারীর অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে; তাঁর মর্যাদার হানি করা হয়েছে। নারীর অসন্তোষ চাপা থাকেনি বরং নারীরা এর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছেন। নারীকে ‘সাইডলাইন’-এ রাখার বিষয়টি উদ্বেগজনক। কারণ এর পেছনে রয়েছে সেই পুরোনো রাজনীতি, যে রাজনীতিতে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। রয়েছে সেই চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, যে মানসিকতায় নারী তো নারী, একটি তিন বছরের শিশুও ভোগের বস্তু হয়ে যায়; তার আবার অধিকার কী? সমানাধিকার তো অনেক দূরের ব্যাপার। সমাজের উঁচু-নিচু সব স্তরের মানুষই আছে, যারা এই মানসিকতা ধারণ করে। গত বছরই ফেব্রুয়ারিতে চা শ্রমিকের মেয়ে গৃহকর্মী প্রীতি ওরাং ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল। ধর্ষক ছিল একটি ক্ষমতাধর পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক; যার বিরুদ্ধে আগেও শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ ছিল অথচ সে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। ভাবুন একবার, এই ধর্ষকের হাতেই কত কত নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের ভয়াবহ খবরগুলোর প্রকাশনার দায়িত্ব পড়েছিল। সত্যি ‘সেলুকাস’! 
সম্প্রতি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে, ফেব্রুয়ারি মাসেই ২৯১  নারী ও কন্যাশিশুর নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। কখনও দেখা গেছে, শিশুটির বয়স বড়জোর ৩ বা ৪ এবং ধর্ষকের বয়স ১৪। এ কেমনতরো বিকৃত অবক্ষয়! এমনকি ছেলেশিশু ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে চলেছে। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই দেশে ধর্ষণের মহোৎসব শুরু হয়ে গেছে যেন। প্রতি মাসে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অথচ প্রশাসনের কোনো নড়ন-চড়ন নেই; তারা বলছে অবস্থা নাকি আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। হ্যাঁ, ভালো তো হয়েছেই বটে; ‘আছিয়া’ দেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ার লিড নিউজ হয়েছে, তাকে দেখতে উপদেষ্টারা গেছেন হাসপাতালে যখন সে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, আর কয়েকজন উপদেষ্টা হেলিকপ্টারে করে মাগুরা গেছেন তার জানাজায় অংশ নিতে। ভাবা যায়, কোথাকার কোন ‘অখ্যাত আছিয়া’ সারেদেশের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। এমন ঘটনা না ঘটলে কেউ কি কখনও আছিয়াকে চিনত? কে চিনত কুমিল্লার সেই হতভাগী তনুকে, যদি সেনানিবাসের মতো সুরক্ষিত এলাকায় সে ধর্ষণ এবং হত্যার শিকার না হতো! হতভাগ্য মেয়েগুলো কেবল ধর্ষণ এবং হত্যার শিকার হয় আর পত্রপত্রিকা, ইলেকট্রনিক এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ‘নিউজ’ হয়ে যায়। না জানি আরও কত তনু, প্রীতি ওরাং আর আছিয়া এই ‘নিউজ’ হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছে।  
মাগুরার ‘আছিয়া’ সারাদেশের মানুষকে একটা তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভাসিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত চলেই গেল; তার জন্য শোক প্রকাশ করেই অনেকে ক্ষান্ত হয়নি। জানা গেছে, ধর্ষকের বাড়িঘর সব পুড়িয়ে দিয়েছে ‘সাধারণ ক্ষুব্ধ জনতা’। ক্ষোভের এই বহিঃপ্রকাশ একটা স্বাভাবিক বিষয়, কিন্তু সমাধান এভাবে আসে কি? ঠিক এই জায়গাটিতে আমাদের সবার একযোগে কাজ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কাজটি হলো, একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের লক্ষ্যে কাজ করা। 
এখানে একটু ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে, সামাজিক আদর্শ বা নিয়মের দোহাই দিয়ে নারীর অধিকার ক্ষুণ্ন করা মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই নামান্তর। সাংস্কৃতিক বিপ্লব হবে সেই বিপ্লব, যা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষের জন্য সমানাধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। যার যে ধর্ম পালন করার সে তা করবে, যে কোনো ধর্মই পালন করতে চাইবে না, সেই অধিকারও তার থাকবে। আমাদের মতো দেশে যেখানে ছয় বছরের শিশুকে বোরকা পরানো হয় পর্দা করানোর নামে, যে মেয়েটি হয়তো তার ধর্মান্ধ পিতামাতার ধর্মান্ধতার বলি হয়ে স্বাভাবিক আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠার সুযোগই পাবে না জীবনে, বরং হয়তো তার মা-বাবার মতোই অন্য কোনো ধর্মান্ধের নিপীড়নের শিকার হবে– সেই দেশে এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন হওয়াটা আরও বেশি দরকার। কারণ, উন্নত দেশগুলোয় নারীরা কী পোশাক পরল না পরল তাঁর দিকে মানুষ নজর দেয় না। তারা নারী-পুরুষ সমানে সমানে কাজ করে। কাজটাই মুখ্য, পোশাক নয়। কিছু ব্যতিক্রম নারী নির্যাতনের ঘটনা ছাড়া সেখানে নারীর অপদস্ত হওয়ার ঘটনা আমাদের মতো দেশের তুলনায় কম ঘটে। কারণ পোশাকই যদি নারীর মর্যাদার নিয়ামক হতো, তাহলে সেসব দেশের সি-বিচগুলোয় অবাধ ও নিয়মিত ধর্ষণ ঠেকানো যেত না, অথচ আমাদের দেশে মেয়েরা সি-বিচে সন্ধ্যায় কেন গেল, একা কেন গেল ইত্যকার নানা প্রশ্নে নারীকে অপদস্ত করা হয়। সঙ্গে জুটে যায় ধর্ষক মানসিকতার আরও অনেক পুরুষ। মনে রাখা দরকার, আজকের যে শিশুটি বস্তাবন্দি হয়ে জীবন কাটানোর চর্চার মধ্যে চলে গেল, একদিন সেও অন্য নারীকে বস্তাবন্দি অবস্থায়ই দেখতে চাইবে। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা এ বিষয়টিকে চিরস্থায়ী করতে চায় তার নিজের সুবিধার জন্য, নিজের আরাম-আয়েশ ও ভোগবিলাসের জন্য। 
নারীকে তাঁর মর্যাদা রক্ষায় নিজেকেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে, নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হবে। শিক্ষা, বাসস্থান, চাকরি কিংবা ব্যবসা, চিকিৎসা, ভ্রমণ ইত্যাদিতে তাঁর নির্বিঘ্নে কাজ করে যাওয়া এবং চলাচলের পরিবেশ আদায় করে নিতে হবে। 
আরেকটি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে– আর তা হলো, শাহবাগ আন্দোলনে যুক্ত নারীদের গায়ে নাকি দুর্গন্ধ, তারা নাকি গোসল করে না। বিষয়টার উল্লেখ এ কারণেই করা, এটাও সেই হীনপুরুষতান্ত্রিক নারীবিদ্বেষী রুচিহীনতা; যেখানে নারীকে হেয়প্রতিপন্ন করাতেই তাদের অগাধ সুখ। তারা ভুলে যায়, ঝাঁ-চকচকে পোশাকগুলো গায়ে দিয়ে তারা নারী-বিদ্বেষের বমি করে যাচ্ছে, সেই পোশাক প্রস্তুতের পেছনে আছে অজস্র নারী শ্রমিকের ঘাম। আজ পোশাকশিল্পের চরম দুর্গতির সময়ে যখন অনেক শিল্পকারখানা ধ্বংসের মুখে, লাখ লাখ নারী শ্রমিক বেকার, শ্রমের বিনিময়ে তাদের জীবন ধারণ করার স্বাভাবিক সময়টা অনুপস্থিত– সেই পোশাক শ্রমিকদের বেঁচে থাকার উপায় নিয়ে তাদের মুখে কোনো কথা নেই। তাহলে কীভাবে এসব নারী বেঁচে থাকবেন? তারা এটাও ভুলে যাচ্ছে, যে মা তার জন্য রান্না করতে, তার কাপড় ধুতে, সারাদিন সংসারের সবার চাহিদা মেটাতে গলদঘর্ম হচ্ছেন, সেই মায়ের শরীরেও ঘাম হয়। আমরা চাই, আমাদের ছেলেমেয়েরা সবাই মানুষের মতো করে বেড়ে উঠুক, ধর্ষক হয়ে এবং ধর্ষকের সমর্থনকারী হয়ে বেড়ে না উঠুক।
একজন নারী যদি মনে করেন তিনি একা থাকবেন এবং তাতেই তিনি স্বচ্ছন্দ, তার এই একা থাকার অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। পুরুষের পোশাক নিয়ে সাধারণত নারীরা মন্তব্য করেন না, নারীর পোশাক নিয়েও মন্তব্য করা, তার ওপর হামলে পড়ার অধিকার কোনো পুরুষ বা কারোরই নেই। নারীর ওপর যে কোনো অজুহাতে যদি কেউ আক্রমণ করে, তবে তাকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এখন দেখার পালা, রাষ্ট্র আমাদের দেশটিকে আদৌ নারী ও শিশুর জন্য নিরাপদ করতে চায় কিনা। 
সে ক্ষেত্রে এমন একটি স্লোগানই হয়তো বর্তমান সমাজের জন্য প্রযোজ্য– ‘যদি না থাকে নারীর সম্মান/জাতির তাতে ঘোর অপমান।’ v
লেখক: সমন্বয়ক, সাংগাত বাংলাদেশ

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আম দ র ক জ কর র জন য র জন ত র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার শ্রমজীবী মানুষ

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ। আশির দশকজুড়ে তিনি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও এবং আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন-আইটিইউসিতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি। বর্তমানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসেরও নির্বাহী পরিচালক। মহান মে দিবস উপলক্ষে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুর রহমান তপন

সমকাল: গত বছর মে দিবসে সমকালে আপনার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। এর পর এক বছর কেটে গেল, এই সময়ে দেশের শ্রমিকদের জীবনে কোনো পরিবর্তন দেখতে পেয়েছেন?

সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: প্রথমেই বলব, এ বছর আমরা একেবারে ভিন্ন এক পরিবেশে মে দিবস পালন করছি। মে দিবসের শিক্ষা হলো, একটি রাষ্ট্রে জাতীয়ভাবে যদি গণতন্ত্র চর্চা না হয়, রাষ্ট্রের অভিপ্রায় যদি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন না হয়, তাহলে শ্রমিকরা তার ন্যায্য হিস্যা পাওয়া দূরের কথা, ন্যায্য হিস্যার দাবিও করতে পারেন না। ৫ আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রক্ষমতায় যে পরিবর্তন এসেছে, তার ফলে আমরা বর্তমানে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখছি। সে হিসেবে বর্তমানে আমরা একটি মৌলিক পরিবর্তনের মধ্যে আছি। আরেকটি বিষয় হলো, এবারই প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি শ্রম সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। সে কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে মে দিবসের ৯ দিন আগে। এ দুটি বিষয় যদি আমরা বিবেচনায় রাখি, তাহলে এবারের মে দিবসের একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে।

একই সঙ্গে কিছু দুঃখজনক ঘটনাও এ সময়ে ঘটেছে। জুলাই আন্দোলনে ছাত্রদের পরই ছিল শ্রমিকের অংশগ্রহণ। বহু রিকশা রীতিমতো আহত-নিহতদের হাসপাতালে নেওয়ার অ্যাম্বুলেন্সে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনের পর শ্রমিকদের আবারও সেই পুরোনো বহু সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে। কারখানা বন্ধ, বকেয়া মজুরি না পাওয়া, ঈদের সময় বেতন-বোনাস বঞ্চনা, এগুলো চাইতে গিয়ে রাস্তায় আবারও গুলি খাওয়া ইত্যাদি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। 

আশা করা হয়েছিল, রাজনৈতিক পালাবদলের পর শ্রমিকরা তাদের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে অন্তত বাধার সম্মুখীন হবেন না। কিন্তু এখনও বহু শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অনেকে জেলে আছেন। এটি অবশ্য আবারও দেখিয়ে দিল, শ্রমিকদের রাষ্ট্রক্ষমতার বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে, যা মে দিবসেরই শিক্ষা। শ্রমিক শ্রম দিয়েছেন, তিনি তাঁর পাওনাটা চান। ওই পাওনা যিনি দিচ্ছেন না, আইনের দৃষ্টিতে তিনি অপরাধ করছেন। অথচ এখানে শ্রমিককে অপরাধী সাব্যস্ত করা হচ্ছে পাওনা দাবি করার জন্য। এই দুই ধরনের বাস্তবতাই এবারের মে দিবসে আমরা দেখছি।

সমকাল: এমন বাস্তবতায় শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো কী ভাগ্য হতে পারে?

সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: যে আন্দোলনের ফল হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার এবং শ্রম সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, তার মূল কথা ছিল বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। বিদ্যমান রাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার শ্রমজীবী মানুষ। এ বৈষম্য হ্রাসের দায় আছে বর্তমান সরকারের। তাই তারা আন্তরিকভাবেই চেয়েছে যে কমিশন ভালো কিছু সুপারিশ করুক। 

সমকাল: আপনি বলছেন, শ্রম কমিশনের সুপারিশগুলো বেশ মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে?

সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: সুপারিশগুলো তৈরি করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, ১৯৭১ সালের  মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান– এই তিনটির নির্যাস হলো, একটি মর্যাদাকর বাংলাদেশ চাই, বৈষম্যহীন সমাজ চাই এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ চাই। আর এগুলোই মে দিবসের চেতনা। আপনি দেখবেন, মে দিবস সৃষ্টির পর যেসব আন্তর্জাতিক কনভেনশন বা সনদ হয়েছে– জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা, আইএলওর প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি– সবক’টিতেই ওই আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। তাই ওই তিনটি বিষয়কে আমরা সুপারিশের ভিত্তি ধরেছি। সেটা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, সাড়ে সাত কোটি শ্রমজীবী মানুষ পরিষ্কার দুই ভাগে বিভক্ত। একটি অংশের– যারা মোট শ্রমিকের ১০-১৫ শতাংশ– মোটামুটি আইনি সুরক্ষা আছে, তারা ভোগ করতে পারুক না-পারুক। বাকি ৮৫-৯০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে, তাদের কোনো আইনি সুরক্ষা নেই, শ্রমিক হিসেবেই স্বীকৃত না তারা। এই বৈষম্য আমরা বিবেচনায় নিয়েছি। 

আরেকটি বড় বিষয় হলো, আয়বৈষম্য। কিছুদিন আগে সমকালেই গত সাত মাসে কোটিপতি বাড়ার খবর দেখেছি। আবার বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলমান অর্থবছরে নতুন ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের কবলে পড়বে। এগুলোর উত্তর হলো, একটি মর্যাদাকর মজুরির নিশ্চয়তা। এ জন্যই আমরা জাতীয় ন্যূনতম মজুরির সুপারিশ করেছি, যা হতে হবে মর্যাদাকর জীবনের নিশ্চয়তাদানকারী, যেনতেন হলে চলবে না।

সমকাল: প্রাতিষ্ঠানিক খাতের মজুরিই তো পুরো কার্যকর হয় না। সেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কীভাবে কার্যকর করা যাবে?

সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: জাতীয় ন্যূনতম মজুরির দাবি আমাদের শ্রমিক আন্দোলনে অনেক পুরোনো। আমরা মনে করি, সস্তা শ্রম আমাদের রপ্তানি পণ্যকে প্রতিযোগিতাসক্ষম করছে– এ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাকে এত টাকা মজুরি দিলেই চলবে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আর কিছু করতে হবে না। এ মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ফলে মজুরির বিষয় শুধু শ্রমিকের নয়, সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সমকাল: অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে তো সরকার এখনও আয়করের আওতায়ই আনতে পারেনি, সেখানে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কার্যকর করা যাবে?

সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: বিষয়টি জটিল, সন্দেহ নেই। কারণ জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কিন্তু শুধু অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, পারিবারিক ও ব্যক্তিগতভাবেও যে শ্রমিক যেমন– গাড়িচালক, গৃহকর্মী খাটানো হয়, তাদের জন্যও প্রযোজ্য হবে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে যে বিশালসংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ হয়, তারাও পড়বে এর আওতায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যদি একটি বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ চাই, তাহলে প্রথমেই সবার জন্য একটি মর্যাদাকর জীবন নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে মর্যাদাকর মজুরি অপরিহার্য।

সমকাল: আপনারা শ্রমঘন শিল্পের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। কিন্তু শিল্পে অটোমেশন অনিবার্য। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কীভাবে করা হবে?

সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: আমরা যদি মে দিবসের চেতনা অনুসারে ৮ ঘণ্টা কাজের বিধান মেনে চলি, একজনকে অতিরিক্ত খাটিয়ে মুনাফা করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসি, তাহলে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মুনাফার পাশাপাশি শিল্পেরও বিকাশ নিশ্চিত করতে পারি। এখানে অটোমেশন কোনো সমস্য নয়। আমাদের এখানে এক সুয়ারেজ লাইন পরিষ্কার করতে গিয়ে বছরে বহু লোক মারা যায়। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশে কাজটা হয় যন্ত্রের মাধ্যমে, আপনি চাইলেও শারীরিকভাবে তা করতে পারবেন না; ওদের সিস্টেম এমনভাবেই তৈরি। যে যন্ত্র মানুষের কাজ করবে সেই যন্ত্র তৈরির জন্যই তো মানুষ লাগবে। আমাদের বিশাল কৃষি খাত পড়ে আছে, কৃষিভিত্তিক শিল্পের সম্ভাবনা বিশাল। উদ্যোক্তা, দক্ষ জনশক্তি ও প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটালে আমি মনে করি, আমরা বিশ্বে অন্যতম শিল্পশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারি।

সমকাল: আপনারা ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা সহজ করার সুপারিশ করেছেন, যেখানে মালিক তো বটেই, নাগরিক সমাজেও ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে একপ্রকার ভীতি আছে। অনেকে মনে করেন, শিল্পের বিকাশে তা অন্তরায়। আপনাদের অবস্থান একটু ব্যাখ্যা করবেন?

সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: এ ভয় ট্রেড ইউনিয়নের নামে কিছু ব্যক্তির নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকে জন্ম নিয়েছে, সত্যিকার ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা থেকে নয়। আমরা যে মর্যাদাকর মজুরির কথা বলি, মজুরি বৈষম্য অবসানের কথা বলি, তা নিশ্চিত হওয়ার অন্যতম শর্ত শ্রমিক ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথভাবে তাঁর দাবি জানানোর সুযোগ পান কিনা। একটি শিল্প ইউনিটে উদ্যোক্তার মতো শ্রমিকও অপরিহার্য। কিন্তু এখানে পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে। এ দ্বন্দ্ব নিরসনের প্রক্রিয়া হিসেবেই ট্রেড ইউনিয়নের ধারণা এসেছে। আজকে শিল্পে যে বিশৃঙ্খলা আমরা দেখি, তার প্রধান কারণ ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ সংকুচিত হওয়া। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রশাসনের সঙ্গে হৃদ্যতা ছাড়া আজকে ট্রেড ইউনিয়ন করা খুব কঠিন। এর গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা পূরণ করা সুস্থ ট্রেড ইউনিয়নপন্থি কারও পক্ষে সম্ভব নয়। যেমন– একটি কারখানায় ৫০ হাজার শ্রমিক থাকলে তার ১০ শতাংশের সমর্থন যদি একটি সংগঠনের নিবন্ধন পেতে লাগে, তাহলে ৫ হাজার শ্রমিক কে জোগাড় করতে পারবে? ট্রেড ইউনিয়ন গড়া সহজ হলে সৎ, দক্ষ ও আন্তরিক মানুষ শ্রমিক আন্দোলনে আসবেন। ফলে একটি সুস্থ ধারার ট্রেড ইউনিয়ন অনুশীলন সম্ভব হবে। 

সমকাল: শেষ কথা হিসেবে কিছু বলবেন?

সুলতান উদ্দিন আহম্মদ: আমরা সুপারিশ করতে গিয়ে কোনোভাবেই শ্রমিককে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি বা শিল্পনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখিনি। শ্রমিকের কল্যাণকে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখিনি। উদ্যোক্তাদের সমস্যা আমরা জানি। সবাইকে যুক্ত করে একটি সমন্বিত নীতি ও কৌশল প্রণয়নের পক্ষে আমরা কথা বলেছি। মালিক ও শ্রমিকের সমস্যাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে আমরা শিল্পের সমস্যা সমাধান করতে পারব না। দেশও এগোবে না। এটিই আমাদের মূল বক্তব্য।

সম্পর্কিত নিবন্ধ