ময়মনসিংহে রাজস্ব তহবিলের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
Published: 16th, April 2025 GMT
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সাবেক নির্বাহী অফিসার সারমিনা সাত্তার ও উপজেলা প্রকৌশলী আয়েশা আখতারের বিরুদ্ধে নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রকল্প গ্রহণ ও ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি অর্থ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে।
নিজেদের দুর্নীতি আড়াল করতে এসব প্রকল্পের কাগজপত্রও অফিস থেকে গায়েব করা হয়েছে বলে অভিযোগ। যাদের নামে প্রকল্প দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে, তারা দুর্নীতিবাজ এসব কর্মকর্তাদের বিচার চেয়েছেন।
উপজেলা পরিষদ রাজস্ব তহবিল ব্যবহার নির্দেশিকা ২০২০ অমান্য করে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে নিয়মিত রাজস্ব তহবিল ও উদ্বৃত্ত রাজস্ব তহবিল থেকে সরকারি অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে। তাছাড়া অধিকাংশ প্রকল্পের কোন ধরনের কাজ না করে এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রকল্প দেখিয়ে অর্থ লোপাট করা হয়।
সরকারি বিধি মতে, উপজেলা পরিষদ রাজস্ব তহবিল ব্যবহার নির্দেশিকা ২০২০ অনুযায়ী কী কী খাতে অর্থ ব্যয় করা যাবে তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা আছে।
নিয়মানুযায়ী সরাসরি রাজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্প গ্রহণ করার সুযোগ নেই। কিন্তু সাবেক নির্বাহী অফিসার সারমিনা সাত্তার ও উপজেলা প্রকৌশলী আয়েশা আখতার কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিগত বিলাসিতা ও লুটপাটের উদ্দেশ্যে উপজেলা পরিষদ নির্দেশিকার ‘ক’ থেকে ‘ম’ এর বাইরে বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করেছেন যা নিয়ম বহিভূর্ত।
তথ্য অধিকার আইনে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানাগেছে, ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসের মাসিক সভায় পিআইসির মাধ্যমে ৮৫ লাখ টাকার ৫৯টি প্রকল্প, আরএফকিউ এর মাধ্যমে তিন কোটি ২২ লাখ টাকার ৩৯টি প্রকল্প ও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ৯৯ লাখ টাকার ১৩টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়।
আরএফকিউ প্রকল্পের মাধ্যমে অফিস মেরামত বাবদ ১০ লাখ, ডরমেটরি মেরামত বাবদ ৫লাখ, আবাসিক ভবন রং করা বাবদ সাড়ে ৮ লাখ, অফিস ভবনের গ্রিল স্থাপন ৫ লাখ টাকা, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসভবনের টয়লেট নির্মাণ, গেইট নির্মাণ ও বাসা রং করার পৃথক দুটি প্রকল্পে ২০ লাখ টাকা, অফিস ভবন রং করার ১০ লাখ টাকা, উপজেলা পরিষদের সৌন্দর্য বর্ধন ৮ লাখ টাকা, বৃক্ষরোপণ ও শাক-সবজির বাগান ৫ লাখ টাকা, পুকুরের সৌন্দর্য বর্ধন দুই ধাপে ২০ লাখ টাকা, জামে মসজিদ মেরামত ২ লাখ টাকা, অফিসার্স ক্লাব মেরামত ৫ লাখ টাকা এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবনের টয়লেট মেরামত বাবদ ১০ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়।
যদিও উপজেলা পরিষদ ম্যানুয়াল অনুযায়ী এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। তারপরেও এসকল প্রকল্প সরেজমিন দেখতে গিয়ে পুকুর সৌন্দর্যবর্ধন ও পরিষদের সীমানায় চুনকাম ছাড়া কোনকিছু চোখে পড়েনি।
এদিকে গত বছরের ৫ আগস্টের পর উপজেলার মাইজবাগ ইউনিয়নের চরশংকর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য প্রয়াত আব্দুল খালেকের ছেলে নয়ন মিয়া তার বাড়িতে একটি সাবমারসেবল পাম্প বসানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান ফরিদ মিয়ার কাছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব ও এডিপি খাতের পিআইসির আওতায় পাম্প নির্মাণের জন্য তার নামে ১ লাখ ২০হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। কিন্তু কাজ না করেই পুরো টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়।
একই গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য আবুল কাশেমের নামেও সাবমারসেবল পাম্প বসানোর জন্য বরাদ্দ আসে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। সেই টাকাও একইভাবে আত্মসাৎ করা হয়। পুরো ইউনিয়নে ৬টি প্রকল্পের মধ্যে কোনটিরও কাজ হয়নি। অথচ সুবিধাভোগিরা তাদের নামে টাকা বরাদ্দের বিষয়টি নিজেরাও জানেন না।
প্রকল্পের সভাপতি ফরিদ মিয়া জানিয়েছেন, কাজ না করে প্রকল্পের টাকা উত্তোলনের বিষয়ে তিনি অবগত নন। এমনটি হতে পারে তিনি বিশ্বাসও করছেন না।
একই অবস্থা উপজেলার ৯ ইউনিয়নে পিআইসির মাধ্যমে নেয়া ৫৯টি প্রকল্পের। এসব প্রকল্পের মোট বরাদ্দ ছিল ৮৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা। প্রকল্পের সভাপতি অনেক ইউপি চেয়ারম্যানরাও জানেন না প্রকল্পের বিষয়ে।
রাজিবপুর ইউনিয়নের চরশংকর গ্রামে গিয়ে কথা হয় নয়ন মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, “প্রত্যেকের বাড়িতে কল আছে, আমার নেই। তাই আমি বিষয়টি ফরিদ চেয়ারম্যানের সাথে বলেছিলাম। তিনি আমার সকল কাগজপত্র নিয়েছেন। প্রায়ই সময় তাকে জিজ্ঞাসা করেছি কল কবে পাব? তিনি বলেছিলেন বরাদ্দ আসলে পাব। এখন শুনছি আমার নামে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা এসেছে। কিন্তু আমি তা পাইনি। যারা আমার মত গরিবের হক মেরে খেয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।”
একই গ্রামের আবুল কাশেম বলেন, “কল তো দূরের কথা কাগজ জমা দেওয়ার পর কারো সাথে এ বিষয়ে কথা বলারও সুযোগ হয়নি। অপেক্ষায় ছিলাম হয়তো কল পাব। এখন লুটপাটের কথা শুনে অন্তত হলেও অপেক্ষার অবসান হয়েছে। ৫ আগস্টের পর মনে করেছিলাম দেশে অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ হবে। কিন্তু তা না হয়ে আরও বেড়েছে। আমরা আর ভালো হতে পারলাম কই? ছেলে-মেয়েদের রক্তে রাঙা এই নতুন দেশে প্রশাসনিক কর্মকতাদের কাছ এমন অনিয়ম প্রত্যাশিত নয়।”
স্থানীয় আবুল মুনসুর বলেন, “প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকার নয়-ছয় এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। শুনছি আমাদের ইউনিয়নে ৬টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একটিরও কাজ হয়নি। যারা প্রকল্পের নামে টাকা আত্মসাৎ করেছে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক।”
মাইজবাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রকল্পের সভাপতি ফরিদ মিয়া বলেন, “পিআইসির মাধ্যমে আমার ইউনিয়নে কোনো কাজ হয়নি। সেখানে টাকা তোলারতো প্রশ্নই ওঠে না। এখন শুনছি ৬টি প্রকল্পের নামে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কিন্তু আমার কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না। এমনটি হয়ে থাকলে আমি আইনগত ব্যবস্থা নেব।”
তারুন্দিয়া ইউনিয়নে ৫টি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া সাত লাখ টাকা। এরমধ্যে অফিস মেরামত ও ল্যাপটপ ক্রয়ে দেওয়া হয় আড়াই লাখ টাকা।
তারুন্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রকল্পের সভাপতি মাহমুদ হাসান রানা বলেন, “৫টি প্রকল্পের মধ্যে ড্রেন নির্মাণ দুটি প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে। কিন্তু ল্যাপটপ এবং অফিস মেরামতের বরাদ্দের বিষয়ে আমি অবগত নই।”
ঈশ্বরগঞ্জ এলজিইডির উপজেলা বর্তমান প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম বলেন, “প্রকল্পের নামে টাকা উত্তোলন হয়েছে। লোকজন এসে বর্তমান ইউএনও স্যারের কাছে অভিযোগও করেছেন শুনেছি। টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য প্রকল্পের সভাপতিদেরকে তিনি চিঠিও দিয়েছেন। তবে আমি এসে আমার অফিসে প্রকল্পের কোনো কাগজপত্র পাইনি।”
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদুল আহমেদ বলেন, “আমি যোগদানের পর আত্মসাৎ করা প্রকল্প বাতিল করে নতুন প্রকল্প দিয়েছি। তারা কাজ না করে কীভাবে টাকা উত্তোলন করেছে সে বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে চেয়ারম্যানদেরকে নির্দেশনা দিয়েছি জনগুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করার জন্য।”
তিনি আরও বলেন, “উপজেলা পরিষদের ভেতরে-বাইরে কী কাজ হয়েছে আপনারা তো নিজের চোখেই দেখছেন। আমার বলার কী আছে?”
ঈশ্বরগঞ্জ এলজিইিডির সাবেক ও বর্তমানে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকা আয়েশা আখতার বলেন, “কোন প্রকল্প কী হয়েছে এ বিষয়ে পরে কথা বলব।”
এ কথা বলে মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। এরপর কয়েকবার চেষ্টা করেও তাঁর কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে বর্তমানে ঈশ্বরগঞ্জের সাবেক ও নান্দাইল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সারমিনা সাত্তার বলেন, ‘‘কাজ চলাকালীন সময়ে আমার বদলি হয়েছে। পরে প্রকল্পের কী হয়েছে না হয়েছে সেটা আমার জানার বিষয় নয়।”
প্রকল্প শেষ না হওয়ার আগে বিল প্রদানের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সেটি করা আমার ভুল হয়েছে।”
ঢাকা/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প রকল প র ন ম প রকল প দ খ য় প রকল প র ম প রকল প র ক ক গজপত র প আইস র উপজ ল র বর দ দ র জন য ক জ হয় অফ স র ম র মত
এছাড়াও পড়ুন:
জিল হোসেন মারা গেছেন, আদালতে তাঁর লড়াই শেষ হবে কবে
জিল হোসেনের ৭২ বছরের জীবনের ৪৭ বছরই কেটেছে আইনি লড়াইয়ে। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা পাসের সনদ পেতে, এরপর ক্ষতিপূরণের দাবিতে তাঁর এই দীর্ঘ লড়াই। লড়াই এখনো শেষ হয়নি। এর মধ্যেই মারা গেছেন জিল হোসেন।
জিল হোসেনের মৃত্যুর পর তিন বছর ধরে লড়াইটা করে যাচ্ছেন স্ত্রী ও তাঁর সন্তানেরা। কিন্তু পরিবারটির বিচারের অপেক্ষা শেষ হয়নি।
পরিবার ও মামলার নথিতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, জিল হোসেনের জন্ম ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি। ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে তিনি ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের (কৃষি) পরীক্ষার্থী ছিলেন। এই পরীক্ষা হয় ১৯৭৩ সালে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার ফলাফলে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। ফলাফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করেন জিল হোসেন। কিন্তু সেই আবেদনে কাজ হয়নি।
১৯৭৫ সালে জিল হোসেন আবার পরীক্ষায় অংশ নেন, কিন্তু তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এসবের প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে তিনি মামলা করেন। মামলায় তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁর প্রাপ্ত নম্বরের (১৯৭৩ সালে দেওয়া পরীক্ষায়) সঙ্গে ভগ্নাংশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে।
সেই আইনি লড়াইয়ের শুরু। নিম্ন আদালত পেরিয়ে বছরের পর বছর উচ্চ আদালতেও ছুটেছেন তিনি। সিরাজগঞ্জ সদরের চিলগাছা গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকতেন জিল হোসেন। ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। সংসারে স্ত্রী এবং চার ছেলে ও চার মেয়ে রয়েছে। আইনি লড়াই নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মারা যান জিল হোসেন। এর পর থেকে মামলায় পক্ষ হয়ে তাঁর স্ত্রীসহ উত্তরাধিকারীরা লড়াই করে যাচ্ছেন।
বাবা উচ্চ আদালতের রায় দেখে যেতে পারেননি। বাবা নেই, বুকে চাপা কষ্ট হয়। বাবার কাছে শুনেছি, মামলা চালাতে গিয়ে জমিসহ অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালির কারণে বাবার জীবন ধ্বংস হয়েছে, আমাদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।নূর হোসেন, বাদী জিল হোসেনের ছোট ছেলেজিল হোসেনের ছোট সন্তান নূর হোসেন গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবা উচ্চ আদালতের রায় দেখে যেতে পারেননি। বাবা নেই, বুকে চাপা কষ্ট হয়। বাবার কাছে শুনেছি, মামলা চালাতে গিয়ে জমিসহ অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালির কারণে বাবার জীবন ধ্বংস হয়েছে, আমাদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’
আরও পড়ুনশিক্ষাসনদ নিয়ে ৪৮ বছরের আইনি লড়াই: ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রায় বাস্তবায়নে বাধা নেই০৮ অক্টোবর ২০২৩নূর হোসেন আরও বলেন, ‘মা এবং ভাইবোনেরা এখন মামলা চালাচ্ছি। মায়ের বয়স ৬৯ বছর। তিনিও নানা রোগে ভুগছেন। তিনিও চূড়ান্ত রায় দেখে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভ টু আপিল এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। বাবা মারা যাওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো অনুশোচনা নেই, এটা কষ্টের।’
আইনি লড়াই
জিল হোসেন যখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (কৃষি) দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ বর্ষের পুরোনো পাঠ্যক্রমের চূড়ান্ত পরীক্ষার্থী ছিলেন, তখন তাঁর বয়স ২৩ বছর। ময়মনসিংহের মুনসেফ আদালতে করা মামলায় জয়ী হন তিনি। আদালত ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য করাকেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
তবে জিল হোসেনের লড়াই তখনো বাকি। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জজ আদালতে যায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ৩১ জানুয়ারি এই আদালতের দেওয়া রায়েও জিল হোসেনের বহিষ্কারাদেশ বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
একই বছর হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। হাইকোর্ট ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য প্রথম মুনসেফ আদালতে পাঠান। এরপর ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম মুনসেফ আদালত ভগ্নাংশ নম্বর যোগ করে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার নির্দেশ দেন।
আরও পড়ুনসেবাদাতা বা গ্রহীতাদের সন্তুষ্টির মূল্যায়ন হয়নি২৮ এপ্রিল ২০২২এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবার জেলা জজ আদালতে আপিল করে, যা নামঞ্জুর হয়। পরে হাইকোর্টে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর ওপর ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় দেওয়া হয়। এ রায়ে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে।
অতঃপর সনদ, ক্ষতিপূরণ মামলা
পরিবার ও মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ের পর ১৯৮৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিল হোসেনের একটি আবেদন গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে তাঁকে পাস নম্বর দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর নম্বরপত্রের সনদ দেওয়া হয়। তখন জিল হোসেনের বয়স ৪৭ বছর। তখন তাঁর সরকারি চাকরির বয়সসীমা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।
লিভ টু আপিল বিচারাধীন উল্লেখ করে একের পর এক সময় নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুপ্রিম কোর্টর স্থগিতাদেশ না থাকায় মামলা চলতে আইনগত বাধা নেই। অথচ মামলাটি চলছে না, যা জিল হোসেনের পরিবারের জন্য ভোগান্তির।চঞ্চল কুমার বিশ্বাস, বাদীপক্ষের আইনজীবীএরপর ২০০০ সালের ১৮ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ দাবি করে অধস্তন আদালতে মামলা করেন জিল হোসেন। মামলায় অভিযোগ করেন, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পরে কার্যকর করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তাঁর জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে সরকারি চাকরির সম্ভাবনাও।
ক্ষতিপূরণের এ মামলায় ২০০৮ সালের ২৬ আগস্ট রায় দেন ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ কোটি টাকা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৪ বছর পর নিষ্পত্তি
বিচারিক আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৪ জুন হাইকোর্ট শর্ত সাপেক্ষে ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ স্থগিত করেন। শর্ত হিসেবে ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকা ৩ মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বলা হয়। এতে ব্যর্থ হলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়ে যাবে বলেও ওই আদেশে উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানান, জিল হোসেন মারা যাওয়ার পর আপিল শুনানির জন্য উঠলে ১৩ বছর আগে হাইকোর্ট ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা সামনে আসে। এ অবস্থায় হাইকোর্ট আপিলকারী পক্ষকে ২৫ লাখ টাকা জমা দিয়ে আসতে বলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালে ৪ নভেম্বর ওই অর্থ জমা দেয়।
বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। বিচারাধীন থাকলে নিম্ন আদালতে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কার্যক্রম স্থগিত থাকে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তও আছে। আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবীবিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা আপিল খারিজ করে ২০২৩ সালের ৭ মার্চ রায় দেন হাইকোর্ট। ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় সংশোধন সাপেক্ষে বহাল রাখেন হাইকোর্ট। রায়ের দিন থেকে ওই অর্থের বিপরীতে ১০ শতাংশ হারে তারা (জিল হোসেনের পরিবার) লভ্যাংশ পাবেন বলেও জানানো হয়। অবশ্য এর আগে শর্ত অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জমা করা ২৫ লাখ টাকা ওই অর্থ থেকে বাদ যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভ টু আপিল
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে লিভ টু আপিল করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সঙ্গে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করা হয়। আবেদনটি ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর আপিল বিভাগে শুনানির জন্য ওঠে। শুনানি নিয়ে সেদিন তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দেন। লিভ টু আপিল ক্রম অনুসারে শুনানি হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় লিভ টু আপিলটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের গত ৩১ আগস্টের কার্যতালিকায় ৫০৭ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।
জিল হোসেনের পরিবারের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি পরিচালনার জন্য ২০২৩ সালের ৯ মার্চ আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস নিয়োগ পান। তাঁকে নিয়োগ দেয় সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি। চঞ্চল কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আবেদন আপিল বিভাগ খারিজ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন আদালতে অর্থ আদায়ে জারি মামলার (২০০৯ সালে করা) কার্যক্রম অগ্রসরের জন্য বাদীর উত্তারাধিকারীকারেরা আবেদন করেন।
আরও পড়ুনসনদ ও ক্ষতিপূরণের জন্য ৪৭ বছরের আইনি লড়াই ১৭ ডিসেম্বর ২০২২চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, লিভ টু আপিল বিচারাধীন উল্লেখ করে একের পর এক সময় নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ না থাকায় মামলা চলতে আইনগত বাধা নেই। অথচ মামলাটি চলছে না, যা জিল হোসেনের পরিবারের জন্য ভোগান্তির।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। বিচারাধীন থাকলে নিম্ন আদালতে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কার্যক্রম স্থগিত থাকে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তও আছে। আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।’
আরও পড়ুন৩৩ বছর কেটে গেছে, কাজল কথা রেখেছেন০৫ আগস্ট ২০২৫