মায়ের সঙ্গে আর দেখা হলো না, বাড়ির কাছে এসে ডুবল নৌকা
Published: 30th, March 2025 GMT
৬ দিন আগে ভাইয়ের বাড়িতে (মধ্যনগর গ্রামে) বেড়াতে যান বিউটি চক্রবর্তী (৫০)। তাঁর ছেলে প্রণয় চক্রবর্তী মামার বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করেন। তিনিই মাকে নৌকায় তুলে দেন। নৌকায় মাকে তুলে দেওয়ার সময় প্রণয় বলেছিলেন, ‘সাবধানে যাও, আমি ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাবো।’ আর বাড়ি ফেরা হলো না বিউটি চক্রবর্তীর, মায়ের সাথে আর দেখাও হলো না ছেলের। বাড়ির কাছাকাছি এসে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারান বিউটি চক্রবর্তী।
শনিবার (২৯ মার্চ) সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে যাত্রীবাহী নৌকাডুবির ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ৪ জনের মৃত্যু হয়। উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের বৌলাই নদীতে এ নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। প্রাথমিকভাবে ৫ জনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধারের কথা পুলিশ জানালেও পরে একজনের জ্ঞান ফেরে।
নিহত ৪ জন হলেন নোয়াপাড়ার বিউটি চক্রবর্তী (৫০), মোহনগঞ্জের হাতনি গ্রামের কল্পনা সরকার (৪৫), কলমাকান্দা উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের সুজিত সরকারের পাঁচ বছরের শিশু কন্যা গঙ্গা সরকার (৫) ও মোহনগঞ্জের হাতনি গ্রামের রুদ্রা সরকার (৬)।
এদিকে নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার হাতনি গ্রামের নিরদ সরকারের ছেলে নিরব সরকারকে (১০) সিলেট ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে।
বিউটি চক্রবর্তী মধ্যনগরে ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন জানিয়ে তার স্বামী তাপস চক্রবর্তী বলেন, মধ্যনগরে আমার ছেলে প্রণয় চক্রবর্তী তাকে (বিউটি চক্রবর্তী) নৌকায় তুলে দেয়। রাতে হঠাৎ খবর পাই নৌকাডুবি হয়েছে। তাৎক্ষণিক ছুটে যাই, গিয়ে দেখি সব শেষ। লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরেছি, ছেলেও খবর পেয়ে মধ্যনগর থেকে ছুটে এসেছে। রাতেই দাহ সম্পন্ন হয়েছে।
ছেলে প্রণয় চক্রবর্তী বলেন, আমিই মাকে নৌকায় তুলে দিয়েছি। এরপর আর কিছু বলতে পারলেন না প্রণয়। মা হারানোর শোকে কন্ঠরোধ হয়ে যায় তার।
নৌকার যাত্রী লিপটন তালুকদার বলেন, নৌকার মধ্যে আমি ও আমার স্ত্রী ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ নৌকার মাঝির এক সহকারী আমাকে বলেন, ‘এই লিপটন তাড়াতাড়ি ওঠ, নৌকা ডুবে যাচ্ছে।’ ওঠে বসতে বসতে নৌকা তলিয়ে যায়। জানালা দিয়ে আমার স্ত্রীকে নিয়ে বের হয়ে রক্ষা পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, ৬০-৭০ জন যাত্রী ছাড়াও নৌকার মধ্যে টিন, সিমেন্ট, ধান, কাঠসহ নানা জিনিসপত্র বোঝাই ছিলো।
জামালগঞ্জ থানার ওসি মো.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা
বছর পাঁচেক আগেও ধান কাটার শ্রমিকেরা বৈশাখ মাসের অপেক্ষায় থাকতেন। বৈশাখে হাওরের বুকজুড়ে সবুজ ধান যখন সোনালি রঙ ছড়াতে শুরু করে, তখন থেকেই দূরদূরান্ত থেকে হাওরে আসতে থাকেন ধান কাটার শ্রমিকেরা। কিন্তু, এই চিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। হাওরের কৃষক এখন ধান কাটার জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেন। ফলে কৃষকের শ্রম এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হচ্ছে। তবে, কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কৃষি শ্রমিকেরা। বাধ্য হয়ে তারা পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।
তিন বছর হলো ধান কাটার পেশা ছেড়েছেন মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের মো. মকবুল মিয়া। এখন তিনি সারাবছর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান।
আরো পড়ুন:
খুলনার বরফশ্রমিক
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি
ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত
মকবুল মিয়া বলেন, ‘‘আগে বছরের ছয় মাস বর্ষায় নৌকা বাইতাম, আর হুগনা সিজন আইলে নিজের জমি চাষ করতাম, আবার মাইনষের জমিতেও কামলা দিতাম। যা আয় অইতো তাই দিয়া আমরার ছয়জনের সংসার চইল্যা যাইতো। কিন্তু, যহন থেইক্যা নতুন নতুন মেশিন হাওরে আইতাছে, তহন থেইক্যা আমরার আর বেইল নাই।’’
‘‘কেউ আর আমরারে আগের মতন দাম দেয় না। কাম করলেও ঠিকমতো টেহা পাই না, তাই পুষায় না,’’ বলেন এই কৃষিশ্রমিক।
মকবুলের মতো ধান কাটা, মাড়াই, রোদে শুকানো, ঝাড়া, কাঁধে বহন করার মতো স্বাধীন পেশা ছেড়েছেন অষ্টগ্রামের ফয়জুল, ইটনার শামছুল মিয়া, নিকলীর ফরিদ উদ্দিনসহ অসংখ্য শ্রমিক। এক সময় যারা এ পেশায় দলবেঁধে কাজ করতেন, এখন দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। ধান কাটার পেশা বদলে তারা এখন কেউ রিকশাচালক, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ চটপটি-ফুচকার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
তারা বলছেন, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির গতির সঙ্গে তারা কখনো তাল মেলাতে পারবেন না। কৃষকরাও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন না। বেশি জমি যাদের আছে তারাও আধুনিক পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। যে কৃষক অল্প জমিতে চাষাবাদ করেছেন, তারাও আর পয়সা খরচ করে কৃষিশ্রমিকের ওপর নির্ভর করছেন না। তারা পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিচ্ছেন। ফলে খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা পড়েছেন বিপাকে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা জমির ধান কাটতে প্রচুর সময় লাগে। ফসল কাটার পরে বহন ও মারাই করা, তারপর বস্তায় সংরক্ষণ করার জন্যও অনেক শ্রমিকের দরকার। এটুকু ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিকের সারা দিনের কাজ। তার জন্য মজুরি গুনতে হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু, এ কাজে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করলে সময় এবং অর্থ দুটোই কম লাগে।
বৈশাখে বর্ষার পানি ও বৈরী আবহাওয়া না থাকায় কৃষকেরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন। বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে ঝড়-তুফান শুরু হলে পাকা ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে তারা যে পদ্ধতিতে ধান কাটা সহজ এবং দ্রুত হয় সেই পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার পুরো জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওর এলাকাতেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ভালো হওয়ায় এই ধান থেকে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। ধান কাটতে এ বছর হাওর অঞ্চলে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। এই সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধান কাটতে কৃষক কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ ৪১৩টি ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহার করছেন।
জেলা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ উদ্দিন বলেন, ‘‘মানুষের পেশা পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়। কিন্তু, কৃষি এমন একটা পেশা, যারা এ পেশা রপ্ত করেছেন তাদের জন্য নতুন পেশায় আসা খুব কঠিন। বর্তমানে কৃষিকাজে যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে কৃষিশ্রমিকেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।’’
‘‘শুধু কৃষিতেই নয়, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে,’’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারকেই সুদৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান, মাঠে যদি কৃষক ও শ্রমিক ন্যায্য শ্রমমূল্য না পান, তাহলে কৃষিও একদিন হুমকির মুখে পড়বে।’’
ঢাকা/তারা