আলজেরিয়া আর ফ্রান্সের মধ্যকার সম্পর্ক যেন পুরোনো প্রেমিক-প্রেমিকার মতো। এককালে ভালোবাসা ছিল। এখন তা অস্বীকারও করা যায় না। আবার সম্পর্ক রাখাও যায় না। এমন কোনো সপ্তাহ যায় না যে দুই দেশের মধ্যে নতুন কোনো ঝামেলা না ঘটে।

কয়েক দিন আগে আলজেরিয়া প্যারিসে তাদের এক কনস্যুলেট কর্মীকে গ্রেপ্তারের জবাবে ফরাসি দূতাবাসের কর্মীদের বহিষ্কার করেছে। এমন সব ঘটনা এখন যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এক পক্ষ কিছু করলে অন্য পক্ষ পাল্টা জবাব দেয়।

১৯৬২ সাল পর্যন্ত আলজেরিয়া ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে লুকানো ক্ষোভ আর অবিশ্বাস এখন এক জটিল মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকে মনে করছেন, ফ্রান্স-আলজেরিয়া সম্পর্কের এতটা খারাপ সময় আর কখনো আসেনি।
তবে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অনেকটাই অনুচ্চারিত থেকে যাচ্ছে—কার কাকে বেশি প্রয়োজন? ফ্রান্স কি এখনো আলজেরিয়াকে শর্ত চাপিয়ে দিতে পারে? নাকি আলজেরিয়া এখন নিজেদের শক্তি বুঝতে শিখেছে?

এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে শুধু ইতিহাস, ঔপনিবেশিক অতীত আর পশ্চিম সাহারার বিষয়ে ফ্রান্সের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করলেই হবে না; বরং আজকের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আর অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হবে।

অর্থনৈতিক ভারসাম্যে পরিবর্তন

ফ্রান্স আর আলজেরিয়ার মধ্যে সম্পর্ক যতই অবনতি হোক, তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক অনেকটাই পরস্পর নির্ভরশীল। তবে সম্প্রতি এমন কিছু বিষয় থেকে এ সম্পর্কের নাজুকতা আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।

ফরাসি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য নির্ধারিত একটি বৈঠক হঠাৎ বাতিল করে দেয় আলজেরিয়ার অর্থনৈতিক পুনর্গঠন পরিষদ। কারণ, ফরাসি কর্তৃপক্ষ নাকি আলজেরিয়ায় একটি বড় বন্দর প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে চাওয়া ফরাসি ব্যবসায়ী রদলফ সাদেকে নিরুৎসাহিত করেছে।

এসবে ক্ষুব্ধ হয়ে আলজেরিয়া যদি পাল্টা অর্থনৈতিক আঘাত হানে, তবে তাতেই ফ্রান্সের পাঁচ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের রপ্তানি একলহমায় মুছে যেতে পারে। এ রকম হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন আলজিয়ার্সে কাজ করা এক অভিজ্ঞ ফরাসি ব্যবসায়ী।

বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক মোটামুটি স্থিতিশীল। যদিও দুই দেশের মধ্যে সামগ্রিক বাণিজ্য গত বছরে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। ফ্রান্সের কোম্পানিগুলো এখনো আলজেরিয়ায় হাইড্রোকার্বন, ওষুধ, ব্যাংকিং এবং কৃষিতে কাজ করছে। তবে তাদের একচেটিয়া প্রভাব ধীরে ধীরে কমছে।

অন্যদিকে আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্সে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তেল-গ্যাস। ২০২৩ সালে এ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। ফ্রান্সের গ্যাসের চাহিদার প্রায় ৮ শতাংশ আসে আলজেরিয়া থেকে। যদি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুরোপুরি ভেঙে পড়ে, তাহলে ফ্রান্সকে কাতার বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ থেকে বেশি দামে গ্যাস কিনতে হবে।

এদিকে ফ্রান্স থেকে আলজেরিয়ার আমদানি বিগত পাঁচ বছরে গড়ে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হারে কমেছে।

ফ্রান্সের চাই সুসংহত কূটনৈতিক কণ্ঠস্বর। আলজেরিয়ার চাই বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক গড়ে তুললেও ফ্রান্সের সঙ্গে পুরোনো অর্থনৈতিক বন্ধন টিকিয়ে রাখা। তবে তা করতে হলে দুই পক্ষকেই পুরোনো অভিমান ছেড়ে বাস্তবতার পথে হাঁটতে হবে।কৌশলগত পরিবর্তন

ফ্রান্সের ৪৫০টি কোম্পানি এখনো আলজেরিয়ায় কাজ করছে। তবে অন্য দেশগুলোর উপস্থিতিও দ্রুত বাড়ছে। যেমন বর্তমানে তুরস্কের ১ হাজার ৪০০ কোম্পানি আলজেরিয়ায় নিবন্ধিত, যা ফ্রান্সের চেয়েও অনেক বেশি।

এ ছাড়া আলজেরিয়া এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কাতার, সৌদি আরব, জার্মানি ও ইতালির সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করছে। বিশেষ করে ইতালির সঙ্গে ২০২২ সালে সই হওয়া গ্যাস চুক্তির ফলে ইতালির গ্যাসের ৩৯ শতাংশই এখন আসে আলজেরিয়া থেকে। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তি ও কৃষি খাতে দুই দেশের সম্পর্ক শক্তিশালী হচ্ছে।

২০২৩ সালে আলজেরিয়া আরব বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে তরল গ্যাস রপ্তানি বাড়িয়েছে। ২০২৪ সালে আলজেরিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের চতুর্থ বৃহত্তম গ্যাস সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে। ইউরোপীয় জ্বালানিনিরাপত্তায় আলজেরিয়ার প্রভাব খুব স্পষ্ট।

এখন আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট চাইছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ২০০৫ সালের মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সংশোধন করতে। এ প্রক্রিয়ায় ফ্রান্সের সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনীতির ভিত মজবুত করছে আলজেরিয়া

তেল-গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতে চায় আলজেরিয়া। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে তাদের নন-হাইড্রোকার্বন রপ্তানি তিন গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে।

অন্যদিকে ফ্রান্সের রপ্তানির পরিমাণ বিশাল। ফ্রান্স আলজেরিয়ার বাজার হারিয়ে ফেললেও বিকল্প খুঁজে পেতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাগুলোর জন্য সমস্যা হবে। কারণ, এর মধ্যে অনেকেই আলজেরিয়ার বাজারে নির্ভরশীল।
তবু সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক শক্তির ভারসাম্যে আলজেরিয়া এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী।

নিরাপত্তা ও অভিবাসন

এই দ্বন্দ্বের আরও একটি গভীর দিক আছে—নিরাপত্তা ও অভিবাসনের রাজনীতি। সাহেল অঞ্চলে ফ্রান্সের সামরিক ভূমিকা স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। কিন্তু ভৌগোলিকভাবে আফ্রিকার অঞ্চলটি আলজেরিয়ার কাছাকাছি। সেখানে তার দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক থাকার কারণে অঞ্চলটি তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান সম্প্রতি গোপনে আলজিয়ার্স সফর করে এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখার প্রয়াস চালিয়েছেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অভিবাসন। আলজেরিয়ার সহযোগিতা ছাড়া ফ্রান্সের পক্ষে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ, সীমান্ত সুরক্ষা এবং বিতাড়নের মতো নীতিমালা কার্যকর করা কঠিন হবে।

এই দ্বন্দ্ব সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে ফ্রান্সে বসবাসকারী আলজেরীয় বংশোদ্ভূত প্রায় ১৮ লাখ মানুষের জীবনে। ফ্রান্সে রাজনৈতিক উত্তেজনার সময় তাঁরা বৈষম্যের শিকার হন, অনেক সময় ডানপন্থী দলগুলোর কটাক্ষের নিশানা হন।

১৯৬৮ সালের চুক্তি আলজেরিয়ানদের ফ্রান্সে বসবাসের অধিকার দিয়েছিল। তা নিয়েও এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে রাজনৈতিক দর–কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে।

জটিল সন্ধিক্ষণে

ফ্রান্স-আলজেরিয়া সম্পর্ক এখন এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সের কূটনৈতিক সক্ষমতা গত তিন দশকে অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে আজকের সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হচ্ছে।

যদি দুই দেশ এই উত্তেজনা কাটিয়ে উঠতে চায়, তবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার বদলে কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। ফ্রান্সের চাই সুসংহত কূটনৈতিক কণ্ঠস্বর। আলজেরিয়ার চাই বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক গড়ে তুললেও ফ্রান্সের সঙ্গে পুরোনো অর্থনৈতিক বন্ধন টিকিয়ে রাখা। তবে তা করতে হলে দুই পক্ষকেই পুরোনো অভিমান ছেড়ে বাস্তবতার পথে হাঁটতে হবে।

ডালিয়া ঘানেম ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের বিশ্লেষক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আলজ র য র জন ত দশম ক ইউর প ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

সুনামগঞ্জে ২ কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা নদীতে অভিযান চালিয়ে দুই কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

রবিবার (১ জুন ) দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সুনামগঞ্জ ২৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল একেএম জাকারিয়া কাদির। 

বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, রবিবার ভোর রাতে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার হালুয়াঘাট এলাকায় সুরমা নদীতে সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়নের (২৮ বিজিবি) একটি বিশেষ আভিযানিক দল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে টাস্কফোর্স অভিযান চালায়। এ সময় মালিকবিহীন একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকাসহ ১ হাজার ৭০০ পিস ভারতীয় বিভিন্ন ধরনের উন্নতমানের শাড়ি, ৭ হাজার ২০০টি ক্রিম এবং ১৮০ কেজি জিরা জব্দ করা হয়। যার মোট মূল্য আনুমানিক ২ কোটি ৩ লাখ ৬ হাজার টাকা।

আরো পড়ুন:

ভারতে ১ সপ্তাহে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে ১২০০ শতাংশ

মিস ওয়ার্ল্ড বিজয়ী ওপল সুচাতা

এ অভিযানে জেলা প্রশাসকের কার্যালায়ের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান হৃদয়, সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়ন (২৮ বিজিবি) ভারপ্রাপ্ত কোয়ার্টার মাস্টার মো. রফিকুল ইসলাম ও ২০ জন বিজিবি সদস্য অংশগ্রহণ করেন। 

সুনামগঞ্জ ২৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল একেএম জাকারিয়া কাদির বলেন, “ঈদকে সামনে রেখে চোরাচালানী তৎপরতা রুখতে বিজিবির আভিযানিক কার্যক্রম ও গোয়েন্দা নজরদারী অব্যাহত রয়েছে। আটক ভারতীয় শাড়ি, ক্রিম ও জিরা সুনামগঞ্জের শুল্ক কার্যালয়ে জমা করার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।”

ঢাকা/মনোয়ার/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ