জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আত্মপ্রকাশের আগে আলোচনায় এসেছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক দুই নেতা আলী আহসান জুনায়েদ ও রাফে সালমান রিফাত। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের উদ্যোগে গঠিত এনসিপিতে তাঁরা শীর্ষ পর্যায়ের পদে থাকতে পারেন, এমন আলোচনা চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা নতুন এই দলে যোগ দেননি। গত মাসে রোজার সময় তাঁরা নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

রোজা ও ঈদুল ফিতরের পর এখন তাঁরা জানাচ্ছেন, তাঁদের নতুন প্ল্যাটফর্মের নাম হবে ‘ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ’ (আপ বাংলাদেশ)। এই প্ল্যাটফর্মের প্রস্তাবনায় ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ, ধর্মবিদ্বেষ ও দুর্নীতি—এই চার রাহুগ্রাস’ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার অঙ্গীকার থাকবে বলে জানিয়েছেন এর প্রধান উদ্যোক্তা আলী আহসান জুনায়েদ। চলতি এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে আপ বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক এই সভাপতি। এর আগে রোজার সময় গত ১৬ মার্চ জুনায়েদ ও রাফে সালমান ফেসবুকে নতুন এই প্ল্যাটফর্মের কথা জানিয়েছিলেন। এর কিছুদিন আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি এনসিপির আত্মপ্রকাশ ঘটে, যেখানে যোগ দেওয়ার আলোচনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত যোগ দেননি সাবেক এই দুই শিবির নেতা।

আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে নতুন প্ল্যাটফর্মের বিষয়ে ‘ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের প্রধান উদ্যোক্তা’ পরিচয় দিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন আলী আহসান জুনায়েদ। এতে তিনি লিখেছেন, ‘জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে গঠিত হতে যাওয়া আসন্ন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের নাম আমরা ঠিক করেছি ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ)। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বলতে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি, যেটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশের আপামর ছাত্র–জনতাকে সঙ্গে নিয়ে প্ল্যাটফর্মটি এগিয়ে যাবে, ইনশা আল্লাহ। রাজনীতিতে পেশিশক্তির দাপট, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির যে বৃত্ত, দীর্ঘ মেয়াদে আমরা তা উপড়ে ফেলতে চাই। ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ, ধর্মবিদ্বেষ এবং দুর্নীতি—এই চার রাহুগ্রাস থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার অঙ্গীকার থাকবে এই প্ল্যাটফর্মের প্রস্তাবনায়। থাকবে বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক আজাদি এবং বৈষম্যহীন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রস্তাবনাও।’

পিলখানা, শাপলা ও জুলাই গণহত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধের বিচার, ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণ এবং জুলাইয়ের আহত যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার দাবিতে জনমত ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা নতুন এই প্ল্যাটফর্মের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে বিবেচিত হবে বলে পোস্টে উল্লেখ করেন আলী আহসান জুনায়েদ। তিনি আরও লেখেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন, সমাজের সর্বস্তরে যোগ্য ও নৈতিক নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা, সামাজিক সুবিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, সামাজিক নিরাপত্তা বিধান এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে বাংলাদেশ পুনর্গঠন এই প্ল্যাটফর্মের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা।

জুনায়েদের সহযোগী শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আরেক সাবেক সভাপতি রাফে সালমান রিফাতও আপ বাংলাদেশ প্ল্যাটফর্মের কথা উল্লেখ করে আজ সন্ধ্যায় ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন।

জানতে চাইলে আলী আহসান জুনায়েদ প্রথম আলোকে বলেন, চলতি এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তাঁরা এই প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন। তার আগে একটি সার্চ কমিটি প্রকাশ করা হবে। প্ল্যাটফর্ম ঘোষণার পর তাঁরা মানুষের রেসপন্স (সাড়া) বোঝার চেষ্টা করবেন। মানুষ চাইলে প্ল্যাটফর্মটি রাজনৈতিক দলে রূপ নিতে পারে।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা তরুণদের উদ্যোগে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠিত হয়। ২৬ নভেম্বর এই প্ল্যাটফর্মে কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবে যোগ দেন জুনায়েদ ও রাফে সালমান। এরপরই মূলত তাঁদের দুজনের অতীত রাজনৈতিক পরিচয় সামনে আসে। জুলাই অভ্যুত্থানে তাঁদের ভূমিকার কথাও আলোচিত হয়। এরপর ৯ ডিসেম্বর জাতীয় নাগরিক কমিটির সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন করা হয়। সেখানে জুনায়েদকে যুগ্ম আহ্বায়ক ও রাফেকে যুগ্ম সদস্যসচিব করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলে ওই দলে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক পদের জন্য জুনায়েদের নাম আলোচিত হয়। রাফে সালমান রিফাতও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে পারেন, এমন আলোচনাও তখন ছিল।

কিন্তু একপর্যায়ে নতুন দলের শীর্ষ একটি পদে জুনায়েদকে বসানোর দাবিকে কেন্দ্র করে জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোক্তাদের ভেতরে বিতর্ক তৈরি হয়। এ নিয়ে ফেসবুকে পাল্টাপাল্টি পোস্ট দেন কমিটির দুটি পক্ষের সমর্থকেরা। আন্দোলনের কৃতিত্ব দাবি করে শুরু হয় কাদা–ছোড়াছুড়ি। এই বিতর্কে এক পক্ষে ছিলেন নাগরিক কমিটিতে থাকা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতারা, অন্য পক্ষে আখতার হোসেনের (বর্তমানে এনসিপির সদস্যসচিব) সমর্থকেরা।

এর মধ্যেই চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বিএনপিসহ ৮টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে ২৪ ফেব্রুয়ারি চীন সফরে যান আলী আহসান জুনায়েদ ও রাফে সালমান রিফাতসহ জাতীয় নাগরিক কমিটির চারজন নেতা। এ নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটিতে প্রশ্ন তৈরি হয়। সেদিন মধ্যরাতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে নাগরিক কমিটি বলেছিল, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে তারা কোনো আমন্ত্রণ পায়নি। জুনায়েদ, রিফাতসহ চারজনের এই সফরের বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি অবগত নয়। এমন পরিস্থিতিতে ২৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ফেসবুকে পৃথক পোস্ট দিয়ে জুনায়েদ ও রিফাত জানান, সমন্বয়কদের উদ্যোগে যে নতুন রাজনৈতিক দল হচ্ছে, তাতে তাঁরা থাকছেন না।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আহস ন জ ন য় দ ন র জন ত ক কম ট র ফ সব ক এনস প

এছাড়াও পড়ুন:

ঐক্য অটুট রাখা জরুরি, ফ্যাসিবাদ ফিরে এলে কেউই রেহাই পাবে না: এবি পার্টি

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, জুলাইয়ের পক্ষের শক্তিদের আত্মঘাতী সংঘাতে জড়ানোর সুযোগ নেই। মত ও পথ ভিন্ন হতে পারে, সমালোচনাও হবে, তবে ফ্যাসিবাদের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ঐক্য অটুট রাখা জরুরি। কারণ, ফ্যাসিবাদ ফিরে এলে জুলাই আন্দোলনের পক্ষে থাকা কেউই রেহাই পাবে না।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীতে দলীয় কার্যালয়ে দলের পক্ষ থেকে জুলাই–২৪ গণ–অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানেই মজিবুর রহমান এ কথাগুলো বলেন।

এবি পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ‘যদি জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সফল না হতো তাহলে আমাদের কারাগারে কাটাতে হতো, নেমে আসত অবর্ণনীয় নির্যাতন। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা লাশের স্তূপ তৈরি করেছিল, তারা পেত রাষ্ট্রীয় খেতাব।’

গণ-অভ্যুত্থান ছাত্র-জনতাসহ রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ফলেই সফল হয়েছে জানিয়ে মজিবুর রহমান বলেন, সবার অবদানকেই স্বীকৃতি দিতে হবে। এটা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। অনেক কিছুই পাইনি। তবে স্বাধীনভাবে যে কথা বলছি, লিখছি, বক্তব্য দিচ্ছি, সেটা গণ-অভ্যুত্থানেরই ফসল।

সংবর্ধনা পাওয়া জুলাই যোদ্ধা আসিফ বলেন, ‘আমার পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে পুলিশ গুলি করেছে। মনে হচ্ছিল মৃত্যু উপত্যকায় পড়ে আছি। এবি যুব পার্টির আহ্বায়ক টুটুল ভাই আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।’

আরেক জুলাই যোদ্ধা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘১৮ জুলাই আমি ছিলাম ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। পুলিশ ছিল দুই পাশে। আমরা ছিলাম ৬ জন। কিন্তু তারা (পুলিশ) ছিল ৮৬ জন। ওই দিন জীবিত ফিরব কখনো কল্পনা করিনি।’

অনুষ্ঠানে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আতিকুর রহমান, রহমত উল্লাহ, অধ্যাপক হুমায়ুন কবির, শাখাওয়াত হোসেন, আকিব হাসান, আশরাফুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম, হেদায়েত উল্লাহ, রোমান মিয়া, সিফায়েত হোসাইন, মোহাম্মদ হোসাইন আহমেদ, মোহাম্মদ আমিন, নাবিল, মুস্তাফিজ বিল্লাহ হাবিবী, হাবিবুর রহমান, ফয়েজ আকাশ, নুরুল হুদা, ইকবাল হোসেন, রাশেদুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এবি পার্টির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল ওহাব মিনারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত টুটুল। দলের ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক  আলতাফ হোসাইনের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন এবি পার্টির নেতা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) দিদারুল আলম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হেলাল উদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন, যুব পার্টির সদস্যসচিব হাদিউজ্জামান খোকন প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ