‘সেনাবাহিনী ভূমিকা না রাখলে গণঅভ্যুত্থান সফল হত না’
Published: 25th, March 2025 GMT
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন বলেছেন, “সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করছে। জুলাই-আগস্টে যদি সেনাবাহিনী ভূমিকা না রাখত তাহলে গণঅভ্যুত্থান সফল হত না। এখন সেই সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি করার চক্রান্ত শুরু হয়েছে।”
সোমবার (২৪ মার্চ) যশোর শহরের একটি অভিজাত হোটেলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের স্মরণে আয়োজিত আলোচনা ও ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
রাশেদ খাঁন বলেন, “একটি পক্ষ সেনাবাহিনীকে উস্কানি দিয়ে এক এগারো তৈরির চক্রান্ত করছে। জনগণকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করা হচ্ছে। এই চক্রান্তের সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা জড়িত। তাদের বিষয়ে আমার সজাগ থাকতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব অনেক। এই সরকার যদি গণহত্যার বিচার সঠিকভাবে করতে না পারে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে না পারে তাহলে গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। এই মুহূর্তে সব রাজনৈতিক দল একতাবদ্ধ হয়েছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের ব্যাপারে। আমরা যারা রক্ত দিয়েছি, আন্দোলন করেছি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাদরে বক্তব্য হল- আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচন কেন, বাংলার মাটিতে আর কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নিতে পারবে না।”
রাশেদ খাঁন বলেন, “যে ছাত্রনেতারা আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রাখল তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ আসছে। শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের না, রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ। আমরা কেউ আওয়ামী লীগ হব না। আমরা যদি আওয়ামী লীগের মতো চাঁদাবাজি, অত্যাচারে লিপ্ত হই তাহলে বাংলাদেশের মানুষ আমাদেরকেও প্রত্যাখান করবে।”
গণঅধিকার পরিষদ যশোর জেলা শাখার সভাপতি এ বি এম আশিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, গণঅধিকার পরিষদের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আশিক ইকবাল ও যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু।
ঢাকা/রিটন/মাসুদ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গণঅভ য ত থ ন আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কারের একাল-সেকাল
ওয়ান-ইলেভেনকালে জরুরি অবস্থার গর্ভে জন্ম নেওয়া সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়ও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে ‘সংস্কারের জিগির’ তোলা হয়েছিল। সে সংস্কারের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা, যা ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ হিসেবে চিহ্নিত।
দল দুটির যেসব নেতা ওই তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তারা ‘সংস্কারপন্থি’ হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত হন। এক পর্যায়ে ‘সংস্কারপন্থি’ শব্দটিই রাজনৈতিক গালিতে পরিণত হয়।
সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। ২০০৭ সালের নিন্দিত ‘সংস্কার’ ২০২৪ সালে এসে নন্দিত ‘সংস্কার’ হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, লন্ডভন্ড নির্বাচন ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে আর যাতে কোনো দল সরকারে গিয়ে আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার ‘প্রয়োজনীয়’ সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া হবে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায় এবং এ জন্য পর্যাপ্ত সময় ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
ধারণা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানকে গণমুখী করা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর শক্তিশালী করতে বিধিবিধান পরিবর্তনের মধ্যেই সংস্কার কার্যক্রম সীমিত রাখবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অস্ত্রোপচার করে রাষ্ট্রের আকার-আকৃতি, চেহারা-সুরত পাল্টে দেওয়ার এক মহাযজ্ঞের সূচনা করেছে। গঠন করেছে ছোট-বড় ১১টি সংস্কার কমিশন: সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, পুলিশ, জনপ্রশাসন, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য খাত, শ্রম, নারীবিষয়ক, স্থানীয় সরকার এবং গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। আবার এসব বিষয়ে যাতে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠিত হয় সে জন্য গঠন করা হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’।
সন্দেহ নেই, জাতীয় স্বার্থে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। সাধারণত প্রয়োজনের নিরিখে সে ঐক্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার প্রয়োজনে। এবারও দেশকে আক্ষরিক অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে এমনিতেই জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। সে জন্য আলাদা কমিশন গঠন করার প্রয়োজন কেন হলো, বোধগম্য নয়।
গঠিত ১১টি কমিশনের বেশ কয়েকটি তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে সরকারের কাছে। সেসব প্রস্তাব নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রস্তাবগুলোর কিছু বিষয়ে সবাই একমত হলেও অধিকাংশ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। বিশেষত একই ব্যক্তি দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বা একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা না হওয়ার যে প্রস্তাব সংস্কার কমিশন করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এসব সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর হাত-পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার শামিল। কেননা, একটি দল সরকারে গেলে সরকারপ্রধান, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান কে হবেন বা থাকবেন, সেটা সংশ্লিষ্ট দলের গঠনতান্ত্রিক বিষয়। রাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশন প্রণীত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ দ্বারা রাজনৈতিক দলগুলো এখন নিয়ন্ত্রিত। নতুন করে রাজনৈতিক বিধিবিধান গণতন্ত্র বিকাশে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে গত ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যে রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টা বরাবর পেশ করেছে, তা নিয়ে আপত্তি তুলেছে কয়েকটি সংগঠন। ১৫টি মূল বিষয়সহ ৪৩৩টি প্রস্তাবনার একটিতে জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য মোট আসন ৬০০ করে ৩০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। নারীদের জন্য সংসদে আসন সংরক্ষিত রাখার সুপারিশকে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক মনে করছেন অনেকে। কেননা, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বিলোপের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনই পরবর্তী সময়ে রূপ নিয়েছিল গণঅভ্যুত্থানে।
এটা বলা অসমীচীন নয়, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্তরে কোটা পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সে প্রত্যাখ্যাত কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের সুপারিশ নারী কমিশন কেন করল, বোধগম্য নয়। তা ছাড়া এ ধরনের কোটা নারীদের জন্য অবমাননাকর নয় কি? জাতীয় সংসদে নারীদের কোটায় আবদ্ধ রাখার অর্থ তাদের অনগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত করা। অথচ আমাদের দেশের নারীরা এখন রাষ্ট্র ও সমাজের নানা ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে আমাদের গ্রামের মাথার বাস স্টপেজকে কেন্দ্র করে একটি ছোট্ট বাজার গড়ে উঠেছে। সেখানে আজিমের চায়ের দোকানে প্রায়ই আড্ডা জমে। ঢাকা থেকে গেলে আমিও অংশীজন হই। সেদিনও সে আড্ডায় অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছিল। কবে সংস্কার শেষ হবে, কবে নির্বাচন হবে– তা নিয়ে একেকজন তাদের জ্ঞানগর্ভ অভিমত ব্যক্ত করছিলেন। এরই মধ্যে কলেজপড়ুয়া এক কিশোর ফোড়ন কেটে বলল, এর পর হয়তো সরকার ‘জাতিসংঘ সংস্কার কমিশন’ গঠন করে বলবে, নির্বাচন ওই সংস্কারের পর। ছেলেটির কথায় হাসির ফোয়ারা ছুটল আসরে। কারও কারও কাপ থেকে ছলকে পড়ে গেল কিছুটা চা।
মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক